লর্ডসে বিশ্বকাপের খেতাবের লড়াই। ২২ গজে বিশ্বসেরা হওয়ার লড়াইয়ে ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। সেখানে নতুন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে ইংল্যান্ডের টার্গেট ২৪২ রানের। টস জিতে প্রথমে ব্যাট করে ৮ উইকেট হারিয়ে ২৪১ রান তুলতে সক্ষম হয়েছে কেন উইলিয়ামসনের দল।
ক্রিকেটের ‘তীর্থভূমি’ লর্ডস। যেখানে বোলার বা ব্যাটসম্যান সবার জন্যই কিছু থাকে। ম্যাচের দিন সকালে বৃষ্টি হওয়ায় টস হল ১৫ মিনিট দেরিতে। উইকেট ঢাকা ছিল। আউটফিল্ড ভেজা। ইঙ্গিত ছিল পেসারদের বাড়তি সুবিধা পাওয়া নিয়ে। কিন্তু কভার সরাতেই দেখা মেলে শুকনো উইকেটের। টস জিতে কী করবেন? মনের কোনের এই প্রশ্নে হয়তো কিছুটা ধন্ধে পড়ে যান দুই অধিনায়ক। তবে টস জিতে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব না করেই ব্যাটের সিদ্ধান্ত নেন উইলিয়ামসন।
শুকনো-সবুজ পিচ, কিন্তু মাঠ ভেজা। এই অবস্থায় দুই দলের জন্যই সুযোগটা ৫০-৫০। তবে সুবিধাটা বেশি নিলেন ইংল্যান্ড পেসাররাই। ক্রিস ওকস ও জফরা আর্চারের গতি আর সুইংয়ের সামনে যেন হাঁসফাঁস করলেন মার্টিন গাপটিল ও হেনরি নিকোলস।
প্রথম ওভার থেকে কিউই ওপেনারদের ঘাড়ে পেস-পাথর চাপিয়ে দিলেন ওকস-আর্চার। স্লিপে থাকা তিন ফিল্ডারের নিঃশ্বাস যেন দমটা আরও বন্ধ করে দিচ্ছিল গাপটিল-নিকোলসের! এর মধ্যেই কুমার ধর্মসেনার সিদ্ধান্তে একবার আউট হয়েও নিকোলস বেঁচে গেলেন রিভিউ’র বদৌলতে। ওকসের বলে তার আগে একবার আউটের ঘর প্রায় দেখে আসেন গাপটিল।
বিশ্বকাপের ফাইনাল। এমন ম্যাচে তাপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে থাকে চাপও। শুরুতে সেই চাপটা নিতে পারলেন না গাপটিল। আগের ১০ ম্যাচের মতো ফাইনালেও ফিরলেন নিজের ছায়ায় থেকে। সেমিফাইনালসহ ৯ ম্যাচে করেছিলেন মাত্র ১৬৭ রান। ফাইনালে তাই তার কাছে একটা বড় ইনিংস পাওনাই ছিল দলের। কিন্তু এবারও হতাশ করলেন। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচেও নিষ্প্রভ কিউই ওপেনার।
লর্ডসে অবশ্য আশাজাগানিয়া শুরুই করেছিলেন গাপটিল। বলের চেয়ে রানটা এগোচ্ছিল বেশি। কিন্তু সপ্তম ওভারে ঘটল ছন্দপতন। ওকসের দ্বিতীয় বলটা একদম নিখুঁত লেন্থে আঘাত হানে গাপটিলের পায়ে। কোনো সংকোচ ছাড়াই আঙুল তুলে দেন আম্পায়ার কুমার ধর্মসেনা। পরে রিভিউ নিয়েও বাঁচতে পারেননি কিউই ওপেনার। ১৮ বলে ১৯ রানে থামে তার ব্যাটিং গাড়ি। নিজের সঙ্গে শেষ করে যান রিভিউও।
প্রথম ১০ ওভারে গাপটিলের উইকেট খরচের খাতায় রেখে নিউজিল্যান্ড স্কোরবোর্ডে জমা হয় ৩৩ রান। ফলে দলের ব্যাটিং নামক ঘানি টানার জন্য এগিয়ে আসতে হয় সেই উইলিয়ামসনকেই। তিনি জানতেন, সংসার টিকিয়ে রাখতে হলে বস্তা তাকে টানতেই হবে। জানতেন বলেই ব্যক্তিগত স্কোর দুই অঙ্কে নিতে বল খেললেন ৩২টি।
কিন্তু এদিন দলকে বেশিদূর টানতে পারলেন না তিনি। এই বিশ্বকাপে দ্বিতীয়বারের মতো ৪০ রানের নিচে আউট হলেন। খোলস ছেড়ে বেরিয়ে ৩২ বলে ১০ থেকে ৫৩ বলে ৩০ রান করেন। লিয়াম প্লাঙ্কেটের বল ব্যাটের কানা স্পর্শ করে উইকেটের পেছনে জস বাটলারের হাতে ক্যাচ হন। ধর্মসেনা প্রথমে আউট না দিলেও রিভিউতে সফল হন মরগান। এই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লিগপর্বে করেছিলেন ২৭ রান।
উইলিয়ামসনের ব্যাটের সঙ্গে কথা বলছিল নিউজিল্যান্ডের স্কোরবোর্ডও। প্রথম ১০ ওভারে যেখানে আসে ৩৩ রান, সেখানে পরের ১০ ওভারে ৫৮, তাও আবার কোনো উইকেট না হারিয়ে, আর ২২তম ওভারেই তিন অঙ্ক ছুঁয়ে ফেলে কিউইরা।
তবে বড় রান না পেলেও রানের খাতা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত এক মাইলফলক অর্জন করেছেন উইলিয়ামসন। বিশ্বকাপের এক আসরে অধিনায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ রানের কীর্তি নিজের করে নেন কিউই দলনেতা। শ্রীলঙ্কার সাবেক অধিনায়ক মাহেলা জয়াবর্ধনের সঙ্গে যৌথভাবে শীর্ষে থেকে এই ম্যাচে মাঠে নেমে রেকর্ড গড়লেন তিনি। ফলে ১৯৭৫ সাল থেকে বিশ্বকাপ মাতিয়ে আসা নামজাদা সব অধিনায়কদের পেছনে ফেললেন বর্তমান ক্রিকেটের ‘ভদ্র ঘাতক’।
উইলিয়ামসন বিশ্বকাপের ৯ ইনিংসে ব্যাট করে সংগ্রহ করেছেন ৫৭৮ রান। ২০০৭ আসরে জয়াবর্ধনে ১১ ইনিংস খেলে ৬০.৮৮ গড়ে করেছিলেন ৫৪৮ রান। এই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছেন অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি রিকি পন্টিং। ২০০৭ সালে অসিদের টানা তৃতীয় শিরোপা জয়ের আসরে ৯ ইনিংসে ৬৭.৩৭ গড়ে ৫৩৯ রান করেছিলেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে ১০ ইনিংসে ৫০.৭০ গড়ে ৫০৭ রান করা অজি দলনেতা অ্যারন ফিঞ্চ আছেন চার নম্বরে।
সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ৯৫ বলে ৬৭ রানের সময়োপযোগী ইনিংস খেলেন উইলিয়ামসন। ছুঁয়ে ফেলেন লঙ্কান জয়াবর্ধনেকে। তার আগে সাউথ আফ্রিকার এবি ডি ভিলিয়ার্স (৪৮২ রান, ২০১৫ আসর), ভারতের সৌরভ গাঙ্গুলি (৪৬৫ রান, ২০০৩ আসর), শ্রীলঙ্কার কুমার সাঙ্গাকারা (৪৬৫ রান, ২০১১ আসর) ও স্বদেশী মার্টিন ক্রোর (৪৫৬ রান, ১৯৯২ আসর) মতো রথী-মহারথীদের পেছনে ফেলেন উইলিয়ামসন।
২৯ রানে প্রথম উইকেট হারানোর পর নিকোলস-উইলিয়ামসনের দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে আসে ৭৪ রান। উইলিয়ামসন ফিরলেও দলের ভরসা হয়েছিলেন নিকোলস। তুলে নেন বিশ্বকাপে প্রথম ফিফটিও। তারপরই শেষ। ৭৭ বলে ৫৫ করার পর প্নাঙ্কেটের স্টাম্পের বাইরের বল ব্যাটে টেনে আউট হন তিনি।
উইলিয়ামসন ফেরায় দায়িত্ব বর্তায় রস টেলরের কাঁধে। কিন্তু আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তের বলি হন তিনি। একপ্রান্তে ধর্মসেনার একাধিক ভুল সিদ্ধান্ত দেখতে দেখতে মারাইস ইরাসমাসও সে পথে হাঁটলেন! মার্ক উডের অফস্টাম্পের বাইরে পিচ হয়ে লেগস্টাম্পের উপর দিয়ে বের হয়ে যাওয়া বলেও এলবিডব্লিউর জন্য তর্জনী তুলে দেন সাউথ আফ্রিকা আম্পায়ার। আগেই রিভিউ শেষ হয়ে যাওয়ায় রান নেয়ার যে ছুটেছিলেন সে দৌঁড় আর থামাননি টেলরের। সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দলীয় সর্বোচ্চ ৭৪ রান করা মার্টিন ক্রো’র শিষ্য এদিন ফেরেন ১৫ রানে।
উইকেট হারানোর সঙ্গে রানের চাকাও আটকে যায় নিউজিল্যান্ডের। একটা সময় ২০ ওভার বাউন্ডারিহীন থাকে তাদের। দলের দুই গুরুত্বপূর্ণ অলরাউন্ডার জিমি নিশাম (১৯ রান ২৫ বলে) ও কলিন ডি গ্র্যান্ডহোম (১৬ রান ২৮ বলে) ভালো খেলোয়াড় হলেও বড় ম্যাচে আরও একবার ব্যর্থ। উইলিয়ামসন-টেলর নির্ভর ব্যাটিংটা শেষ দিকে যা একটু টানলেন টম ল্যাথাম। তবে হাফসেঞ্চুরি থেকে তিন রান দূরে থাকতে থামতে হয় তাকেও।
কিউইদের প্রথম সাতজন ব্যাটসম্যানের সবাই দুই অঙ্কের রান পেলেও বড় ইনিংস খেলতে না পারায় দলীয় স্কোরটাও ভালো সাস্থ্য পেল না। বিশ্বকাপে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে তাই ২৪১ রানের ভদ্রস্থ স্কোরই তাদের পুঁজি তাদের।
হিসেবি বোলিংয়ে ইংল্যান্ডের পাঁচজন বোলারই ওভারপ্রতি রান দেন পাঁচের নিচে। তিন ওভার বলে করে একমাত্র বেন স্টোকসই শুধু ওভারপ্রতি ছয় রানের বেশি দিয়েছেন। ১০ ওভারে ৪২ রান খরচায় ৩ উইকেট নিয়ে স্বাগতিকদের সফল বোলার প্লাঙ্কেট। ৯ ওভারে ৩৭ রানের বিনিময়ে তিন উইকেট পকেটে ভরেন ওকস। মার্ক উড ও আর্চার নেন একটি করে উইকেট।