উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে প্রথম দল হিসেবে টানা তৃতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইতিহাস গড়ল রিয়াল মাদ্রিদ। ‘অতিমানবীয়’ বেলের জোড়া গোলে লিভারপুলকে জিদানের দল ৩-১ ব্যবধানে হারিয়েছে। অন্য গোলটি বেনজেমার। রিয়ালের তিন গোলের দুটিতে লিভারপুল গোলরক্ষক কারিউসের হাস্যকর ভুল অনেকখানি দায়ী।
ইউক্রেনের কিয়েভে লিভারপুল এদিন ৪-৩-৩ ফর্মেশনে প্রথমার্ধে খেলা শুরু করে। রিয়াল বেলকে বসিয়ে রেখে যায় ৪-৪-২ ফর্মেশনে।
জিদানের দল প্রথমার্ধে বল দখলের লড়াইয়ে এগিয়ে থাকলেও শুরুতে লিভারপুল গতিময় ফুটবল খেলা উপহার দেয়। মোহামেদ সালাহ ইনজুরিতে পড়ে বেরিয়ে গেলে ছন্দ হারায় দলটি। ৩৫ মিনিটের পর থেকে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে রিয়াল মাদ্রিদ। খেলার গতি কমিয়ে দিয়ে ছোট-ছোট পাসে নিজেদের অর্ধ থেকে আক্রমণ গড়তে থাকে ১৬তম বারের মতো ইউরোপিয়ান কাপ/চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল খেলতে নামা দলটি। এর মধ্যে তিনটিতে হেরেছে তারা। বেনিফিকার বিপক্ষে ১৯৬২ সালে, ইন্টার মিলানের বিপক্ষে ১৯৬৪ সালে এবং এই লিভারপুলের বিপক্ষে ১৯৮১ সালে।
লিভারপুলের এটি অষ্টম ফাইনাল। তারাও হারল তিনটিতে। প্রথম হার ১৯৮৫ সালে জুভেন্টাসের বিপক্ষে। দ্বিতীয়টি ২০০৭ সালে এসি মিলানের বিপক্ষে।
বল দখলের লড়াইয়ে প্রথমার্ধে ৬৭ শতাংশ সময় রিয়ালের নিয়ন্ত্রণ ছিল। লিভারপুল ৩৩ শতাংশ। দ্বিতীয়ার্ধেও পরিসংখ্যানটা প্রায় একই রকম।
প্রথমার্ধের গুরুত্বপূর্ণ মিনিটের ধারাবর্ণনা
পঞ্চম মিনিটে মার্সেলো সালাহকে ফাউল করলে বক্সের বাদিকে কিক পায় লিভারপুল। সেটি বৃথা যায়। এরপর ১৪তম মিনিটে দারুণ একটি সুযোগ পায় লিভারপুল। বক্সের ভেতর বেশি পাস খেলতে গিয়ে সেটিও নষ্ট হয়।
পরের মিনিটে ডান উইংয়ে বল পেয়ে দ্রুত গতিতে লিভারপুলের গোলমুখে চলে আসেন রোনালদো। বক্সের বাইরে থেকে জোরালো শট নিলেও সেটি বারের উপর দিয়ে যায়।
২৩তম মিনিটে লিভারপুলের দারুণ একটি দলগত আক্রমণ নাভাসের হাতে আটকে যায়। ফিরমিনো বক্সের বাইরে থেকে কিক নিলে সেটি রিয়ালের ডিফেন্ডারের শরীরে লাগে। ফিরতি বল পেয়ে যান অ্যালেক্সান্ডার-আর্নল্ড। তিনি দূরের বারে শট নেন। ডাইভ দিয়ে বল আয়ত্তে নেন রিয়াল গোলরক্ষক নাভাস।
২৬তম মিনিটে লিভারপুলের প্রধান খেলোয়াড় সালাহ হাতে ব্যথা পান। বল দখলের লড়াইয়ে রামোস তাকে মার্কে রাখতে গিয়ে হাতের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দেন। দুজনই মাটিতে পড়ে যান। সালাহ খেলা চালিয়ে গেলেও বেশিক্ষণ মাঠে থাকতে পারেননি। খেলতে চাওয়ার অদম্য ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে ৩১তম মিনিটে তাকে মাঠ ছাড়তে হয়। বদলি হিসেবে নামেন অ্যাডাম লাল্লানা।
রিয়ালের কারাবাহালকে আবার ৩৬তম মিনিটে ইনজুরিতে পড়ে মাঠ ছাড়তে হয়। তার বদলি হিসেবে নামেন নাচো।
৪৩তম মিনিটে রিয়াল গোলমুখ খুলে ফেললেও অফসাইডের কারণে সেটি বাতিল হয়। রোনালদোর হেড লিভারপুল গোলরক্ষক প্রতিহত করেন। ফিরতি বল পান বেনজেমা। পুশ করে জালে জড়িয়ে দিয়ে উল্লাসে মাতার আগে অফসাইডের বাঁশি শুনতে পান। গোলশূন্যভাবে শেষ হয় প্রথমার্ধ।
দ্বিতীয়ার্ধ
দ্বিতীয়ার্ধে রিয়াল লিভারপুলকে তেমন কোনো সুযোগই দেয়নি। মার্সেলো মাঝমাঠ দাপিয়ে বেড়িয়ে একের পর এক বলের জোগান দিয়ে গেছেন।
দ্বিতীয়ার্ধের গুরুত্বপূর্ণ মিনিটের ধারাবর্ণনা
৪৮তম মিনিটে রিয়ালের দারুণ একটি সুযোগ বারে লেগে নষ্ট হয়। গোলরক্ষক এগিয়ে আসলে ফাঁকা বার পেয়ে যান ইসকো। সাইডভলি করেন। বল অল্পের জন্য জালের দেখা পায়নি।
এরপর সেই অদ্ভুত গোল। ৫১তম মিনিটে লিভারপুল গোলরক্ষক কারিউস বল হাতে নিয়ে ডানদিকে সতীর্থ ডিফেন্ডারকে দিতে যান। সামনে ছিলেন বেনজেমা। বল ছাড়তে দেখে ডানপা হালকা এগিয়ে দেন। বল পায়ে লেগে ধীরে ধীরে গোলসীমানা অতিক্রম করে।
৫৪তম ফিরমিনো সমতায় ফেরার সুযোগ হাতছাড়া করেন। তিনি হেড মিস করলে কর্নার পায় লিভারপুল। সেই কর্নার থেকেই ৫৫ মিনিটের সময় সমতায় ফেরে তারা।
কর্নার থেকে উড়ে আসা বলে হেড করেন লোভরেন। তখন নাভাসের সামেন ছিলেন মানে। নাভাসকে বলের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ডানপা বাড়িয়ে দেন। বল চলে যায় জালের বুকে।
৬০তম মিনিটে ইসকোর জোরালো একটি শট ডাইভ দিয়ে বেরিয়ে দেন লিভারপুল গোলরক্ষক। বক্সের বাইরে থেকে শরীর ঘুরিয়ে শট নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কারিউসকে ফাঁকি দিতে পারেননি।
পরের মিনিটে জিদান ইসকোকে উঠিয়ে বেলকে মাঠে নামান।
নেমেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে অন্যতম সেরা একটি গোল করেন বেল। ৬৪তম মিনিটে বাঁদিক থেকে মার্সেলো লম্বা একটি ক্রস পাঠান। হাওয়ায় ভাসানো বল মাটিতে নামার অপেক্ষা না করে নিজেই হাওয়ায় ভেসে যান বেল। ফুটবলের অন্যতম কঠিন শট বাইসাইকেল কিকে ব্যবধান ২-১ করেন। রোনালদোও কিছুদিন আগে এমন একটি গোল করে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিলেন।
৭০তম মিনিটে সাদিও মানে দ্বিতীয় গোলের সুযোগ হাতছাড়া করেন। বক্সের ঠিক বাইরে থেকে তার নেয়া বাঁপায়ের মাটি কামড়ানো শট বারে লেগে ফিরে আসে।
৭৪তম মিনিটে রোনালদো ব্যবধান বাড়ানোর সুযোগ নষ্ট করেন। একজন ডিফেন্ডার শরীরে লেগেছিলেন। সামনে শুধু গোলরক্ষক। রোনালদো চিপ করলেও সেটি প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের পায়ে লেগে কর্নার হয়ে যায়।
৮২তম মিনিটে কারিউস লিভারপুলকে তৃতীয় গোলের হাত থেকে বাঁচান। বেলের জোরালো পাস থেকে বেনজেমা গোলমুখে শট নেন। কোনোমতে কারিউস সেটি ফিরিয়ে দেন।
৮৩তম মিনিটে ওই কারিউস ধারাবাহিক চাপের মুখে ভেঙে পড়েন। মার্সেলোর থেকে বল পেয়ে বক্সর অনেক দূরে থেকে জোরালো শট নেন বেল। কারিউস দেখেশুনে পাঞ্চ করতে গিয়ে নিজের জালে ঠেলে দেন! বাকি সময় নিরাপদে পার করে রোনালদোরা।