তখন আমি প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত স্কুল, তারপর বিকেলে ক্রিকেট অথবা ফুটবল নিয়ে সোজা মাঠে। মাঝে মাঝে বর্ষা মৌসুমে দল বেঁধে নদীতে ঝাপাঝাপি। এই ছিল প্রতিদিনের রুটিন। সময়টা ১৯৯৭ সাল- আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির বিশ্বকাপ কোয়ালিফাইং ম্যাচে স্কটল্যান্ডের সাথে বাংলাদেশের খেলা। এই খেলায় জিতলেই বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ ম্যাচ খেলবে।
ওই সময় কোন কারণে স্কুল বন্ধ ছিল- মনে নেই। আব্বা সকাল বেলা উঠেই বলল, জমিতে জিরা সজ পাকছে, কাটতে যেতে হবে। কি আর করা। ১০ টাকা দিয়ে একটা হক ব্যাটারি কিনে বাড়িতে যে ভাঙা রেডিও ছিল তাতে ভরলাম। খেলার স্কোর জানার একমাত্র মাধ্যম বাংলাদেশে বেতার।
একটু একটু করে কাস্তে দিয়ে জিরা সজ কাটি আর পাশে রেডিও রেখে খেলা শুনি। আব্বা অবশ্য ক্রিকেট খেলা বুঝেন না; তাই তার আগ্রহ শুধু কাজ কতটুকু আগাল সেটা নিয়েই। তখন আমার আবেগ শুধু ওই খেলার দিকে, আজকে জিতলেই বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলবে। সেদিন জিতেছিল। আমার মনে আছে বাংলাদেশ জিতার সাথে সাথেই আকাশে বিমান চক্কর দিচ্ছিল। আমি তাকিয়ে ছিলাম সেই বিমানের দিকে, কারো সাথে কথা বলব সেই উপায় নেই। নিজের উপর এক পূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে বাড়ি আসলাম। বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলবে।
পরেরটা ছিল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল খেলা কেনিয়ার সাথে। আব্বাকে খেলার কথা বুঝিয়ে বলেছিলাম তাই আর সেদিন কাজে নেয়নি। ১০ টাকা আম্মার কাছ থেকে নিয়ে ব্যাটারি কিনে সোজা চলে গেলাম কলেজ মাঠে। রেডিও দেখে অনেক এসে হাজির, সবাই খেলা শুনবে। বাংলাদেশের আতঙ্ক কেনিয়া, সেই স্টিভ টিকোলো, তাকে আউট করাই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
মাঠে বসে আছি, চারপাশে শত শত মানুষ সবাই রেডিও দিয়ে খেলা শুনছে। তখন বিটিভিও সেই খেলা প্রচার করতে পারেনি। রেডিও একমাত্র ভরসা, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে ভেসে আসত চৌধুরী জাফর উল্লাহ শারাফাতের সেই বজ্র কণ্ঠস্বর। যখন কেউ চার/ছক্কা মারে সবার সে কি উল্লাস ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তারপর সেই ১ বলে ১ রান এবং বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির চ্যাম্পিয়ন!!
১৯৯৭ সাল থেকে ২০১৭, মাঝে ২০ বছর পেরিয়ে গেছে। আমি কৈশোর পার করেছি, করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলও। জীবনের সংগ্রাম, নানা ভাঙা গড়ার মধ্যে দিয়ে আমি ও বাংলাদেশ ক্রিকেট আজকে এই অবস্থানে আজকেও বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন্স।
ট্রফির সেমিফাইনাল খেলবে। আমি আমার শৈশবের মতই অধীর আগ্রহে বসে আছি, সেই আবেগ সেই অনুভুতি সেই ভালোবাসাই নিয়ে। হয়ত হেরে যাব আবার ঘুরে দাঁড়াব, হয়ত জিতে যাব উল্লাসে মেতে উঠব বয়সীন বাধায়।ক্রিকেট নিয়ে আমার আবেগ আমার সেই শৈশবের মতই দুরন্ত ও উদ্বেলিত।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)