খুরশীদ আলম। বাংলা চলচ্চিত্র ও বেতারের গানের জনপ্রিয় শিল্পী। ৫০ বছরের পেশাদার সঙ্গীত জীবনে অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান তার গলা বেয়ে নেমে এসেছে নদীর মতো। যা শ্রোতাদের হৃদয় প্লাবিত করে জমতে জমতে পরিণত হয়েছে মহাসমুদ্রে। শুক্রবার অনুষ্ঠিতব্য ১২তম চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডে আজীবন সম্মাননা পাচ্ছেন তিনি। সম্মাননা গ্রহণের আগে চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি জানিয়েছেন নিজের সঙ্গীত জীবনের পরিক্রমা, অনুভূতি এবং বর্তমান প্রজন্ম নিয়ে ভাবনা।
চ্যানেল আই অনলাইন: চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড এবং আজীবন সম্মাননা পাওয়ার বিষয়ে কিছু বলবেন?
খুরশীদ আলম: বলারতো অনেক কিছু আছে। একদম নিরেট সঙ্গীত বিষয়ক পুরস্কার বা সম্মাননার জায়গা এই প্ল্যাটফর্ম তৈরী করেছে। আজীবন সম্মাননার জন্য তারা আমাকে মনোনীত করেছে এটা আমার জন্য ভালো লাগার। আমাদের এখানে অনেক কিছুই কন্টিনিউ করে না। সেখানে ১২ বছর ধরে শুধুমাত্র সঙ্গীত বিষয়ক পুরস্কার অনুষ্ঠান চাট্টিখানি কথা নয়। আমি অনেক এক্সপেরিমেন্টাল গান করেছি। যৌথ প্রযোজনার ছবিসহ অনেক ছবিই আমার গানের জন্য হিট করেছে। বক্সার মোহাম্মদ আলী এই দেশে এলে আমি ও সৈয়দ আবদুল হাদী ভাই তার সম্মানে গান গেয়েছি। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন পুরস্কারই পাইনি। কেন পাইনি সেটি এই শিল্পে জড়িতরা বলতে পারবেন। কিন্তু মানুষের ভালোবাসা এ কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। আবার ভাবি আনোয়ার পারভেজের আমৃত্যু কষ্টবোধ নিয়ে। যিনি ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ বা ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’ এর মত গান করেও কোন পুরস্কার পাননি।
চ্যানেল আইয়ের একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি তারা সঙ্গীতকে প্রাধান্য দেয়। নজরুল উৎসব, রবীন্দ্র উৎসব নিয়মিত পালন করে। অন্যদের প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখেই বলছি, চ্যানেল আই সংস্কৃতিজনদের সত্যিকার সম্মান করে। অনুষ্ঠানের বাইরে তাদের খোঁজ রাখে। অনেকটা পরিবারের মত।
চ্যানেল আই অনলাইন: রাজ্জাক ভাইয়ের লিপে আপনার অনেক গান আছে?
খুরশীদ আলম: সে তো আছেই। কী অসাধারণ মানুষ ছিলেন। অহমিকাহীন। ১৯৬৯ সাল। ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছি। বাবুল চৌধুরীর পরিচালনায় ‘আগন্তুক’ ছবিতে প্রথম গান করি চলচ্চিত্রের। আজাদ রহমানের সুর। রাজ্জাক ভাইয়ের লিপে গান। প্রথমদিন রেকর্ড হয়নি। অন্যদের এতে মন খারপ হত। কিন্তু আমার মন খারাপ হয়নি। কারণ আমি তখন নিয়মিত বেতারে গাই। ভাবলাম চলচ্চিত্রে না হলে কি হবে। বেতারে তো গাইছি। রাজ্জাক ভাই বিষয়টি দেখে কিছুটা অবাক হয়েছিলেন। তিনি আমাকে তার বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনদিন তার বাসায় যাওয়া আসা করে কার সঙ্গে কিভাবে কথা বলেন দেখেছি।
পরে প্রযোজককে বললেন, আমার কণ্ঠে তিনি লিপসিং করবেন। এ কাজটি না করলেও হত। কিন্তু এতটাই আন্তরিক ছিলেন। গানটি হিট না হলে হয়তো আমার আর সিনেমায় গাওয়া হতো না। কারণ বলা হয়েছিল গানটি হিট করলে ১০০ টাকা সম্মানী পাব আর হিট না করলে কিছু পাব না। রাজ্জাক ভাইয়ের লিপসিং আমার গানের জনপ্রিয়তা ঠিক করে দিয়েছিল প্রায় ৭০ ভাগ। তার গান দিয়েই চলচ্চিত্রে শুরু। আর ৪২৫ টি গান করেছি চলচ্চিত্রে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তার লিপেই গেছে। পারিবারিক সম্পর্ক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সম্পর্ক ছিল। এখনও তার পরিবারের সঙ্গে আছি। খুব খেয়াল আছে ‘চাপাডাঙ্গার বউ’ চলচ্চিত্রের শুটিংয়ে যখন গেলাম তখন বাপ্পারাজকে বলেছিলেন, চাচাকে সালাম কর। এ ঘটনা কখনও ভুলবনা।
চ্যানেল আই অনলাইন: আপনার গান অধিকাংশই দ্রুত লয়ের?
খুরশীদ আলম: শ্রোতারা আমার এ ধরণকে গ্রহণ করেছিল বলে সঙ্গীত পরিচালকরা হয়ত মনে করতেন আমাকে দিয়ে এ গানই করানো উচিত। এ জীবনে ৮-১০টি গান হয়ত ধীর লয়ে করেছি। বাকি সবই দ্রুত লয়ের। ‘চঞ্চল দুনয়নে বল না কী খুঁজছ’ আমাকে এতটাই জনপ্রিয়তা দেয় যে এরপর এই ধরণের গানই এসেছে। শ্রদ্ধেয় আলম ভাইয়ের সুরে ‘তবলার ধেরে কেটে তাক/আজকাল হয়ে গেছে সব বরবাদ’, ‘মিন্টু আমার নাম’ ছবিতে ‘আজকে না হয় ভালোবাসো’ অথবা দোস্ত দুশমন’ চলচ্চিত্রে ‘চুমকি চলেছে একা পথে’ অথবা ‘চুপি চুপি বলো কেউ জেনে যাবে’। কোনটা রেখে কোনটা বলব?’।
চ্যানেল আই অনলাইন: ৭৩ চলছে। এখনও সমান সক্রিয় গানে!
খুরশীদ আলম: গানকে আমি ভালোবাসি। অন্তর দিয়ে গান গাইব বলে বিমানের লোভনীয় চাকরির সুযোগ ছেড়েছি। কারণ চাকরির সময় শর্ত ছিল সেখানে চাকরি করলে অন্য কোথাও কিছু করা যাবে না। নিজেকে দেখানো যাবে না। বিসিআইসিতে ঢুকি। সেখানে গানে নিষেধ ছিল না। তবে অফিসকে ঠকাইনি। ছুটির দিনগুলোতে বাইরে শো করেছি। আর অফিস ঠিক রেখে গান করেছি। আমি এখনও প্রচুর গান শুনি। নতুনে এবং পুরাতন সব ধরণের গান। নিয়মমাফিক রেওয়াজ করি। টেলিভিশনে মিউজিকাল প্রোগ্রামগুলো দেখি। এখনও যেকোন গান গাওয়ার আগে আগের মতই উত্তেজনা বোধ করি। নির্দিষ্ট সময়ের আগে পৌঁছে যাই। একটি ব্যাপারে খুব গর্ব করে বলতে পারি, কোন সুরকার-গীতিকার-পরিচালক-প্রযোজক কেউ বলতে পারবেন না, আমি তাকে কষ্ট দিয়েছি।
চ্যানেল আই অনলাইন: সেই সময়-এই সময় কিংবা নতুন প্রজন্ম প্রসঙ্গে?
খুরশীদ আলম: একদম মন থেকে বলছি এ সময়ের ছেলেমেয়েরা দারুণ মেধাবী এবং বুদ্ধিদীপ্ত। বিশ্বাস করি, নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে আমার অনেক কিছু শেখার আছে। তবে সমস্যা একটা মনে হয়েছে দ্রুত প্রাপ্তির স্বপ্ন। আমাদের সময়টি আসলেই অন্যরকম রকম ছিল। প্রযুক্তি বা মাধ্যমের স্বল্পতাও বড় কারণ হতে পারে। কিন্তু একটা বিষয় নিখাঁদ ছিল তা হল গানের প্রতি ভালোবাসা। নিছক অর্থের জন্য আমরা গান করিনি। গাইতে গাইতে অর্থ এসেছে।
মনে পড়ে, ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এর মত গীতিকবি কোন শব্দ নিয়ে আপত্তি উঠলে ১০টি বিকল্প শব্দ লিখে দিতেন। আর এখন যা আছে সেটিই ঠিক করে নিতে হয়। জগন্নাথ কলেজে আমার রবীন্দ্রসংগীত শুনে অজিত গুহ স্যার বলেছিলেন,‘বাবা, তুমি কোথায় থাকো?’ জানাতেই বললেন, ‘আমি এই কলেজের বাংলার অধ্যাপক। শাঁখারীবাজারে থাকি। আমার বাসায় এসো, উচ্চারণ শেখাব।’ সেই মমতা এখন পাওয়া ভার। ১৯৬৬ সালে বেতার অডিশন দিতে গেছি। সমর দাশ ছিলেন। তিনি গান শুনে জানালেন, আমি একজনকে অনুসরণ করি। স্বীকার করে নিলাম। তিনি বাসায় যেতে বললেন। ৬ মাস কেবল ‘সা’ তুলিয়েছেন গলায়। আর এখন ট্র্যাকে গলা তুলে দিয়ে শেষ। বেসুরো হলে যন্ত্র তো আছেই!
চ্যানেল আই অনলাইন: পারিবারিক জীবন কেমন চলছে?
খুরশীদ আলম: দুই মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে সুখের সংসার। ১৯৭৪ সালে রীনা আলমের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। সে গৃহিণী। বড় মেয়ে মেহরীন আলম এমবিএ করেছে এবং ছোট মেয়ে মিনহাজ আলম ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে মাস্টার্স। দুজনেই চাকরি করে।
চ্যানেল আই অনলাইন: নিজের গাওয়া প্রিয় ১০ গান?
খুরশীদ আলম: খুব কঠিন। সব গাওয়া গানই আমার প্রিয়। তারপর ক্রম সাজালে হবে- ও দুটি নয়নে স্বপনে চয়নে নিজেরে যে ভুলে যায় (অশ্রু দিয়ে লেখা), বাপের চোখের মনি নয় মায়ের সোনার খনি নয়/ ভাইয়ের আদরের ছোট বোন (জোকার), তোমরা যারা আজ আমাদের ভাবছো মানুষ কিনা (লালু ভুলু), বন্দী পাখির মত মনটা কেঁদে মরে ( আগন্তুক), তোমার দুহাত ধরে শপথ নিলাম/ তোমায় আমি কথা দিলাম (আধুনিক), চুমকি চলেছে একা পথে/ সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে (দোস্ত দুশমন), এ আকাশকে সাক্ষী রেখে/ এ বাতাসকে সাক্ষী রেখে (সোহাগ), মাগো মা, ওগো মা/আমারে বানাইলি তুই দিওয়ানা (সমাধি), ধীরে ধীরে চল ঘোড়া/সাথী বড় আনকোরা (শাপমুক্তি) এবং যে সাগর দেখে তৃপ্ত দু চোখ (আধুনিক)।
খুরশীদ আলম ১৯৪৬ সালে জয়পুরহাট জেলার কালাই থানার হারুনজাও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা এ এফ তসলিম উদ্দিন আহমেদ, মা মেহেরুন্নেসা খানম।তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। পুরান ঢাকার কাজি আলাউদ্দিন রোডের নাজিরাবাজারে যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠেছেন তিনি। তার চাচা ঢাকা ডেন্টাল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ডা. আবু হায়দার সাইদুর রহমান এর কাছে সঙ্গীতে হাতেখড়ি। দাদা জসিম উদ্দিন আহমেদের প্রতিষ্ঠিত আজিমপুরের ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলে এক বছর পড়াশোনা। কাপ্তানবাজারের নবাবপুর হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক। কলেজ অব মিউজিক থেকে প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে ইন্টারমিডিয়েট। জগন্নাথ কলেজ থেকে ডিগ্রি।