পহেলা অক্টোবর চ্যানেল আই সম্প্রচারের ১৮ বছর পূর্ণ করে ১৯তম বছরে পদার্পণ করছে। এই দিনে চ্যানেল আই-এর সাংবাদিক, প্রযোজক-উপস্থাপক, পরিচালক, শুটিং এবং এডিটিং ক্রুসহ সম্প্রচারে সম্পৃক্ত সকলে এই অর্জনে গর্ববোধ করতে পারেন। ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী এলাকার একটি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে যাত্রা শুরু করে ফরিদুর রেজা সাগর, শাইখ সিরাজ এবং তাদের আরও ছয় বন্ধু-সহযোগীর নেতৃত্বে নিবেদিত কর্মীরা চ্যানেলকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, যেমন প্রশংসা পেয়েছেন তেমন বাণিজ্যিক সাফল্যও পেয়েছেন।
চ্যানেল আই-এর যাত্রা যে একেবারে সহজ হয়েছে, তা বলা ঠিক হবে না। বিশেষ করে যেহেতু বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থাসহ নানা ধরণের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে। একের পর এক নতুন টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচার শুরু করেছে, মিডিয়া বাজারে প্রতিযোগিতা বছরে বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রশিক্ষিত জনবল খুঁজে পাওয়া এবং বাণিজ্যিক রেভেনিউ বৃদ্ধি করার মত বড় চ্যালেঞ্জ তাদের মোকাবেলা করতে হয়েছে। স্যাটেলাইট চ্যানেল যেহেতু ক্যাবলের মাধ্যমে পরিবেশন করা হচ্ছিল, অবকাঠামোও তাদের জন্য একটি চিন্তার বিষয় ছিল।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাসের ফলে তৃতীয় সংবাদ, বিশেষ করে রাজনৈতিক সংবাদের প্রতি দেশের মানুষের ঝোঁক বরাবরই লক্ষ করা গেছে। চ্যানেল আই যদিও প্রথম দিকে সাংস্কৃতিক এবং বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের দিকেই মনোযোগ দিয়েছিল, কিন্তু সম্প্রচার শুরুর দুই বছরের মাথায় তারা সংবাদ বুলেটিন শুরু করে। এই সময়ে বাংলাদেশ সরকার টেলিভিশনে সংবাদের ওপর রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত বিটিভির একছত্র কর্তৃত্ব ভেঙ্গে দিয়েছিল। টেলিভিশনে সংবাদ সম্প্রচারে চ্যানেল আই বাংলাদেশের দ্বিতীয় ব্যক্তি মালিকানাধীন চ্যানেল।
তবে যে অনুষ্ঠান চ্যানেল আইকে অন্যান্য চ্যানেল থেকে আলাদা করে দেয়, সেটা ছিল ‘তৃতীয় মাত্রা’। এই অনুষ্ঠান বাংলাদেশে প্রথম বারের মত প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের নেতাদের মুখোমুখি নিয়ে আসে। অনেক সময় বলা হয়, বাংলাদেশিরা রাজনৈতিক সংবাদ এবং বিতর্কের প্রতি রীতিমত আসক্ত, এবং ‘তৃতীয় মাত্রা’ টেলিভিশনে রাজনৈতিক সংবাদ এবং মতামত প্রচারের ক্ষেত্রে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। প্রথমবারের মত, বাংলাদেশি দর্শকরা দেখলেন কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক নেতাদের একই টেবিলে বসে এক অপরের সাথে আলাপ, তর্ক এমনকি বিতণ্ডা করতে।মাত্রার পথ অনুসরণ করে অনেক চ্যানেলেই রাজনৈতিক টক শো এখন একটি স্থায়ী এবং জনপ্রিয় স্থান করে নিয়েছে।
বছর দুয়েক আগে, বাংলাদেশে বিবিসি একটি গুণাত্মক গবেষণা চালায়, যেখানে কিছু চোখে পড়ার মত ফল বেরিয়ে আসে। গবেষণায় অংশগগ্রণকারী ফোকাস গ্রুপের সদস্যদের যখন জিজ্ঞেস করা হয়, তারা কোন জিনিসকে চ্যানেল আই-এর সাথে সম্পৃক্ত করে, তখন যে দুটি নাম শীর্ষে আসে সেগুলো ছিল শাইখ সিরাজ এবং কৃষকদের নিয়ে অনুষ্ঠান হৃদয়ে মাটি ও মানুষ। শাইখ সিরাজ তের বছর ধরে প্রচারিত এই অনুষ্ঠানের প্রযোজক এবং উপস্থাপক। এই অনুষ্ঠান দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কৃষকদের সাফল্যের কথা এবং কৃষিখাতের সমস্যা-সম্ভাবনার বিভিন্ন দিক দর্শকদের কাছে তুলে ধরে।
তবে গত ১৮ বছরে চ্যানেল আই বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় স্যাটেলাইট চ্যানেল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি বিবিসির জন্য পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, দর্শকের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে চ্যানেল আই এখন বাংলাদেশের শীর্ষ চ্যানেল।
আঠারো বছর আগে চ্যানেল আই ছিল দু’একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন টেলিভিশন স্টেশনের মধ্যে একটি। এই শতাব্দীর প্রথম দশকে ব্যক্তি মালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে, এবং গত দশ বছরে এই পরিবর্তন নতুন মাত্রা এবং গতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশে এখন ৪০টির মত টেলিভিশন চ্যানেলকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে, যার বেশির ভাগ ইতোমধ্যেই সম্প্রচার শুরু করেছে।
চ্যানেলগুলোর মধ্যে অন্তত সাতটি ২৪-ঘণ্টার নিউজ চ্যানেল, যাদের নিজস্ব প্রযোজনায় টক-শো, নিয়মিত ফিচার এবং ডকুমেন্টারি রয়েছে। প্রশিক্ষিত জনবল এবং সর্বাধুনিক সম্প্রচার ও ডিজিটাল প্রযুক্তি অধিগম্য হওয়ায় সম্প্রচারের মান উন্নত হচ্ছে। আধুনিক স্টুডিও নির্মাণ এবং কর্মীদের উন্নত প্রশিক্ষণ দিতে নতুন চ্যানেলগুলোর মধ্যে আগ্রহের অভাব নেই।
শুরু থেকেই পেশাদারিত্বের জন্য চ্যানেল আই-এর একটি সুখ্যাতি ছিল, যেটা সময়ের সাথে আরো শক্তিশালী হয়েছে। সে কারণে বিবিসি তাদের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য চ্যানেল আইকে সহযোগী হিসেবে বেছে নিয়েছে।
চ্যানেল আই-এর সাথে বিবিসির সহযোগিতা শুরু হয় ২০০৫ সালে। বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ট্রাস্ট নামে বিবিসির যে দাতব্য সংস্থা ছিল (পরবর্তীতে যার নাম বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশন করা হয়), সেটা বিবিসি বাংলার সঙ্গে যৌথভাবে ‘বিবিসি বাংলাদেশ সংলাপ’ নামে আট পর্বের একটি আলোচনা অনুষ্ঠান তৈরি করে। ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ট্রাস্ট, চ্যানেল আই-এর সাথে অনুষ্ঠানমালা ধারণ এবং সম্প্রচার করার জন্য চুক্তি করে।
বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস-এর সাথে চ্যানেল আই-এর সহযোগিতা ১২ বছর ধরে চলেছে, যেটাকে অত্যন্ত ফলপ্রসূ এবং উৎসাহব্যঞ্জক বলা চলে। এই সহযোগিতার পরিধি বছরের পর বছর সম্প্রসারিত হবার পেছনে চ্যানেল আই-এর পরিচালকমণ্ডলী থেকে তার শুটিং ক্রু এবং অন্যান্য কর্মীদের আন্তরিকতা বড় ভূমিকা পালন করেছে। বিবিসি সব সময়েই চ্যানেল আই-এর সাথে তার সহযোগিতার সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এই গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছিল ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে, যখন বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস-এর পরিচালক ফ্র্যান আন্সওর্থ একটি নতুন যৌথ প্রযোজনার অনুষ্ঠান নিয়ে চুক্তি সই করতে চ্যানেল আই ভবনে আসেন। সে সময়ে ফ্র্যান আন্সওর্থ চ্যানেল আই-এর ওয়েবসাইট আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।
পারস্পরিক সম্মান এবং একে অপরের মূল্যবোধের প্রতি সহানুভূতির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে বিবিসি এবং চ্যানেল আই-এর মধ্যে এই সম্পর্ক। চ্যানেল আই সব সময় নিজের আউটপুটের ওপর বিবিসির সম্পাদকীয় কর্তৃত্বকে সম্মান করেছে এবং বিবিসির কাজ সফল করতে সকল প্রকার কারিগরি এবং অবকাঠামোগত সহায়তা দিয়েছে। অন্যদিকে বিবিসি চ্যানেল আই-এর দর্শকদের প্রত্যাশা এবং চ্যানেলটি যে সমাজে সম্প্রচার করে তার সংবেদনশীলতা আমলে নিয়েই কাজ করে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)