‘সমাবেশে মহিলা এবং পুরুষদের বসার জায়গা ছিল আলাদা। আমি আইভি আন্টির (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী) পাশেই ছিলাম। হঠাৎ ২০-২২ বছরের একটি ছেড়ে গা ঘেঁসে আমাদের পাশে চলে আসলো। কেন মহিলাদের পাশে, জানতে চাইলে সেই ছেলেটি বললো আমাকে র্যাব পাঠিয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই দেখি ছেলেটি আর নেই। এর পর এক মিনিটও যেতে পারেনি। এমন সময়ই বিকট শব্দে গ্রেনেডের বিস্ফোরণ। আইভি আন্টি আর আমি দুজনেই পড়ে গেলাম। পড়ে গিয়েই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।’
২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার সেই ভয়াল স্মৃতির বর্ণনা দিচ্ছিলেন সারা শরীরে গ্রেনেডের অসংখ্য স্প্রিন্টার বয়ে বেড়ানো ঢাকা মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহি সদস্য রাশিদা আক্তার রুমা। কথাগুলো বলতে বলতে চোখের কোণ গড়িয়ে জল বেরিয়ে আসছিল তার। ধরে আসছিল গলা।
২০০৪ সালের সে হামলায় প্রাণ হারান আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন, আহত হন কয়েকশ মানুষ। সেদিন বেঁচে গেলেও স্থায়ীভাবে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
সোমবার ওই ন্যাক্কারজনক হামলার ১৩তম বর্ষপূর্তিতে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে এসেছিলেন রুমা। তখন সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বর্ণনা দেন সেই বিভীষিকাময় ঘটনার। সে ঘটনার শিকার হয়ে তাকে অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছে ১৭ বার। ১৩ বছর পরে সেই জায়গায় এসে নিজেকে আর যেন ধরে রাখতে পারছিলেন না। বারবার ভেঙ্গে পড়ছিলেন কান্নায়।
চোখের কোণে জল নিয়ে রুমা বলে যাচ্ছিলেন বলেন, মানুষের আর্ত চিৎকার আর চেঁচামেচিতে কিছুক্ষণ পর আমার জ্ঞান ফেরে। চোখ খুলে দেখি চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ। আইভি আন্টি আমার পাশে পড়ে আছেন। ট্রাকের দিকে তাকিয়ে দেখি আপা(শেখ হাসিনা) নেই। আমার শঙ্কা হয়েছিল, আপা বোধ হয় শেষ হয়ে গেছেন। তারপর কোন মতে একজনকে ডাকলাম, আমাকে একটু ধরেন। তারপর আবারও আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
রুমা আরও জানান, মৃত ভেবে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাশের সঙ্গে ফেলে রাখা হয়েছিল।তখন মীরপুরের চায়না নামের একটি মেয়ে ডাক্তারদের বলে ভাইয়া ইনিতো জীবিত। তখন আমাকে বাংলাদেশ মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়।সেখান থেকে ডাক্তাররা আমার পা কেটে ফেলতে চাইলে জাহাঙ্গীর নামের একজন কথায় আর পা কাটতে পারেনি।তাকে ১৭ বার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয় বলেও জানান তিনি।
গ্রেনেড বিস্ফোরণের পর সেদিনের পরিস্থিতি কেমন ছিল তা প্রত্যক্ষ করেছেন মোঃ ইনসুর আলী। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের এ সাধারণ সম্পাদক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আমরা ব্যানার নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়। মানুষ যে যার জীবন নিয়ে ছুটছিল। এমন ভয়াবহ অবস্থার কথা আগে থেকে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
আহত মানুষদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে চাইলেও পুলিশ সেদিন বাধা দিয়েছিল বলে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ শ্রমিক পরিবহন শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আর এ মান্নান।
২১ আগস্টের সমাবেশস্থলে উপস্থিত এ প্রত্যক্ষদর্শী চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আমরা যারা দূরে ছিলাম তাদের অনেকেই আহত হননি বা কম আহত হয়েছেন। কিন্তু আহত মানুষকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য এগিয়ে এল পুলিশ আমাদের লাঠি চার্জ করে, কাঁদনে গ্যাসও ছোঁড়ে।
সেদিনের ঘটনায় যারা নিহত ও আহত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাদের নিয়মীত খোঁজ খবর রাখা হচ্ছে বলে দাবি রুমার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে পাঁচবার বিদেশী পাঠিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শী এই তিনজনের দাবিই এক; যতদ্রুত সম্ভব ওই হামলার ঘটনায় চলমান বিচার সম্পন্ন করা। তাদের আশা; বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেহেতু হয়েছে ২১ আগস্টের ঘটনার বিচাও দ্রুত সম্পন্ন হবে।
সোমবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গিয়ে দেখা যায় পুরো এলাকা নিরাপত্তার বেষ্টনিতে। দলীয় নেতাকর্মীরা তেমন কেউ আসেননি। সহযোগী সংগঠনগুলোর কয়েকজন এসেছিলেন। তারা জানালেন বন্যা এবং নিরাপত্তার কথা ভেবে এখানে কোন কর্মসূচি রাখা হয়নি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। তবে বিভিন্ন জায়গায় কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে দলের পক্ষ থেকে।