মাহবুবুল হক শাকিলকে আমি জানি মুখরোচক চর্চার বাইরে, সমাজকে নিয়ে অনেক বিকশিত ভাবনায় ভরা, পঞ্চাশের কম বয়সের এক আশ্চর্য কবি হিসেবে, যাকে আমরা অকালে হারিয়েছি।
দুপুর বেলা যখন খবরটি পাই তখন আমার কন্যাকে তুলতে গেছি ধানমন্ডির স্কুল থেকে। এর পর থেকে বানের মতো মুঠোফোনে ক্ষুদে বার্তা আসতে লাগলো। মনে পড়লো, এইতো কিছুদিন আগে গুলশানে, তার প্রিয় সামদাদুতেই আমরা রাত ৯টা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত কাটিয়ে দিয়েছিলাম কথা বলে বলে। আরো কত আড্ডা, আরো কত আসর, তার লেখা কত কবিতা আর গল্প শোনা, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার আবেগ ভরা কণ্ঠের বক্তৃতার কথা মনে পড়ছিল আর ছুটছিলাম গুলশান পানে।
ফ্ল্যাশব্যাক অন করে দেখলে মনে পড়ছে, শাকিলকে দেখি প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। আমার স্ত্রীর ব্যাচমেট ছেলেটি ছাত্রলীগের মিছিলের অগ্রভাগে, কখনো হাকিমে, কখনো মধুর ক্যান্টিনে। তবে তার সাথে আড্ডা জমতে থাকে পেশাগত জীবনেই। রাজনীতির বাইরে এসে পেশাজীবনের এসব আড্ডায়ও তার সেই চিরাচরিত চশমা, যে চোখ জুড়ে আন্তরিকতা আর মেধা ঝিকমিক করতো। শাকিল চলে যাওয়ার পর মাঝে মাঝেই নিজেকে প্রশ্ন করি, শহরে শহরে, অলিতে-গলিতে যারা লেখালেখি করে, গানের চর্চা করে, আড্ডা দেয়, একে অন্যের সাথে ভাবের আদান প্রদান করে তারা আসলে কেমন হয়? চারপাশের মানুষ থেকে আলাদা হয়ে এরা নিজেদের আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠে? মাঝ থেকে হুট করে যদি কেউ হারিয়ে যায়, তখন অন্যদের কেমন লাগে?
লেখক ও কবিদের আড্ডায় তাকে পেয়েছি। কোন ক্লাবে, কারো অফিসে বা বাড়িতে। আমাদের এসব আড্ডায় কত বিপ্লব হয়ে গেছে। শাকিলের সাথে আড্ডায় কবিতা, গান নিয়েই কথা হতো বেশি। এর মাঝেই যেন জীবনের সন্ধান ছিল। এখনো আমাদের আড্ডা হয়। শুধু একজন নেই এখন। হারিয়ে গেছে দূরের আকাশে। গান আর কবিতা, কিংবা নিজের লেখা ছোটগল্পের মাতামাতি আর আমি কোনদিন দেখবো না।
শাকিল প্রধানমন্ত্রীর দফতরের বড় কর্তা ছিল। সিরিয়াস ধরণের কাজ ছিল তার। কিন্তু দেখেছি সিনেমা, থিয়েটার, কবিতা, গল্প নিয়ে কথা বলার সময় সে এক অন্য মানুষ। তার মনের গভীরে এক ছেলেমানুষ লুকিয়ে থাকত, যা খুব বেশি লুকিয়ে রাখতে পারতোনা ও। এই বাচ্চা স্বভাবের মানুষটিই আবার অক্লেশে, অনায়াসে সাহিত্য নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে পারতো।
শাকিল কবিতা লিখতো। কবিতার বইও ছিল। কিন্তু তার দু’একটি ছোট গল্প আমার কাছে মনে হয়েছে কবিতা থেকেও উৎকৃষ্ট। আর ফেসবুকে দেয়া তার অনেকগুলো কবিতা দেখে মনে হয়েছে সে জীবনটাকেই কাব্যময় করে রেখেছিল। সারাজীবন নিষ্ঠা আর আস্থার সাথে হয়তো কবিতা লেখেনি। বিলম্বে শুরু করেও তার চেষ্টায় কোনো খাদ ছিলো না। যেসব সংবেদনশীল পাঠক তার কবিতার গভীরে যেতে পেরেছে তারা তার রচনার প্রতি অলঙ্ঘনীয় আকর্ষণ অনুভব করেছে। মৃত্যুর কথা অনেকবার এসেছে। ব্যক্তিমনের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন কবিতাতেই বেশি প্রতিফলিত হয়। তার নিজস্ব সামাজিক প্রেক্ষাপট কি ছিল সেটা কেবল তারই জানা।
সাহিত্যিক বিবেচনায় কবি শাকিলকে বিবেচনা করতে হবে সচেতনতা বোধ দিয়ে। আমাদের পারিপার্শ্বিক ঘটনার প্রাবল্য, বিশেষ করে রাজনৈতিক বাস্তবতা তার কবিতায় এবং সাম্প্রতিককালে তার গল্পে সে ধরতে চেষ্টা করেছে। তাই হলি আর্টিজনের জঙ্গি হামলাই হয়ে যায় তার গল্পের প্লট। সচেতনভাবে একটা সামগ্রিক ভাবের প্রকাশের দিকে নিবেদিত লেখক হারিয়ে গেল সবকিছুকে বিক্ষিপ্ত করে। যার ভেতর প্রেম আছে, আবার সমাজের জন্য চেতনা আছে, সেইসব কবি যেমন রবীন্দ্রবলয়ে বিচরণ করে, তেমনি জীবনানন্দেরও অনুসারী হয়ে উঠে আবার অনায়াসে আবৃত্তি করে যেতে পারতো বিনয় মজুমদার। কিন্তু গল্পের লেখকতো দেখছিলাম একদম অন্যরকম করে নিজেকে মাত্র প্রকাশ করতে শুরু করেছিল। কোন নির্দিষ্ট স্টাইলের অনুকরণ নয়, অনিবার্যভাবে নিজের মতো করে।
ভাষার দক্ষ ব্যবহার, তীব্রবোধগ্রস্ত চিত্রকল্প, ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রবল প্রকাশ, বিপুল অনিশ্চয়তা এবং তার চেয়েও বেশি বিপুল ভালবাসার অনুসন্ধান- এসব মিলিয়েই এক সৃষ্টিশীলতা থেমে গেলো মাঝপথে। এই একটু আসছি বলে কোথায় যে গেল? যারা তাকে ভালবাসতো, কাছ থেকে দেখেছে তারা আবার বুক ভরে অক্সিজেন নিক, যেন তারা হারিয়ে যাওয়া মানুষটার মনের আলোয় পথ চলতে পারে।
একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যখন আমরা যাই, অনেকে কাজ করে। অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। জীবন তো প্রায় ট্রেনের মতোই। কামরায় কেউ উঠে, কেউ নেমে যায়। লেখালেখি অনেকেই করে, কিন্তু ক’জন সাহিত্যিক হয়? আমি সামান্য একজন হয়েও বলতে পারি, লেখালেখির সূত্রে যে কয়জনকে দেখেছি, শাকিল একজন অসামান্য লেখক হয়ে উঠছিল কেবল। মানবসম্পর্কের গূঢ় অতলস্পর্শী রহস্যময় জীবনধারা, মানুষের আবেগ ও আর্তনাদ তুলে আনতে শুরু করেছিল কেবল। শাকিল হয়তো আকাশের তারা হয়ে আমাদের দেখছে। দেখছে এই ধোয়া-ধুলো-কাদা-আনন্দ-হাসি-প্রেম-বেদনা-অভিমান আর হিংসাভরা আমাদের এই সময়কে। সে দেখতেই থাকবে আমাদের কাছে অমর হয়ে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)