অন্ধকার রাত, আকাশে ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বাতাসে গাছের পাতা, পুরোনো কাগজ উড়ছে, রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। এমন সময় একটি মেয়ে কাপড় সামলাতে সামলাতে একা হেঁটে আসছে। কয়েকটি ছেলে একসাথে ছিল, ওরা মেয়েটিকে চকচকে চোখে দেখল… সিনেমা অথবা নাটকের এই মুহূর্তে যে কারো বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হয়ে যায়। কি ভেবে? ইস! মেয়েটাকে ছেলেগুলো কী না কী করবে এখন! এরকম ভাবার কারণ কি? কারণ, এরকম আগেও দেখেছি। কেন ধর্ষণের মতো ভয়াবহ একটি বিষয়কে এতো সহজে দেখানো হবে!
আমার এক বন্ধু একবার ইনবক্সে একটা ভিডিও পাঠিয়েছিল। একা একটি মেয়ে রাতে গাড়ি চালিয়ে ঘরে ফিরছে। রাস্তায় হঠাৎ করেই গাড়িটা বিগড়ে গেল। কয়েকটি ছেলে ওকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো। মেয়েটি অন্যদিকে তাকালেই ওরা একে অপরকে ইশারা করছে ইনিশিয়েটিভ নিতে। কিন্তু মেয়েটা এতো সহজ সরল ভাবে ওদের সাথে কথা বলছিল যে, ছেলেগুলো শেষমেশ কুচিন্তা ছেড়ে মেয়েটিকে গাড়ি ঠিক করে বাড়ি অব্দি নিরাপদে পৌঁছে দেয়। পুরো ভিডিওটা আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখেছি! এরকম একটা ভাব, হায় হায়, না জানি কী হবে! এটাও অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ভয়।
নায়ক সৎ পুলিশ অফিসার। গুণ্ডা-বদমাশেরা ওর জ্বালায় এলাকায় টিকে থাকতে পারছেনা। নায়কের যদি তরুণী বোন অথবা স্ত্রী থাকে, খারাপ লোকগুলো প্রতিশোধটা কিভাবে নেবে বলুন তো? আমিই বলছি, বোন অথবা স্ত্রী হবে ওদের শিকার। ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছাতে এই সিনেমায় ধর্ষণ কিংবা কাছাকাছি কিছু ছাড়া গতি নেই। অবধারিতভাবে এই বিষয়গুলো বারবার একইরকম করে ঘটতে থাকে।
নাটক বা সিনেমা জীবনের বাইরের কিছুনা। আমাদের সিনেমায় চুমুর দৃশ্য দেখানো নিষেধ, কিন্তু ধর্ষণটা একেবারেই ডালভাত। এসব নিয়মিত দেখে দেখে কি আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি! সিনেমার নায়ক নায়িকাদের হেয়ার স্টাইল, ফ্যাশন, ডায়ালগ সবই আমরা ফলো করলে, রাস্তায় একা একটি মেয়েকে দেখে রংবাজ রোমিওদের মনে কি মেয়েটিকে কিছু না বলে ছেড়ে দেওয়ার কথা আসবে? সহজে আসবেনা। ধর্ষণ না করলেও ইভ টিজিং করার সুযোগ এরা ছাড়বেনা।
আমি মন্ট্রিয়ালে কাজ করার সময়ে কাজ শেষে সকালের প্রথম মেট্রো নিয়ে ঘরে ফিরতাম। ভোর সাড়ে পাঁচটায় মেট্রো চালু হয়, একদিন ভুলে রাত সোয়া চারটায় লাকাডি মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি দরজা খোলেনি, সেখান থেকে অন্ধকার গলিঘুঁজি ঘুরে পার্ক মেট্রোতে হেঁটে গিয়েছি। কই আমার তো একটুও ভয় করেনি! অথচ দেশে থাকলে সন্ধ্যা বেলায় নিজের শহরে চেনা রাস্তাতেও নিজেকে অনিরাপদ মনে হয় কেন!
আমি জানিনা আমাদের সাবকন্টিনেন্টে আগেও এই পরিমাণ ধর্ষণ হতো কিনা। আজকাল প্রায়ই শিশুরা এর শিকার হচ্ছে। নতুন সংযোজন, অন্যের সন্তান নয় নিজের স্ত্রীর আগের দিকের সন্তান। আট আটটি বছর ধরে এক লোক স্ত্রীর আগের পক্ষের মেয়েটির সাথে যৌন নিগ্রহ চালিয়ে গেছে। আচ্ছা, মেয়েটি কি ওই লোকটিকে বাবা বলে ডাকতো! নিজের মা সব জেনেশুনেও কেন প্রতিবাদ করেনি! একজন দেহোপজীবিনী নারীও তো নিজের কন্যাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন! এ কেমন মা! মেয়েটি গর্ভবতী হলে গর্ভপাত ঘটানো হয়েছে। এই মহিলা কিভাবে এটা মেনে নিয়েছিল! মেয়েটাও কেন মুখ খোলেনি! ওদের কি আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কেউ নেই! মেয়েটির ছবি, ভিডিও এসব করে ওই অমানুষটা মেয়েটিকে বাধ্য করেছে শুতে।
আমি একটা বিষয় বুঝিনা, নগ্ন ছবি বাইরের লোকে দেখলে “ইজ্জত” চলে যাবে, এই ভয়ে বছরের পর বছর এই ধরনের ব্ল্যাকমেইলিং কিভাবে সহ্য করে মানুষ! এই মেয়েটির মা-ও ওই অসভ্য লোকটির চেয়ে কম দোষী নয়। এদের কঠিন বিচার হওয়া উচিত। অন্যায় যে করে আর সেই অন্যায়কে যে প্রশ্রয় দেয় সেও সমান অপরাধী। ধর্ষণের শাস্তি চাওয়ার আগে ধর্ষণ রোধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এই অমানবিকতা রোধ করতে, সোচ্চার হতে হবে। এভাবে আর কতো!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)