দেশে দেশে ভাস্কর্য স্থাপন এবং অপসারণ, দুটোই প্রচলিত ঘটনা। স্থান কাল ভেদে এই স্থাপন, অপসারণ বা প্রতিস্থাপন নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে কথা আছে এবং থাকবেও। উন্নত বিশ্বে এ ধরনের বিতর্ক নাগরিকদের ‘শিল্পবোধের’ সাথে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন তর্ক শৈল্পিকবোধ বিবেচনা থেকে অনেক বেশি রাজনীতি সংশ্লিষ্ট। সংবাদপত্র, বিশেষ করে ফেসবুকের পাতা খুললে মনে হয় যেন সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে স্থাপিত গ্রীক দেবীর ওই ভাস্কর্যটির বেদীমূলে আমাদের স্বাধীনতার সকল চেতনাটুকু লুকানো ছিলো! ওটা সরানোর সাথে সাথেই আমরা পরাধীন হয়ে পড়েছি! আমাদের বাঙ্গালী-মানস সহজে বড়ই আবেগ-কাতর হয়ে পড়ে!
ভাস্কর্য সরানো অবশ্যই একটি অনগ্রসর কাজ। তার উপরে মৌলবাদীদের দাবির মুখে এই অপকর্মটি করা হলো। অপসারণ সিদ্ধান্ত সরকার নিলো নাকি সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃপক্ষ নিলো, তা নিয়েও তর্কের শেষ নেই। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ছোট-বড়-মাঝারি সব সরকারি (বা দলীয়) সিদ্ধান্তই যেহেতু প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক, তাই শেখ হাসিনা এই ভাস্কর্য অপসারণের ‘প্রাইম রেসপন্সিবিলিটি’ এড়াতে পারেন না। অগ্রসরমান আধুনিকতাকে বিসর্জন দিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে ইসলামী মৌলবাদীরা সভ্যতার চাকাকে পেছনের দিকে ঘুরাতে চায়। এই ভাস্কর্য অপসারনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সরকার সেই অশুভ শক্তিকেই প্রশ্রয় দিয়েছে।
ভাস্কর্য অপসারণ ঘটনায় যারা ক্ষুণ হয়েছেন, তাদের একটা বৃহৎ অংশ বাংলাদেশের সরকার প্রধানকে ‘প্রধানমন্ত্রী’ বিবেচনা না করে ‘বঙ্গবন্ধুর কন্যা’ হিসেবেই দেখেন। আমাদের ‘স্বাধীনতা’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ এ দুটো নাম একেবারেই সমার্থক। একটি থেকে আরেকটিকে আলাদা করার সুযোগ নেই। দেশটিকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন করেছিলেন সেক্যুলরিজমের কথা বলে, মৌলবাদ নির্মুলের প্রত্যাশা থেকে এবং মুক্তচিন্তা বিকশিত করার আশ্বাসবাণী শুনিয়ে। দেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন আপামর প্রগতিশীল শ্রেণী বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে তার পিতার আদর্শের অনুরণন এবং বাস্তবায়নই দেখতে চায়। আর তেমন চাওয়াই তো সংগত।
এই ভাস্কর্য অপসারণে শেখ হাসিনার সায় আছে, — এক শ্রেণির দলকানা ছাড়া এমনটাই দেশের আপামর জনসাধারণ বিশ্বাস করে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মান্ধতা’, এই দুটি ধারায় বাংলাদেশের রাজনীতি বরাবরই বিভক্ত। আওয়ামী এবং তাদের মিত্ররা ধর্মের সাথে রাজনীতি মিশ্রণের বিপক্ষে শ্লোগান দেয়। অপরদিকে পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক, আধা-সামরিক, খালেদা-এরশাদীয় শাসনামল প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনায় ধর্মান্ধতাকে উস্কে দিয়েছে। ওরা পরিকল্পিতভাবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে পেট্রোডলার এনে মাদ্রাসা-মক্তব প্রতিষ্ঠা করে দেশটিকে ইসলামীকরণ করেছে। দেশ এখন ধর্মান্ধ মানুষে ঠাসা! বস্তুত: এই ধর্মান্ধতাকে ধর্ম-পরায়ণতায় রূপান্তর করার সামর্থ্য আওয়ামী লীগের ছাড়া অন্য কোন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির নেই। তবে আওয়ামী লীগ সেই সামর্থ্য কতখানি ব্যবহার করছে, সে বিতর্ক চলতেই পারে।
স্যোশাল মিডিয়াগুলোর পাতায় পাতায় ভাস্কর্য অপসারণ নিয়ে প্রতিবাদের তুফান বয়ে যাচ্ছে! বাম এবং অতি-বাম ঘরানার সমর্থকেরাই এ নিয়ে অধিক সোচ্চার! তারা দেশে-বিদেশে বিষয়টি নিয়ে তুমুল হৈ চৈ করছেন। সরকার সেক্যুলার চরিত্র হারিয়েছে, মৌলবাদীদের কাছে মাথা নত করেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি সব নালিশ তাদের। দৃশ্যত: সে সব অভিযোগ মিথ্যাও নয়। অতি বিল্পবী একটি শ্রেণি আরো একধাপ এগিয়ে। তারা বলছে, দেশটি নাকি এই সরকার পাকিস্তান বানিয়ে ফেললো! এদের চিল্লাপাল্লা শুনে ‘হঠাৎ ঘুমভাঙ্গা’ কোন মানুষের মনে হতে পারে যেন ঢাকা দখল করে নিয়েছে ইসলামাবাদ!
আওয়ামী লীগ একটি পেটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল। ভোটের জন্য তাদের ভোটারের দরজায় যেতে হয়। বামদের মতো করে ঘরে বসে মাইক হাতে নিয়ে রাজনীতির তত্ত্ব কপচানো আওয়ামীদের পোষায় না। ভোটারের ভাষা তাদের বুঝতে হয়, জনতার মনস্তত্ব তাদের মানতে হয়। আজকের বাস্তবতায় দেশের বিশাল ভোটার গোষ্ঠী ধর্মান্ধ। আওয়ামীরা (বামদের খুশি রাখতে) এই বৃহৎ ভোটব্যাংককে উপেক্ষা করতে পারে না। পেছনে তাকালে আমরা দেখতে পাবো, এই ধর্মান্ধ ভোট ব্যাংক বরাবরই বিরোধীবাক্সে ভোট দিয়ে আওয়ামীদের ক্ষমতার বাইরে রেখেছে। অত্যন্ত সংগত কারণেই আওয়ামী লীগ এই ভোটগুলো পেতে চাইবে।
সচেতন মহলের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, তাহলে কি আওয়ামী লীগ ধর্মান্ধদের দলে পরিণত হলো! সত্যিই যদি তেমনটি হয়, তাহলে দেশের জন্য এর থেকে অকল্যাণকর আর কিছুই হতে পারে না। মুক্তমনা জনগোষ্ঠির আশার শেষ প্রদীপটিও তাহলে নিবে যায়। তবে ততদূর দুশ্চিন্তা করবার সত্যিই কি যৌক্তিক কারণ ঘটেছে? নাগরিকেরা সৎ আত্ম-জিজ্ঞাসার জবাবে বলুন দেখি, এ সরকার কি জঙ্গিবান্ধব? চুড়ান্ত বিচারে এই সরকারের আমলে ‘জঙ্গিবাদ বিকশিত হচ্ছে’ -এমনটা বলা যায় কি? পত্র পত্রিকার পাতায় পাতায় প্রতিদিন যে খবর দেখি, ‘জঙ্গি আস্তানায় সশস্ত্র পুলিশি আভিযান’ -সে সব কি তাহলে মিথ্যা খবরগুচ্ছ?
স্মরণ করি, এই সেদিনও এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনা যখন রাজনৈতিক কৌশলের খেলায় যুগপৎ আন্দোলনের নামে গোলাম আজমদের সাথে হাত মেলালেন, তখন কিন্তু আমরা বর্তমান সময়ের থেকেও অনেক বেশি শংকিত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম! কিন্তু প্রথম সুযোগেই শেখ হাসিনা কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করেননি? সেটা যদি শেখ হাসিনাকে দিয়ে সম্ভব হয়ে থাকে তো আজকের শফি হুজুরদের বেলায় তিনি তা পারবেন না কেন? অথবা পারতে চাইবেন না কেন?
বাবার মতো অতখানি শক্তপোক্ত না হলেও শেখ হাসিনার মধ্যে এক ধরনের চারিত্রিক দৃঢ়তা আমরা দেখতে পাই বটে। নিকট অতীতে তাকালে আমরা দেখবো, গ্রামীণ ব্যাংক আঁকড়ে থাকা মুহাম্মাদ ইউনূস সাহেবের অপসারণ নিয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনের হুমকি-ধামকি হাসিনা থোড়াই কেয়ার করেছিলেন। এবং ওই একই সংযোগে পদ্মা সেতু থেকে বিশ্ব ব্যাংকের ‘ঋণ প্রত্যাহার’ হুমকির মুখে, উল্টো বিশ্ব ব্যাংককেই সাফ সাফ ‘না’ বলে দেবার দৃঢ়তা দেখিয়ে শেখ হাসিনা দেশবাসিকে গৌরবান্বিত ও সম্মানিত করেছিলেন।
আরো স্মরণ করি, ৭১’র এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠান এবং শাস্তি কার্যকর নিয়ে জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর প্রত্যক্ষ (ও পরোক্ষ) বিরোধিতার মুখেও বঙ্গবন্ধু কন্যা কখনও বিচলিত হননি! বলতে গেলে তার একক নেপথ্য-দৃঢ়তায় দেশের মুক্তিকামী লক্ষ-কোটি মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। রাজাকারেরা ফাঁসিতে ঝুলেছে! যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর কোন ছোট ঘটনা নয়। এটি অকল্যাণের বিরুদ্ধে কল্যাণের জয়, অন্ধকার ফুঁড়ে আলোর বিচ্ছুরণ, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে মুক্তচিন্তার বিজয়! আগত দিনের বাংলাদেশ নিরন্তর এর সুফল ভোগ করবে। আর শেখ হাসিনা এসব কঠিনতম কর্মগুলো করতে পেরেছেন দেশের কল্যাণকামী জনসাধারণ তাকে নি:শর্ত সমর্থন জুগিয়েছে বলেই।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রথম এবং শেষ পরিচয়, তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা! আশাকরি তার জীবদ্দশায় তিনি ‘পরিচয়টি’ কখনও ভুলবেন না। গোলাম আজমদের সাথে রাজনীতির কুট-কৌশলের খেলায় শেখ হাসিনা যখন জয়ী হতে পেরেছেন, তখন তেঁতুল হুজুরদের সাথেও তিনি বিজয়ী হবেন বলে আশা করা যায়। সে জন্য তার শুধু প্রয়োজন প্রগতিকামী জনতার নি:শর্ত সমর্থন।
যুদ্ধ জয়ের কৌশল হিসেবে নিজ বাহিনীকে সংগঠিত করার প্রয়োজনে সেনাপতিকে কখনও থমকে দাঁড়াতে হতে পারে, আবার কখনও বা পিছু হটতেও হতে পারে। কিন্তু সে থমকে দাঁড়ানো বা পিছু হটা পরাজয় নয়, কৌশলী অবস্থান মাত্র! সুতরাং, নেতার উপর আস্থা রাখুন!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)