ভাষা সংগ্রামী শিল্পী ইমদাদ হোসেন। ১৯২৬ সালের ২১ নভেম্বর ঢাকার কেরানীগঞ্জের রেহিতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা মজিদ বখত(ধনু), মা সাবেদুন নেছা।
ইমদাদ হোসেন ১৯৪৮ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত আর্ট ইনস্টিটিউটে প্রথম ব্যাচে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে কেরানীগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলে দাঙ্গা প্রতিরোধ করেন। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে তিনি তার একজন সদস্য নির্বাচিত হন এবং ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে পাশ করনে। ১৯৫৩ সালে ছাত্র অবস্থা থেকেই তিনি বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। তিনি ‘ভিবজিওর’ নামে একটি বাণিজ্যিক চিত্রকলা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
শিল্পী হিসেবে তিনি এশিয়ান ফাউন্ডেশন, ইউএস ইনফরমেশন সার্ভিস, ইস্ট পাকিস্তান ডিজাইন সেন্টার, সুইডিস-পাক ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার প্রজেক্ট, পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্রের প্রধান ডিজাইনার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক হিসেবে কাজ করেছেন। মুক্তধারা নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তোলেন তিনি।
১৯৬৯এর গণ-অভ্যত্থানে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। পটুয়া কামরুল হাসানকে সভাপতি ও ইমদাদ হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করে ‘চারুশিল্পী সংস্থা’ গঠিত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার কেরানীগঞ্জের বাড়িটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগদান করেন। বর্তমান বাংলাদেশ টেলিভিশনের লোগোটি তারই করা।
১৯৭৬ সালে বিসিকের ডিজাইন সেন্টারে যোগ দেন এবং ১৯৯১ সালে অবসর নেন। বিসিকের ডিজাইন সেন্টারে কাজ করার সময় প্রধান নকশাবিদ হিসেবে তিনি দেশের ঐতিহ্যবাহী লোক ও কারুশিল্প মেলাকে শহারাঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ঢাকায় বৈশাখী মেলা, বসন্ত মেলা, যশোরে মধু মেলার আয়োজন করেন। পহেলা বৈশাখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে যে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বের হয় সেটির নামকরণ করেন প্রথম ব্যাচের ছাত্র ভাষা সংগ্রামী শিল্পী ইমদাদ হোসেন।
সম্মাননা ও পুরস্কার: চারুশিল্পে অবদানের জন্য ২০১০ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন শিল্পী ইমদাদ হোসেন। এছাড়া বাংলা একাডেমির ফেলো, দৈনিক জনকণ্ঠ আজীবন সম্মাননা, চারুশিল্পী সংসদের সম্মাননাসহ বিভিন্ন পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হন শিল্পী ইমদাদ হোসেন।
সন্তান: ৪ ছেলে, ২ মেয়ের জনক ইমদাদ হোসেন। বড় ছেলে ইমরান হোসেন পিপলু, মেঝ ছেলে নিসার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক, সেজো ছেলে সাখাওয়াত হোসেন বাবু কানাডা প্রবাসী, ছোট ছেলে নাসিম হোসেন অপু। বড় মেয়ে নাসিমা হোসেন টিংকু বাংলা কলেজের শিক্ষক, ছোট মেয়ে চন্দনা হোসেন মিঠু (থাকেন ভারতের শান্তি নিকেতনে)
২০১১ সালের ১৩ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন ভাষা সংগ্রামী শিল্পী ইমদাদ হোসেন।
২০০৬ সালের ২৫ জানুয়ারি ইমদাদ হোসেনের সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন তারিকুল ইসলাম মাসুম।
তা. ই. মাসুম: আপনার দেখা ভাষা আন্দোলন নিয়ে বলুন।
শিল্পী ইমদাদ হোসেন: খাজা নাজিমুদ্দিন (সেই সময়ের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, আলোচনা প্রসঙ্গে আসল তার নাম)। আন্দোলন আরো আগে থেকে হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় আসলেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে কেন্দ্রে প্রথম পার্লামেন্টে প্রস্তাব ওঠে। তৎকালীন সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান আন্দোলনে পূর্ব বাংলার ভূমিকা বলিষ্ঠ। আর জনসংখ্যার ভিত্তিতেও বাংলা রাষ্ট্রভাষা হওয়ার গুরুত্ব বহন করে’। এজন্য তিনি রাষ্ট্রভাষার ক্ষেত্রে বাংলাকেও যুক্ত রাখার দাবি জানান।
তিনি বললেন, রাষ্ট্রভাষা একটা হলেও বাংলাই হওয়া উচিৎ। পশ্চিম পাকিস্তানের সংসদ সদস্যরা তার এ প্রস্তাব হাস্যকরভাবে উড়িয়ে দেয়। প্রত্যাখ্যাত হতে হয় তাকেও। তখন পূর্ব বাংলার ছাত্রমহলে প্রশ্ন ওঠে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের এ ধৃষ্টতার প্রতিবাদ করতে হবে। প্রদেশের অ্যাসেম্বলিতেও প্রথম কথা ওঠে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।
খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন পশ্চিমাদের পা চাটা। প্রথমে গুরুত্ব পায়নি। পরে চাপের মুখে খাজা নাজিমুদ্দিন এ দাবি কেন্দ্রীয় পরিষদে ওঠানোর কথা বলেন, পরে তিনি সে কথা রাখেননি। ১৯৫১ সালের ডিসেম্বর অথবা ’৫২’র জানুয়ারি, পল্টন মাঠে জনসভায় খাজা নাজিমুদ্দিন বললেন, রাষ্ট্রভাষা উর্দু হওয়া উচিৎ। যারা রাষ্ট্রভাষা বাংলা করতে চায়, তারা পাকিস্তানের শত্রু। এ বিষয়টি ছাত্র সমাজে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়।
১৯৫২ সালের জানুয়ারির দিকে, যতদূর মনে হয় ১৯৫১’র ডিসেম্বরের দিকে উনি একটা মিটিং করলেন এখানে এসে। সেই মিটিং এ উনি বলেই গেলেন যে, রাষ্ট্রভাষা উর্দু হওয়াই উচিৎ, যে ‘রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হবে’, ‘কেবলমাত্র উর্দুই হবে’। একমাত্র উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা।
এটাতে ছাত্ররা আরো বিক্ষুব্ধ হন, ঐখান থেকেই কিছু কিছু প্রতিবাদ বিভিন্ন জায়গা থেকে শোনা গেল নো! নো! বলে। অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন ঐখান থেকেই আমরা কিছু আভাস পেলাম। এ আন্দোলনটার আভাস পেলাম যে, আন্দোলন ছাড়া আদায় করা যাবে না, এই দাবি। আর আমাদের প্রতিনিধিত্ব যারা করে এই পূর্ব বাংলায়, তারাও বেশিরভাগ আমাদের বিপক্ষের লোক। তো, এখন আমি এই আন্দোলনের শুরুটা এইখান থেকেই বলব। শুধু যে, জানুয়ারি মাসেই ’৫২ সনে, আমি ঠিক সময়টা কোন নথি না দেখে বলতে পারব না।
সম্ভবত মিটিংটা ডাকা হল তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের তরফ থেকে। এই সভার আহ্বায়ক হইল কাজী গোলাম মাহবুব, তিনি একজন অ্যাডভোকেট, তিনি রাষ্ট্রভাষা, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের উদ্দেশ্যে পুরনো ঢাকার কোর্ট হাউজের পেছনে বার লাইব্রেরিতে একটা মিটিং ডাকেন। এই মিটিং এ ৪০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নাম দিয়ে।
এবং সেইখানেই, এই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের একটি গণমোর্চা তৈরি হয়। সর্বস্তরের লোক নিয়ে এই কমিটিটা করা হয়। বিভিন্ন পেশাজীবী থেকে শুরু করে ছাত্র, চাকুরীজীবী রাজনীতিক এদের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে যা যা সম্ভব ছিল ঐ মুহূর্তে যোগাড় করা। একটা কমিটি করা হয়। ঘটনাক্রমে আমিও ঐ কমিটিতে যুক্ত হয়ে পড়ি।
চারুকলায় ভর্তি হওয়ার পরে স্বাভাবিকভাবে আমি ছাত্র এবং এইখানকার, এদের প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে নিয়ে নেয়া হলো ঐ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে। সেইখান থেকেই আন্দোলনটা চলতে থাকল। এবং মাঝে মাঝে এ কমিটির মিটিংও হতো, সেইখানে প্রথম আলোচনাটা হলো যে, আমাদের কিছু ফান্ডের দরকার। ফান্ড কালেকশন করার জন্য চাঁদা। পথচারীদের কাছে, যেখানে যা পাওয়া যায়, ছাত্ররাই ঐটা কালেকশন করত।
সিগারেটের কৌটা, ৫০টা সিগারেটের জন্য যে কৌটা থাকত। এখন যে কনডেন্সড মিল্কের কৌটা এরকম কৌটা ছিল। একই সাইজের সিগারেটের কৌটা এইগুলোকে কাগজ দিয়ে মুড়ে মাথা উপরে ঢাকনার উপরে একটা ফুটো করে আমরা নিয়ে যেতাম। রাস্তা ঘাটে ঘুরতাম। লোকজন যারা যেত তাদের কাছে এসে ধরতাম। দুই আনা, এক আনা, আট আনা, এক টাকা এগুলি আদায় করতাম, লোকের কাছে চাইলেই পেতাম।
আর তাদের বুকে একটা ব্যাচ পরিয়ে দিতাম। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, এই স্লোগান দিয়ে। এইভাবে চলল এক মাসের মতন, এই ফাঁকে তখন সিদ্ধান্ত হইল একটা দিন জগন্নাথ হলে তখন অ্যাসেম্বলি ছিল। সেইখানে যেয়ে এইটা তাদের কাছে দেব বা তারা আগেই আইসা নিয়া যাবে আমাদের কাছ থেকে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তারা প্রস্তুত হইছে, যাতে এ আন্দোলনটাকে নস্যাৎ করে দেয়া যায়।
তো, এর মধ্যে কিছু কিছু সদস্য আছেন (অ্যাসেম্বলিতে) যারা আমাদের সমর্থন করেন। যারা নিজেরাও সংগ্রামী হয়ে উঠতেছেন আস্তে আস্তে।
কিন্তু দেখা গেল তার আগের দিন ২০ তারিখ, একটা মিটিং ছিল। এই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদের। এটা ছিল বোধ হয় ৯৮ নবাবপুর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় অফিসে, সেইখানে একটা মিটিং ছিল বিকাল ৪টায়। সেই মিটিং এ সবাই উপস্থিত হই আমরা।
কিন্তু মিটিং এ যেতে যেতেই আমরা রাস্তায় শুনলাম, রিক্সা করে দুটি লোক, একটা কনেস্টবল পুলিশ আর একটা প্লেইন ড্রেসে সেই কেরেস্ত্যালের টিনটা পিটাচ্ছে আর ঘোষণা দিল তারা যে, আজকে থেকে ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হলো। রাস্তায় ৫ বা ততোধিক লোক একসঙ্গে চলাচল করতে পারবে না। আর ১৪৪ ধারা জারি করায় যা যা, যে সকল নিষেধাজ্ঞা পালন করতে হবে সেগুলোও জুড়ে দিল তার সঙ্গে।
অর্থাৎ আমরা আগামীকালকের প্রোগ্রামটা (২১শে ফেব্রুয়ারি) করতে পারব না। এইটা নিয়ে বিকাল থেকেই মিটিং। এই মিটিং চলল অনেক রাত পর্যন্ত। শেষে সবাই মিলে দেখা গেল যে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার প্রস্তাবটা সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করা গেল না। না যাওয়ার একটা যুক্তি আছে। সেই যুক্তিটা হইল এই, যে ৪০ জন সদস্যের মিটিং হলো, আর হাজার হাজার ছাত্র যাবে মিছিলে। এবং সদস্যদের মধ্যে সবাইতো বর্ষীয়ান। আমাদের মতো বয়সের খুব কম আছে। (ইমদাদ হোসেন তখন চারুকলার ১ম অথবা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র)
সব নেতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গার পক্ষে ছিলেন না। আর বয়সে তরুণ ছাত্র নেতারা ২/১ জন ভঙ্গ করতে চাইলেন। সুতরাং তারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেই ওখানে যাবে।
আর কিছু যারা বয়সে প্রবীণ, তারা নানা রকম প্রশ্ন উঠাল এবং দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লেন যে, এইভাবে হয়ত গুলি চালাবে! হয়ত ছাত্র মারা যাবে! এটার দায়দায়িত্ব কে নেবে? আমাদের ঠিক হবে কিনা? এসব সংশয়ে পড়ে কোনো মীমাংসা হলো না।
তখন ঠিক করা হলো যে, একটা ভোটাভুটি হবে। ভোটাভুটিতে দেখা গেল ৩ জন কি ৪ জন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে। আর বাকী সবাই বিপক্ষে। ‘তখন এইটা ভার দেয়া হলো যে আগামীকাল (২১শে ফেব্রুয়ারি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমতলায় যে মিটিং হবে, ছাত্রদেরকে সেইখানে এই অবস্থাটা তুলে ধরা হোক’। তারপরে ছাত্ররা যা করে তাই হবে।
তো দেখা গেল এখানে এই প্রস্তাব যা, যতদূর লেখা হয়েছিল সেটা ওখানে পড়ার পরে ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নিল যে, সরকার যাই করে, আমরা যাব। আমরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করব। কারণ, এইটা ওদের কোনো (রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার) অধিকার নেই, এইটা দেয়ার। আমাদের এইটা নাগরিক অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার। এটাতে হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার আইনগত কোনো অধিকার নাই তাদের। তো এইভাবে প্রথম শুরু করল ১৪৪ ধারা ভঙ্গের কার্যক্রম।
৫ জন গেলেই তো ভাঙ্গবে ১৪৪ ধারা, কিন্তু বেশি গেলে ওরা (পুলিশ) ২/১ বার বেশি যাওয়া হইছিল। কিন্তু দেখা গেল, ট্রাকে তুলে নিয়ে তাদের দূরে নিয়ে ছেড়ে দেয়। সুতরাং তখন করা হলো, ৫ জন ৫ জন করে যাওয়া, ৫ জন গেলেইতো ১৪৪ ভঙ্গ। ঐভাবে বেরুতে লাগল, আর পুলিশ ধরে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু তারপরে। শেষে, টিয়ার গ্যাস ছাড়ল। টিয়ার গ্যাসটা ছাড়ল শুধু রাস্তায় না, ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের ভেতরে। সে ভয়ানক টিয়ার গ্যাস। এতে অনেকে আহত হলো। বিশেষ করে গাজীউল হককে আমি প্রত্যক্ষ করেছি, সে খুব বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিল। কারণ উনি গ্যাস বোমটাকে ধরে ছুঁড়ে মারতে গিয়েছিলেন। তার হাতেই সেটি ফেটে যায় এবং উনি আহত হন। তো তারপর ঐ চত্বরটা গ্যাস দিয়ে একদম ধূমায়িত হয়ে গেল।
চোখ-টোখ জ্বালা করতে লাগল, হাত পা জ্বালা করতে লাগল। ওখানে একটা পুকুর ছিল, চারদিকে সে পুকুরে মানুষে রুমাল ভিজিয়ে, কেউ জামা ভিজিয়ে মুখ চোখের মধ্যে দিল। ডাক্তার ছাত্ররা ব্যালকুনি থেকে, উপরের বারান্দা, উপর থেকে কী একটা মেডিকেল লোশন ভিজিয়ে তুলা, তুলাগুলো উপর থেকে ছাড়তে লাগল। যেটা টেনে টেনে তাদের কাছ থেকে নিয়ে মুখটুখ মুছতাম। তাতে কিছুটা যন্ত্রণা কম হতো। এরকম করতে করতে দুপুরটা পার হয়ে গেলাম।
তখন তারা (ছাত্ররা) ঠিক করল এদিকে দিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না। আমরা ঐ, এখন যে শহীদ মিনার, শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে যে ইমার্জেন্সির দরজা, সে দরজা তো ওখানে নাই। ঐসময় ঐখান দিয়ে একটা গেট ছিল হোস্টেলের গেট। ঐখান দিয়ে বেরুল কিছু ছাত্র।
বের হতে যেয়েই পুলিশের মুখোমুখি। পুলিশের সঙ্গে কিছুক্ষণ ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি হলো। তারপর ওরা গুলি চালাল। গুলিতে বোধ হয় আমার যতদূর মনে পড়ে প্রথম শহীদ হয়েছিলেন আবুল বরকত। কারণ তিনি বারান্দায় দাঁড়ানো ছিলেন। ঐখানেই উনি গুলি খান। তারপরে এরকমভাবে আমরা দেখলাম, বেশ কয়েকজন এখানে সেখানে লুটিয়ে পড়ল। একটা ছেলে ছিল সম্ভবত রিক্সা চালাত। একে লোকেট করতে পারি নাই আমরা। হাফপ্যান্ট পরা। বয়স্ক কিন্তু হাফপ্যান্ট পরা। পুরো পা’টা একদম ঐ পায়ের পাতার উপর থেকে পুরোটা নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু এর কোনো পরিচিতিও পাই নাই, দেখিও নাই পরে, কী অবস্থা হয়েছে সেটাও জানি না। এই চলতে লাগল প্রায় ৪টা সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। এরপরে একসময় সব স্তিমিত হয়ে আসতে লাগল। তারপর এখান থেকে চলে গেলাম।
তা. ই. মাসুম: তখন ওখান থেকে কোথায় গেলেন?
ইমদাদ হোসেন: তখন আমাদের ছিল চারুকলা ইনস্টিটিউট। ছাত্র এবং শিক্ষকরা মিলে ওখানে শিল্পীদের একটা সংগঠন দাঁড়িয়েছিল, ঢাকা আর্ট গ্রুপ। ঢাকা আর্ট গ্রুপের দ্বিতীয় বার্ষিক প্রদর্শনীর প্রেস শো ছিল ঐ দিন।
তা. ই. মাসুম: ঐ ২১শে ফেব্রুয়ারি?
ইমদাদ হোসেন: হ্যাঁ, ঢাকা আর্ট গ্রুপের ২য় বার্ষিক প্রদর্শনীর প্রেস শো, অর্থাৎ সেদনি প্রদর্শনী নয়, সেদিন কেবল সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা আসবেন। তারা দেখে, ঠিক ২২ তারিখে উদ্বোধন হবে, ঐদিন পত্রিকায়ও খবরটা দেবে। এই জন্যই ঐদিন প্রেস শো ছিল।
তো, আমরা ওখানে গেলাম যাতে এক্সিবিশনটা বন্ধ রাখা হয়, এইট বলার জন্য। আমি, মুর্তাজা বশীর আমরা এইখান থেকে গেলাম। এর মধ্যে আরো ২/১ জন আমাদের বন্ধু-বান্ধব ছিল। ঐখানে যেয়ে পেলাম আমরা কামরুল হাসান সাহেবকে। ঢাকা জাদুঘরে এই এক্সিবিশনটা হচ্ছিল, জাদুঘরে হওয়ার কথা। জাদুঘরের তখনকার কিউরেটর ড. দানি, ওনাকে ওখানে দেখলাম, অধ্যাপক অজিত গুহ ছিলেন, আরো কয়েকজন ছিলেন ওখানে দাঁড়ানো। তাদেরকে আমরা রিপোর্ট দিলাম কী অবস্থাটা দেখে এলাম? তারপর আমরা বাসায় চলে যাই। ২১শের ঘটনাটা এখানেই শেষ।
কিন্তু আশ্চর্য! এই যে গুলি চলেছে। এই যে লোক মারা গেছে। এটা আমরা, আমাদের চাইতে, আমরা হেঁটে এসেছি যে, তার অনেক আগে এটা ছড়িয়ে গেছে মুখে মুখে সারা শহরে। এবং সারা শহরের লোক এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল সেদিন থেকেই। লোকজন একে অন্যকে জিজ্ঞেস করছে ক’জন মারা গেছে? সব বলছে। আর গালাগাল দিতেছে পাকিস্তানিদের, ওরা।
পরদিন সকাল বেলা উঠে দেখলাম। ঢাকা শহরে এমনিতেই বন্ধ সব। স্কুল কলেজ তো নয় খালি, কোর্ট কাচারী পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। একটা পত্রিকা বের করেছিল বোধ হয়, সরকারের পক্ষে ‘মর্নিং নিউজ’, এই মর্নিং নিউজ প্রেসসহ জ্বালিয়ে দিয়েছিল। এটা ‘জুবলী প্রেস’ বলে একটা প্রেস ছিল। ঐ সদরঘাটের কাছে (জনসন রোডে) এই প্রেসটাতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। এটা কিন্তু কেউ অর্গানাইজ করে করেনি। সব জায়গায় অফিস আদালত সমস্ত খালি করে তারাই বেরিয়ে এসছে সব জায়গা থেকে। এবং এই হরতালটা চলতে লাগল আপনি আপনিই। এই ধর্মঘটটা, যতদিন পর্যন্ত না, এই কমিটি বলেছিল যে, আপনারা এবার এই হরতাল ভেঙে দেন। আপনারা ভবিষ্যতে আরো বড় আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হন। কারণ, আমাদের ঢাকা শহরের লোকের সঙ্গে মিটিং হলো। সেই মিটিং এ, ঢাকার মাতব্বররা, সর্দাররা একটা অদ্ভুত যুক্তি দিল। যে, হরতাল আপনারা ভাঙবেন না। হরতাল চলুক। খালি গ্রাম থেকে দুধ আনে যারা, এই দুধটা যেন শহরে আনতে পারে। কারণ, আমাদের বাচ্চারা কষ্ট পাচ্ছে। কষ্ট পাচ্ছে শিশুরা। খালি এটার পারমিশন দেন। সঙ্গে সঙ্গে সব্বাই যে, এটা আপাতত বন্ধ থাকুক হরতাল। আমাদের সময় আছে। আমরা যে সাহস, যে সহানুভূতি, যে ভালবাসা পেলাম, ঢাকাবাসীর কাছে এটা আমাদের কাছে বহু। সুতরাং তারা কোনোরূপ কষ্ট পাক, এটা আমরা চাই না। এটা চলতে থাকুক, আবার প্রয়োজন হলে আমরা তাদের কাছে যাব। এটা হলো আমাদের ২১শে’র পরবর্তীতে ২২ তারিখের ঘটনা।
এবং তারপরে থেকে হরতাল উঠিয়ে দেয়া হলো। কিন্তু, না এটা ২২ না, এটা বোধ হয় ২৪ তারিখের ঘটনা। এই পর্যন্ত চলতেই ছিল হরতাল। তারপর হরতালটা ভাঙা হয়। আর ঢাকাবাসীর সঙ্গে একটা হৃদ্যতা আমাদের সঙ্গে জমে। এরপরে থেকে এই দেশের নির্বাচনে কখনো মুসলিম লীগ কোনো আসন পায়নি। ১টা বা ২টা আসন, নূরুল আমীন একবার জিতেছে। তাও ’৭০ সনে। আর এরপরে ওরা, ওদের পাকিস্তানিদের অস্তিত্ব এখান থেকে শেষ হয়ে গেল।
’৫৪তে একটা নির্বাচন হলো, ১৯৫৪তে। যুক্তফ্রন্ট নামে অন্যসব পার্টি মিলে মুসলীম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন করল। এবং মুসলিম লীগকে একদম, একদম নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হলো। ঐ মাস থেকে, ঐ সময় থেকে, ঐখান থেকে আস্তে, আস্তে আস্তে রাজনীতিই। ২১ থেকে এখানে উঠল আরো তুঙ্গে। এই রকম করে এখানে আওয়ামী লীগের দেওয়া ৬ দফা আন্দোলন, সাায়ত্তশাসনের দাবি নিয়া সে আন্দোলন চলল। সেখানে ঐ একটাই করত। গুলি চালাত ২/৪টা লোক মারত, এই করতে করতে এক সময় পাকিস্তানিরা চলে গেল।
’৭০এর নির্বাচন হলো। ’৭০এর নির্বাচনে গোটা পাকিস্তানে সংখ্যাধিক্য পেল আওয়ামী লীগ। তারপরেও যখন ক্ষমতায় যেতে দেওয়া হলো না, তখন এই ৭ই মার্চের ভাষণের পরে দেশবাসী তো নির্দেশ পেয়েই গেল! তো যুদ্ধ ছাড়া আমাদের আর গতি নাই। দেশ স্বাধীন করতে হবে, আর কোনো আপোস না। তাদের ওপর কোনো আস্থা নাই আমাদের। আমাদের লড়ে স্বাধীন হতে হবে। এবং সেই স্বাধীনতা সংগ্রামটাই, আমাদের সেই ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালের, তারই পরিণতি। এই স্বাধীনতা যুদ্ধ। এইটা আমাদের পরের বছরের ২১শে ফেব্রুয়ারি উদযাপন, ব্যানারের মতো ওপরে ধরে। ছবির ভাষা, আমরা বাক স্বাধীনতার অধিকার চাই। গুলি চালিয়েছিল অধিকার খর্ব করতে।
তা. ই. মাসুম: আপনি চারুকলায় ভর্তি হলেন কবে?
শিল্পী ইমদাদ হোসেন: এই যে চারুকলা ইনস্টিটিউশন, এটা হইছেই ’৪৮ সনে, কাজেই তারপরেই আমরা ভর্তি হয়েছি। তারপরের ঘটনাগুলো একটু বলি। এই আমরা ভর্তি হওয়ার আগে এই ঘটনা। তখনো ছাত্রদের আন্দোলনটা ছিল।
তা. ই. মাসুম: শহীদ মিনার নির্মাণের বিষয়গুলো কি আপনার মনে আছে? আপনি কি তার সঙ্গে জড়িত ছিলেন?
ইমদাদ হোসেন: হ্যাঁ আছে মনে, এটাতে আমরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নই। কিন্তু আমরা দেখেছি পরদিন সকালে। আমরা জানি, এর সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন। তাদের ৩ জনের নাম জানি আমি, একজন ডাক্তার বদরুল আলম, তিনিও ছাত্রই ছিলেন তখন, আরেকজন ডা. হায়তাজ, তিনি বোধ হয় ছাত্র থাকলেও কোলকাতার ছাত্র ছিলেন। ঢাকায় এসে তখন সম্ভবত, ঢাকায় তখনও ছাত্র। উনি কোলকাতা শেষ করেননি। প্রথম থেকেই কোলকাতা ছিলেন, ঢাকা থেকে বোধ হয় এমবিবিএস পাশ করেন, উনিও ছিলেন ওখানে এটা জানি।
আর এটা তৈরি করার জন্য ইট, বালি, সিমেন্ট, যা লাগে তখন এখানে কন্ট্রাক্টর ছিল, মেডিকেল কলেজে নির্মাণের বিভিন্ন কাজ হচ্ছিল। তার মধ্যে কাজ করছিল একজন কন্ট্রাক্টর যিনি কাজ করেছিলেন তিনি ‘ঢাকাইয়া (নাম মনে করতে পারলেন না)। সম্ভবত পরবর্তীকালে কোনো সর্দার হিসেবে দেখি একটু ভেবে খোঁজ করে নামটা পাই কিনা। তিনি এইগুলি ইট, বালি, সিমেন্ট এগুলি, ছাত্রদের বলেছিলেন, যা লাগে নিয়ে যান। আমার গোডাউন থেকে। তখন তারা এনে ঐ যে, শহীদ মিনারটা করে। এখানে।
তা. ই. মাসুম: তারপর ভেঙে দেয়ার বিষয়টা কি মনে আছে?
শিল্পী ইমদাদ হোসেন: ভেঙে দেওয়ার? পুলিশ ভেঙে দেয়! আর কি। প্রথম এটা উদ্বোধন করছিলেন (শহীদ মিনার উদ্বোধনের ছবি দেখিয়ে) দেখেন এখানে আছে বোধ হয়। এটা উদ্বোধন, এই ছবির মধ্যে।
তা. ই. মাসুম: ঐ বিষয়গুলো (ছবি) আমার কাছে আছে। আপনি প্রত্যক্ষভাবে যদি ভাঙার সময় থাকেন, অথবা দেখে থাকেন সেগুলো বলবেন?
শিল্পী ইমদাদ হোসেন: না, প্রত্যক্ষভাবে না। আমরা এইটা (শহীদ মিনার) তৈরি হওয়ার পরই, উদ্বোধনের পরেই সেখানে যেয়ে দেখি যে, এইটা সব লোকজন দেখছে এবং টাকাকড়ি দিচ্ছে। এক মহিলা বোধ হয় একটা হার দিয়েছিলেন গলা থেকে খুলে ওখানে। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা এত! তা গভীরভাবে উপলব্ধি এর আগে কখনো আমাদের দ্বারা সম্ভব হয়নি। এটা আমাদের কাছে একটা, সারা জীবনের একটা বড় সঞ্চয়! ঐ দিনের যে উচ্ছ্বাস! ঢাকাবাসীর যে উচ্ছ্বাস।
তা. ই. মাসুম: শহীদ মিনারের বর্তমান অবস্থা? শহীদ মিনারের যে অবমাননা করা হয়? এ বিষয়ে আপনি কী বলেন?
শিল্পী ইমদাদ হোসেন: অবশ্যই! শহীদদের আত্মা কষ্ট পায়। এমন কাজ যেন না করা হয়। না, আমার বক্তব্য আছে এর ওপরে। এক হলো যে, শহীদ মিনারের গুরুত্ব আমাদের কাছে কী? আমর কাছে তো মনে হয় এইটা আমাদের বাঙালির হৃদয়! বাঙালির অস্তিত্ব ধরে রেখেছে শহীদ মিনার! বাংলাদেশে যা কিছু ঘটেছে, বাঙালির সম্মান, বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, সমস্ত কিছুরই শুরু কিন্তু শহীদ মিনার থেকে! যেন শহীদ মিনার নির্দেশ দেয়, তোমরা এইটা কর। আমার বিশ্বাস, শহীদ মিনারের কাছ থেকে কোনোদিনো আমরা ভুল নির্দেশ পাইনি।
’৭১’এ মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রত্যেকটি অর্গানাইজেশন, প্রত্যেকটি সংগঠন, শহীদ মিনারে গিয়ে প্রতিশ্রুতি করত। শপথ নিত। সেই যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের, যেকোনো ঘটনা ঘটুক দেশে। কোনো অত্যাচারী শাসককে পরিবর্তনের জন্য, শুরুটা হচ্ছে কিন্তু শহীদ মিনার থেকে। সুতরাং শহীদ মিনারের গুরুত্ব অস্বাভাবিক।
তা. ই. মাসুম: ২১ বা ফেব্রুয়ারি আসলে শহীদ মিনারের কদর বাড়ে সবার কাছে। সারাবছর অবহেলায় পড়ে থাকে। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
শিল্পী ইমদাদ হোসেন: আর একটা কথা বলেছেন যে, শহীদ মিনার সারাবছর পড়ে থাকে, পড়ে থাকা ছাড়া শহীদ মিনারের কোনো কাজ নাই। শহীদ মিনারের ঘুম ভাঙাতে হবে, তাহলে তো নির্দেশ পাব আমরা? শহীদ মিনার তো সুপ্ত থাকে সারা বছর। ঐ যখনই প্রয়োজন হয়, তখনই তাকে আমরা জাগ্রত দেখি। তখনই জীবিত দেখি শহীদ মিনারকে। শহীদ মিনারের কথা শুনি, শব্দ পাই। এ অনুভূতিটা আছে আমাদের। সব্বার মনেই আছে। ঐ সময়টায় শহীদ মিনারে গেলে মনে হবে, আপনাকে শহীদ মিনার কিছু বলবে, কিছু বলছে। আর সারা বছর দরকার নেই।
আমি একবার কথার ছলে বলেছিলাম শহীদ মিনারে যেয়ে যে, শহীদ মিনারটাকে আমরা সারাবছর ব্যবহার করতে পারি কীভাবে? বলে, আমি একটা উদাহরণ দিলাম, তাদের কাছে তুলে ধরলাম।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের যে ভয়াবহতা, সেইখানে মস্কো’,সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল তখন। রাজধানী ছিল মস্কো। এখন রাশিয়ার রাজধানী মস্কো। ওখানে মহামতি লেনিনের শবদেহ রক্ষিত আছে। সেই জায়গাতে, সেই জায়গাতে একটি অনির্বাণ শিখা আছে। আগুন! মশালের মতো জ্বলছে। সারাদিন ওটার মধ্যে মানুষ ফুল দিচ্ছে। বিশেষ করে নব বিবাহিত যারা, নিউ কাপল তারা, বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের পরে সরাসরি ঐখানে আসে। ঐখানে এসে ফুল দেয়। এটা তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় কর্তব্য। এবং এর অপেক্ষায় থাকে তারা দীর্ঘদিন, যেদিন বিয়ে হবে, সেইদিন ওখানে তারা ফুল দিয়ে, তারা ঘর বাঁধবে। এই সম্মানটা দেয় ওখানে। ‘আমরা এটাকে কীভাবে জীবিত রাখি’? এই কথা প্রসঙ্গে আমি বলেছিলাম যে, ‘বছরে একটা নির্দিষ্ট দিনে আমাদের সস্তানদের হাতেখড়ি দেওয়ার সময় আমরা শহীদ মিনারে এসে। এটা পালন করছে একটা সংগঠন ‘কারক’। এই কারক এইটা পালন করে এবং প্রতিবছর। যেহেতু উদ্যোক্তা আমি ছিলাম, সেই আমাকে নিবেই ওরা। নেয়, আরো সবাই আসে, ‘গাজীউল’ আসে, ‘এম আর আক্তার মুকুল’ থাকতে উনি আসতেন, তারপরে ‘আব্দুল মতিন’, সে ‘ভাষা মতিন’ যাকে বলা হয়। তো ওনাকেও নিয়ে যায় ওরা। কারণ এইভাবে, ওরা পালন করে ঐ একটা দিন।
দুঃখ চেপে রেখে কিন্তু তার মধ্যে দুঃখ-কষ্ট কি নাই? আছে, একটা বড় ব্যথা আছে আমাদের মনে।
সেই ব্যথাটা হলো, যখন ইউনেস্কো, ‘২১শে ফেব্রুয়ারি’ আমাদের সেই সংগ্রামের দিনটাকে ত্যাগের দিনটাকে যখন তারা নির্বাচিত করল সারা বিশ্বের মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। সেইদিন একটা বড় গর্ব আমাদের আসে। তার চাইতে আনন্দের বিষয়, আমাদের বড় বিষয়, আর কিছু ছিল না। কিন্তু অবাক হয়ে শহীদ মিনারে গিয়ে দেখলাম, কেউ জানে না। কেউ সে খবর পায়নি। ‘এমন কি বাংলা একাডেমি পর্যন্ত সেখানে কোনো কিচ্ছু আয়োজন করে নাই’!
খালি চারুকলার কয়েকটি ছেলে, সেইখানে একটা কাগজে ঐ দিনটার তাৎপর্য লিখে, আর ক’টা ফুল, আর কয়েকটা মোমবাতি, জ্বালিয়ে দিয়ে আসল।
আর তার দু’দিন পরে, আমরা আমাদের একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল, ‘অগ্রণী শিল্পী সংঘ’ আমরা গণসঙ্গীত গাইতাম এবং ঐ সংগঠনটা হয়েছেও ’৫২ সালেই। আমরা বেশ ক’জন উপস্থিতি ছিলাম, বেঁচে ছিলাম যারা, আমরা ক’জন যেয়ে ঐ যে, ঐখানে ফুল দেই। অগ্রণী শিল্পী সংসদ নামে। আর আমরা এই দিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, আমাদের অহংকারের কথা মনে করে বলে আমি, আমাদের সবার স্ত্রী, বউ, গেছিল, সস্তান সন্তুতিরাও গেছিল। ঐখানে আমরা একটু সময় দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। সেই দিনটাই কষ্ট পেয়েছিলাম।
যে, ‘তাহলে কি ২১শে’র এই যে, বাগান উজার করে ফুল চুরি করা? এর ভিতরে, এর ভিতরে কি, কোন অনুভূতি নাই? পরে দেখলাম যে, জিনিসটা এখন একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তার গুরুত্ব কিছু নাই। দিচ্ছে না। এটাকে আরো হৃদয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, আরো গভীরভাবে। তা নাহলে তো হয় না? এরকম করে তো আমরা স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধটাকে হারিয়ে ফেললাম। এর চেয়ে বড় জিনিস আর কী থাকতে পারে আমাদের?
কিন্তু এখন আমরা শুনি গোলমালের বছর! গন্ডগোলের বছর! আমাদের বাপ-মা’রা শিখায় নাইতো সন্তানদের। একটা প্রতিহিংসা তো থাকা উচিৎ! মনে। আমার ঘরে ঢুকে আমার মা, বোনদের ইজ্জত লুট করেছে, আমার সন্তানকে খুন করেছে,
এই প্রতিহিংসাটা না থাকলে আমরা, দেশপ্রেম কাকে বলব? আমরা কী নিয়ে বাঁচব? আমদের ছেলেদের বুকের পাটাটা কী দিয়ে শক্ত হবে? যদি এ প্রতিহিংসাটা না থাকে? ঘৃণাটা না থাকে? শত্রুর প্রতি?
একটু খানি বসেন, তাহলে বুঝবেন! যে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে একটা কথা যুক্ত ছিল। এই বাংলা একাডেমিটা যে বাড়ি, সে বাড়িটির নাম হলো বর্ধমান হাউস।বর্ধমানের মহারাজার বাড়ি, এটা প্যালেস। এটাকে বাংলা একাডেমি করতে হবে এটা আমাদের দাবি ছিল। এইটাকেই বাংলা একাডেমি করতে হবে। তাহলে স্বভাবতই এটা ’৫২’র ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, ‘শহীদ মিনারের সঙ্গে যুক্ত’। কিন্তু এটার অবস্থান কী সেখানে আছে?
তা. ই. মাসুম: সর্বস্তরের বাংলার ব্যবহার কতখানি হয়েছে, এত বছরে?
শিল্পী ইমদাদ হোসেন: এখানে বক্তৃতায় বলা হয় মাঝে মাঝে, আপনারা ইংরেজিও শিখবেন, পড়বেন। এগুলি অপ্রাসঙ্গিক। চিঠিপত্রে, সরকারি চিঠিপত্রে, ইংরেজিতে দাওয়াত দেওয়া হয়। এটার চাইতে ঘৃণার জিনিস আর নাই! আমাদের মাতৃভাষায় লেখাটা লজ্জার ব্যাপার, যাদের কাছে আমাদের এ রাজ্য এ দেশ শাসন করার তাদের কোনো অধিকার নাই! আমাদের উপদেশ দেওয়ার তাদের কোনো অধিকার নাই।
আমি এখন নিজে কোনো ইংরেজি চিঠি পেলে, সে অনুষ্ঠানে আমি যাই না। সেটা খাওয়ার হোক, বিয়ের হোক, কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান হোক, বা সভা সমিতির হোক সেটাতে আমি যাই না। আমার খুব ঘৃণা লাগে ঐসব অনুষ্ঠানে যেতে। ঐ লোকগুলির কথা শুনতে। নিয়ম ছিল, প্রথমে যেটা চালু হয়েছিল এখানে। যে, বিদেশীদের জন্য ভাষা ইংরেজি ব্যবহার করা। না, এরকম ছিল না। ছিল চিঠি বাংলায়ই লিখতে হবে।
তার একটা ছোট ইংরেজি অনুবাদ ওর সঙ্গে দিয়ে দেওয়া। বুঝলেন? চিঠিটা বাংলায়ই লেখা হবে। তার পাশে একটা লিফ আলাদা। একটা লিফ পাতা ওটার ইংরেজি অনুবাদ করে দিয়ে দেওয়া হত চিঠিটা। মূল চিঠিটা বাংলায়ই হবে। এটা তার বোঝার জন্য, তার একটা অনুবাদ দিয়ে দেওয়া সঙ্গে। ‘কিন্তু মূল চিঠি কখনো ইংরেজি ভাষায় লেখা হবে না, ‘অন্য’ কোনো ভাষায় লেখা হবে না, সেইটাই নিয়ম ছিল। তাই হচ্ছিল।
তা. ই. মাসুম: নতুন কেউ বা বিদেশিরা শহীদ মিনারে আসলে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে কতটুকু জানতে পারে? বা তাদের এ সম্পর্কে জানাতে কী করা যেতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
শিল্পী ইমদাদ হোসেন: এর একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, এই দেশের এই শহীদ মিনারের পরিচিতি, একটা থাকা উচিৎ। ছাপানো, একটা পুস্তিকা, সুন্দরভাবে নানা প্রকার ছবি সম্বলিত। ছবিগুলো কী থাকবে? বিভিন্ন আন্দোলনের সময় ওখানে যেয়ে যে শপথ গ্রহণ করে। সেই শপথ গ্রহণের ছবি। কোনো আন্দোলনের কোনো শপথ গ্রহণের ছবি? সেইগুলিকে যুক্ত করে এবং তার বর্ণনা দিয়ে, এই শহীদ মিনার যে আমাদের কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তার বিশেষভাবে উল্লেখ রেখে পুস্তিকা এবং সেটা শহীদ মিনার থেকেই, শহীদ মিনারের সংলগ্ন কোনো যায়গা থেকে যেন এইটা সংগ্রহ করা যায়, পাওয়া যায় কিনতে। যেকোনো মূল্যেই হোক, এটা যেন থাকে, এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, এর সমস্ত ঘটনাবলী একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে পাওয়া যায়। সেই দায়িত্ব নেওয়া উচিৎ বাংলা একাডেমির।
কিন্তু আমার বিশ্বাস বাংলা একাডেমি সে কাজটা করবে না।
কারণ, একটা কমপ্লেক্স আছে তাদের। তাদের অনুষ্ঠানেই আমরা দেখেছি।
তারা যেন কেন খুব কুঁকড়ে থাকে, সত্য কথাটা বলতে সাহস পায় না। এই সত্য কথা বলার লোক যতদিন তৈরি না হবে ততদিন, ততদিন, আমাদের ইতিহাস বাক্সের ভিতরে থাকবে। বাইরে আসবে না। একটা জাতি মরতে মরতে জেগে উঠেছিল। সেই জাতিটাকে আবার তলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এবং আমরা তলিয়ে যাচ্ছি, আমরা যদি এর থেকে না জাগি, তাহলে আমাদের আর কল্যাণ নাই, কোনো গতি নাই, আবার নতুন করে সেই, পদানত হতে থাকব।
কারো না কারোর।
চলবে…