লিমফেটিক ম্যালফরমেশন রোগে ভোগা মুক্তামনির অস্ত্রোপচারের খবর সংগ্রহ করতে সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে গেলাম। ইচ্ছা ছিল অস্ত্রোপচারের আপডেট জানানোর পাশাপাশি সুযোগ থাকলে মুক্তামনির মা-বাবার ইন্টারভিউ করবো।
অপারেশন থিয়েটারের সামনেই দেখা হলো তাদের সঙ্গে। দু’জনকেই খুব উদ্বিগ্ন দেখালো। এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করছিলেন। ডাক্তার নার্সদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিমুহূর্তে খোঁজ নিচ্ছেন মেয়ের। বুঝলাম, কথা বলার মত অবস্থায় নেই তারা।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পর মায়ের কাছে জানতে চাইলাম, মুক্তামনি এখন কেমন আছে?
তিনি জানালেন, ডাক্তাররা বলেছেন ভালো আছে। তবে অস্ত্রোপচারের পরপরই খবর আসে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে মুক্তামণির। তার জন্য জরুরি ভিত্তিতে রক্তের প্রয়োজন। জানতে চাইলাম, রক্তের গ্রুপ কী? তিনি জানালেন ‘এ পজিটিভ’। হঠাৎই আমার মনে পড়লো আমার রক্তের গ্রুপও এ পজিটিভ। তাছাড়া শেষ রক্ত দিয়েছি ছয়মাসের বেশি হয়ে গেছে। তৎক্ষণাৎ মুক্তামনির মাকে প্রস্তাব দিলাম, আমি রক্ত দিতে পারি কিনা?
শুনে আশ্চর্য হলেও খুশি হলেন। সঙ্গে সঙ্গে মুক্তামনির বাবাকে ডেকে বললেন, এই ভাই রক্ত দেবে। তুমি এখনই উনাকে নিয়ে যাও।
মুক্তামনিদের সঙ্গে আসা চাচাতো ভাই তরিকুল আমাকে নিয়ে গেলেন নতুন ভবনের ব্লাড ব্যাংকে।
যেতে যেতে আমাদের ইনপুট এডিটর ফাহমিদা আপুকে ইনবক্সে জানালাম, আমি মুক্তামনিকে রক্ত দিতে যাচ্ছি। যাতে এই সময়ে কোন আপডেট থাকলে অন্য কোন উপায়ে তিনি সে তথ্য সংগ্রহ করাতে পারেন। তার কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ায় আরও ভালো লাগলো।
ব্লাড ব্যাংকে গিয়ে কথা বললাম মুক্তামনির রক্ত সংগ্রহ ও তদারকির দায়িত্বে থাকা সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ শাহনাজ করীমের সঙ্গে। তিনি বললেন, মুক্তামনির জন্য দরকার প্লাটিলেট বা রক্তের সাদা অংশ। চারব্যাগ রক্ত থেকে এক ব্যাগ প্লাটিলেট সংগ্রহ করা যায়।
এরপর আমার ভেইন চেক করার পর নিয়ে যাওয়া হলো রক্ত সংগ্রহ কেন্দ্রে। পরীক্ষা-নীরিক্ষা এবং ম্যাচিংয়ের জন্য এক সিরিঞ্জ রক্ত নেওয়ার পর রক্ত সংগ্রাহক জানতে চাইলেন সকালে আমি কী খেয়েছি। ফলমুল খেয়েছি জানানোর পর তিনি বললেন, এতে হবে না। আপনাকে প্রায় ঘণ্টাখানেক এখানে থাকতে হতে পারে। কারণ স্বাভাবিক রক্ত নয়, নেওয়া হবে শুধু প্লাটিলেট। বাকী রক্তগুলো আবার আপনার শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। এতে সময় লাগবে। আমরা ম্যাচ করতে করতে আপনি কিছু খেয়ে আসেন। ভালো হয় কলা-পাউরুটি এবং স্যালাইন খেলে।
নীচের ক্যান্টিনে গিয়ে খেতে খেতে হঠাৎই মনে পড়লো সপ্তাহ খানেক আগেই আমি চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। উত্তেজনা এবং তাড়াহুড়োর কারণে ততক্ষণে সে কথা একবারও মনে পড়েনি! ব্যাপারটা সঙ্গে থাকা মুক্তামনির ভাইকে শেয়ার করলে ধারণা থেকে তিনি বললেন, আপনি যেহেতু এখন সুস্থ তাই সমস্যা হবে না মনে হয়।
দ্রুত খাওয়া শেষ করে রক্তদান কেন্দ্রের সামনে গিয়ে দেখলাম পরীক্ষা-নীরিক্ষা, ম্যাচিংসহ সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। পরীক্ষক জানালেন আপনার রক্ত ঠিক আছে এবং খুব ভালোভাবে ম্যাচ করেছে।
কিন্তু যখনই বললাম সপ্তাহ খানেক আগে আমি চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলাম, মুখ কালো হয়ে গেল তার। জানালেন আপনি রক্ত দিতে পারবেন না।
পরে ডাক্তার শাহনাজ করীম জানালেন, চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গু হওয়ার পর অন্তত ছয় মাস রক্ত দেওয়া যায় না।
শুনে খুব কষ্ট পেলাম, খুবই! হতাশ হলেন ডাক্তাররাও। ব্যাপারটা আগেই না জানানোয় অত্যন্ত যৌক্তিক কারণেই কিছুটা বিরক্তও হলেন তারা। নিজের মধ্যে খুব অপরাধবোধ কাজ করছিল তখন। কিন্তু ততক্ষণে আরও একাধিক রক্তদাতা তৈরী থাকায় কিছুটা স্বস্তি পেলাম।
পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী এবছর চিকুনগুনিয়া আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ। যারা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন কেবল তারাই জানেন কী অসহ্য যন্ত্রনা পোহাতে হয়। জ্বর সেরে যাওয়ার পরেও শরীর জুড়ে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয় দীর্ঘ দিন। তাদের এ ব্যথা আরও বেশি মর্মপীড়াদায়ক হয়ে উঠবে যখন জানতে পারবেন আন্তরিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অন্তত ছয় মাস বিপদের মুহূর্তে রক্ত দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচাতে ন্যূনতম ভুমিকা রাখার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হবেন!
দুঃখিত মুক্তামনি! একান্ত আন্তরিকতা থাকার পরেও তোমার সুস্থ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সামান্য ভূমিকাও রাখতে পারলাম না। তবে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা, দ্রুত সুস্থ হয়ে সাভাবিক জীবনে ফিরে আসো।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)