চার বছর হয়ে গেলো তুমি নেই প্রিয় টিংকু ভাই! আজ সকালে ভাবতেই চোখ দুটি ভিজে এলো! এত স্মৃতি, কী করে ভুলি তোমারে? এমন প্রাণ খোলা মানুষ একজন! সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ঘুরে বেড়ানো এক তুখোড় তরুণ! টিএসসি, মধুর ক্যান্টিন, তেইশ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ অথবা ধানমন্ডির বত্রিশ নাম্বারের পিত্রালয় কোথায় নেই! সঙ্গে এক বা একাধিক উজ্জ্বল তরুণ সারাক্ষণ! সেই মানুষটি আজ কোথাও নেই! চির চঞ্চল প্রাণ খোলা আড্ডাবাজ মানুষটি কিনা চারবছর একাকি শুয়ে আছে এক নরম মাটির বিছানায়! ভাবা যায়? চোখ দুটি কী আর এমনি এমনি ভিজে!
স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা আমার মতো একদল সাংবাদিককে কে না চিনতেন? এখনকার ছাত্রনেতারা কী এখনকার সব তরুণ সাংবাদিক সবাইকে এক নামে চেনেন? আমাদের সম্পর্কটাই ছিল এমন উজ্জ্বল আন্তরিক। তাদের সঙ্গে প্রতিদিন আমরাও হাঁটতাম মিছিলে। মিছিল শেষে টিংকু ভাইরা ফিরতেন টিএসসি বা মধুর ক্যান্টিনে অথবা নিজস্ব সব গোপন ডেরায়। আর আমরা লেখার টেবিলে। এতো শুধু এক-দু’দিনের ঘটনা নয়। মাসের পর মাস! কী যে উত্তাল উচ্ছ্বাসের দিনগুলি ছিল আমাদের। ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা আমার প্রতিশোধের আগুন’ প্রকাশের সেই সব দিনরাত্রি!
স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের নিউক্লিয়াস সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যে সাত্তার টিংকু তখন জাতীয় ছাত্রলীগের নেতা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে অভিমানের সংগঠন মহিউদ্দিন আহমদ-আব্দুর রাজ্জাক নেতৃ্ত্বাধীন বাকশাল। টিংকু ভাইর নেতৃ্ত্বাধীন জাতীয় ছাত্রলীগ বাকশালের ছাত্র সংগঠন। দোতলায় অফিস। আব্দুর রাজ্জাক কী ধরনের সংগঠক তা ইতিহাসে লেখা আছে। তার সংস্পর্শ পাওয়া জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু, ইনায়েতুর রহিম, মোজাম্মেল বাবু, ইউসুফ, তারিক সুজাত, আব্দুর রাজ্জাক, ওহিদুজ্জামান চানসহ আরো অনেককে নিয়ে জাতীয় ছাত্রলীগের টিমটি তখন অনেক সুসংগঠিত সমুজ্জ্বল। সে কারণে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পোষ্টারসহ নানাকিছুর ডিজাইন-প্রকাশনাসহ আরো অনেক কিছু হতো টিংকু ভাইর নেতৃ্ত্বে। জাতীয় কবিতা পরিষদের মঞ্চে ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’ শিরোনামের স্মরণীয় ছবিটি আঁকতে আঁকতে চিরদিনের জন্যে চলে যাওয়া পটুয়া কামরুল হাসানের ছবিটিকে মুহূর্তের মধ্যে পোষ্টার আকারে ছড়িয়ে দিয়েছিল কারা? টিংকু ভাই অ্যান্ড কোং! এর আগে মোজাম্মেল বাবুর ‘দেশবন্ধু’তে আনিসুল হকের লেখা, শিশির ভট্টাচার্যের কার্টুনে এরশাদের নাম হয় ‘গাধা’! কামরুল হাসানের স্মরণীয় সেই ছবিতে নাম হয় ‘বিশ্ব বেহায়া’! এসব কিন্তু টিংকু ভাই অ্যান্ড কোং’এর কারণেই হয়েছিল! সেই এরশাদের ‘গাধা’, ‘বিশ্ব বেহায়া’ নাম দুটি আজও প্রচলিত। বাস্তবেও আজো এরশাদ তাই।
স্বৈরাচার এরশাদ ফরমান জারী করেছে পত্রিকায় কোনো পলিটিক্যাল রিপোর্ট ছাপার আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (রাজনৈতিক) আব্দুল হামিদ চৌধুরীর অনুমোদন নিতে হবে আগে! সিনিয়র সাংবাদিকদের যারা এতোদিন এরশাদের সঙ্গে আন্ডারগ্রাউন্ডে আঁতাত করে চলছিলেন তারাও হঠাৎ তখন এরশাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ করে দেন। সংবাদপত্রবিহীন সেই সময়ে আমরা রাজপথের সাংবাদিকরা টিংকু ভাইদের পরামর্শে আন্দোলনের বুলেটিন পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেই। জিগাতলায় সাপ্তাহিক খবরের কাগজের অফিসে একদল, আরেকদল পুরানা পল্টনে সাপ্তাহিক পূর্বাভাস পত্রিকার অফিসে লিখতে বসে গেলাম! লেখা-কম্পোজ-পেস্টিং শেষ, কিন্তু পত্রিকা ছাপাবো কোথায়? এরশাদের ভয়েতো ছাপতে রাজি হচ্ছিলো না কোনো প্রেস! খবর পেয়ে টিংকু ভাই এসে সেলোফিন নিয়ে গেলেন! আরামবাগের একটি বন্ধ প্রেস খুলে ছাপার ব্যবস্থা করলেন! বাইরে পাহারায় থাকলো তার বাহিনী! পত্রিকাবিহীন সেই সময়ে আমাদের লেখা ‘বিদ্রোহ আজ বিপ্লব চারদিকে’ আন্দোলনের বুলেটিন মূহুর্তের মধ্যে হটসেলে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল!
খালেদা জিয়ার আমলে চালু হয় আরেক স্বৈরাচার! যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ফাঁসির দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃ্ত্বে গণআদালত বসাতে দেবেন না খালেদা জিয়া! বাধার দেয়াল ভাঙ্গতে আমাদের কাজ চলতে থাকে। সেগুনবাগিচায় প্রিয় প্রজন্মের অফিস তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলনের ভ্যানগার্ড তরুণ সাংবাদিকদের হেডকোয়ার্টার! গোলাম আযমের ফাঁসির রায় নিয়ে আমরা টেলিগ্রাম প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছি শুনে আবার সেখানে হাজির টিংকু ভাই! শেখ হাসিনা তখন ধানমন্ডির বত্রিশ নাম্বার বাড়িতে থাকেন। সে বাড়ির কম্পিউটারেই কম্পোজ হয় গণআদালতের রায়। একটা সিডিতে এর একটা কপি নিয়ে আসেন টিংকু ভাই। গণআদালতের রায় ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যে প্রিয় প্রজন্মের টেলিগ্রাম সংখ্যা পৌঁছে যায় সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে! সবাইতো অবাক! টিংকু ভাইর সাহায্য ছাড়াতো তা সম্ভব ছিলো না।
সেই মানুষটিই আজ চার বছর নেই! আব্দুর রাজ্জাক যখন লন্ডনের হাসপাতালে চিকিৎসাধী্ন, টাকার সমস্যায় তার চিকিৎসা হচ্ছিলো না, আমার তখন টিংকু ভাইর কথা মনে পড়ে। জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু, মোজাম্মেল বাবু, তারিক সুজাতরা থাকতে রাজ্জাক ভাইর চিকিৎসার টাকার ব্যবস্থা হবে না কেনো? তখন শুনি টিংকু ভাইও কঠিন রোগে আক্রান্ত! হতবাক হয়ে যাই। চোখ ভিজে আসে। এরপর একদিন এই আজকের দিনে চলে গেলেন টিংকু ভাই! সারাদিন কোনো কাজে মন বসাতে পারিনি! কত কথা বলা হয়নি প্রিয় টিংকু ভাই। বলা হয়নি কত কৃতজ্ঞতার কথা! ভালো থেকো। এই দূর প্রবাস থেকে অব্যক্ত কান্নার সঙ্গে এই কামনাটুকুই আজ জানিয়ে গেলাম। আমিও কিন্তু টিংকু অ্যান্ড কোং’এর একজন ছিলাম প্রিয় প্রজন্ম।
(এ
বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর
সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)