দেশের শিক্ষিত তরুণদের একটি অংশ সরকারি চাকরি শুরুর সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ এর পরিবর্তে ৩৫ করার দাবি জানাচ্ছে। তাদের যুক্তি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন জট, কোটাধারীদের বয়স সীমা ৩২ হওয়ায় এবং প্রস্তুতি নেয়ার যথেষ্ট সময় হাতে থাকে না। তবে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, বয়সসীমা বাড়ানো হবে না। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর যুক্তির পরও চাকরি শুরুর বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিকারীরা সামাজিক মাধ্যমে সরব রয়েছেন। বয়সসীমা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ বছরে উন্নীত করার দাবিতে শাহবাগ চত্বরে ১৪ মে সকাল ১০ টায় সমাবেশের ডাকও দেয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে চাকরি শুরুর বয়সসীমা নিয়ে পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের মন্তব্য জানতে সামাজিক মাধ্যমে জরিপ চালায় চ্যানেল আই অনলাইন।
চ্যানেল আই অনলাইনের’র ফেসবুক পেইজে জানতে চাওয়া হয় ‘কেনো চাকরি শুরুর বয়স সীমা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ করা উচিৎ’। শুধু মন্তব্য নয় মন্তব্যের সপক্ষে ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়। এই পোস্টে ৫মে রাত ১১ টা পর্যন্ত মোট ৬’শ ৫ টি মন্তব্য আসে। তাতে দেখা যায় হাতে গোনা কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীর যুক্তির সঙ্গে একমত পোষণ করলেও বেশিরভাগ মন্তব্যকারীই চাকরি শুরুর বয়সসীমা বাড়ানোর পক্ষে। তাদের এই অবস্থানের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশন জট।
বেশিরভাগ মন্তব্যকারীই জানান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ বছরের অনার্স কোর্স শেষ করতে সময় লাগে ৬-৭ বছর। নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে সেশনজটের চিত্র তুলে ধরেন অনেক মন্তব্যকারী।
জাহিদ লেমন নামে একজন মন্তব্য করেন,“জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০১১ সালের ৪ বছরের স্নাতক সম্মান কোর্সের রেজাল্ট পাবলিশ করেছিল ১৮মে, ২০১৪ সালে। এবং সেই বছরের জুলাই থেকে সনদ প্রদান করেছিল (সাড়ে ৩ বছর গায়েব)। তাছাড়া ২০১২ সালের মাস্টার্স কোর্সের রেজাল্ট পাবলিশ করেছিল ২৮ ডিসে ২০১৫ ইং এবং সনদ প্রদান করছে চলতি বছর (২০১৬ সালের) এপ্রিল থেকে ( চার বছর গায়েব)। তারপরও কি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছর করার জন্য আর কোনো যৌক্তিকতা তুলে ধরার প্রয়োজন আছে কি?”
মন্তব্যকারীদের অনেকেই কোটাধারীদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ করা এবং সরকারি চাকরিজীবীদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর সমালোচনা করে।
হেলাল হোসাইন নামের একজন মন্তব্য করেন,“ চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো মানে চাকুরি দেওয়া নয়, সরকার কথায় কথায় উন্নত দেশের উদাহারণ টানে সেখানে কোন বয়সসীমা নেই, যারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ বছরের কোর্স ৮ বছরে শেষ করেছে তাদের উপায় কি? আপনারা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের কোটা রেখেছেন সেটা দরকার আছে, কিন্তু নাতি-নাতনীদের জন্য কেন? আর তাদের বয়স ৩২বছর কেন? আপনারা বলছেন মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, তাহলে চাকুরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ালে সমস্যা কি? আমরা চেয়ারম্যান, এমপি, মন্ত্রী হতে চাই না, সামান্য চাকুরির পরীক্ষা দিতে চাই সে সুযোগ কেড়ে নিলে আমরা যাবো কই?”
জান্নাতুল ফেরদাউস মন্তব্য করেন,“সরকারী চাকরিজীবীদের অবসরে যাওয়ার সময় কয়েকদফা বাড়ানো হয়েছে তবে কেন প্রবেশের বয়স সীমা বাড়বেনা? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স মাস্টার্স শেষ করতে করতে বয়স হয়ে যায় ২৭/২৮ বছর। তারপর এই দুই-তিন বছর সরকারী চাকরিতে এপ্লাইয়ের সুযোগ এ তো এক প্রকার প্রহসন”।
চাকুরি শুরুর বয়সসীমা ৩৫ কেনো করা হবে তা জানতে চেয়ে করা পোস্টটিতে যুক্তির পাশাপাশি দাবিকারীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্যে হতাশা প্রকাশ করা হয়। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক মন্তব্যকে ‘প্রহসন’ আখ্যা দিয়ে সমালোচনাও করে বেশ কয়েকজন মন্তব্যকারী।
তানভীর খান নামের একজন লিখেছেন,“ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,আপনি সংসদে বলেছেন ২৩ বছরে মাস্টার্স শেষ হয়।দেশের শিক্ষা প্রতিষ্টানগুলোতে এখন কোন সেশনজট নেই। চাকরি পাওয়ার জন্য ৬-৭ বছর যথেষ্ট সময়। মানলাম চাকরি পাওয়ার জন্য ৬-৭ বছর যথেষ্ট সময়। হ্যাঁ,আমরা আপনার করুনা চাইনা। আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার ঐ ৬-৭ বছরই চাই। আমার মাষ্টার্সের পাশের বছর ২০১০, অথচ রেজাল্ট প্রকাশ হয় ২৯ এপ্রিল ২০১৩।এই তিন বছর চারমাস ফিরিয়ে দিন। আপনি বলেছেন ২৩-২৪ বছরে আমাদের মাষ্টার্স শেষ হয়। তাহলে কেন শিক্ষা জীবনের কোন পরীক্ষায় ফেল না করে আমি এবং আমার অনেক সহপাঠীদের সাড়ে সাতাশ বছরে চাকরির দুর্বিষহ বাজারে নামিয়ে দিলেন। আপনার মতে যেখানে ৭ বছর সময় পাওয়ার কথা সেখানে কোন দোষে আমরা মাত্র আড়াই বছর সময় পেলাম? আপনি এই আড়াই বছরে কতজন চাকরি প্রার্থী ছিল, আর মধ্যে কতজনকে চাকরি দিয়েছেন? আবার এই আড়াই বছরের মধ্যে এমন ও সময় গেছে আমরা ৮-৯ মাসে ও কোন চাকরির সার্কুলার পাইনি। আমরা কোন অনুকম্পা চাইনা, আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই”।
হাফিজ উদ্দিন নামের আরেকজন মন্তব্য করেন,“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি বলেছেন ‘ বর্তমানে ১৫/১৬ বছরে এসএসসি পাস করে শিক্ষার্থীরা ২৩ বছরে মাস্টার্স পাস করে ফেলছে। ফলে পড়াশুনা শেষ করতে ২৪-২৫ বছরের বেশি লাগে না। এরপরও চাকরির জন্য তাদের হাতে আরও অনেক সময় থাকে ‘
আমরা আপনার কাছে সেশন জটের ভয়াবহ নিখুঁত চিত্র তুলে ধরতে চাই: বাংলাদেশের কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন জট মুক্ত নয়। ছাত্র ও শিক্ষক অনুপাতে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের রিপোট অনুযায়ী ৮৭% শিক্ষর্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধীনে অধ্যয়নরত। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, সেই সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়টিও সেশন জট মুক্ত নয়। তার জ্বলন্ত-প্রমাণস্বরুপ গত ৫ বছরের চিত্র তুলে ধরা হলো:
২০০৮ সালের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষায় সেশন জট ছিল ২ বছর ১১ মাস ১৮ দিন। ২০০৯ সালের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষায় সেশন জট ছিল ৩ বছর ১ মাস ০৬ দিন। ২০১০ সালের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষায় সেশন জট ছিল ৩ বছর ১২ দিন। ২০১১ সালের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষায় সেশন জট ছিল ৩ বছর ২ দিন।উল্লেখ্য যে, ২০১৩ সালের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা শুরু ২০১৬ সালের ১৭ মে। এখন প্রশ্ন রয়ে যায় ২০১৪, ২০১৫ এবং ২০১৬ সালের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা কবে অনুষ্ঠিত হবে? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯৬% শিক্ষার্থী সেশন জটে আক্রান্ত এবং ৪% শিক্ষার্থী সেশন জট মুক্ত। তাহলে প্রশ্ন হলো শুধু ৪% কি বিচারের মানদণ্ড হতে পারে?”
কয়েকবছর ধরেই চাকুরি শুরুর বয়সীমা নিয়ে বিভিন্ন ব্যানারে আন্দোলন চলছে। সেগুলোর মধ্যে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদ’ একটি। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদের সভাপতি ইমতিয়াজ হোসেন আন্দোলনকারীদের ফেসবুক পেইজে লিখেছেন,“আমাদের মনে হচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ভুল তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। যেখানে একজন ছাত্রের অনার্স/মাস্টার্স শেষ করতে ২৮/২৯ বছর লেগে যায় সেখানে কিভাবে ২৩ বছরে মাস্টার্স শেষ করার কথা বলেন মাননীয় প্রধান মন্ত্রী? তাই আমি সবাইকে আহব্বান জানাব ১৪ মে ২০১৬ রোজ শনিবার সকাল ১০ টায় শাহবাগ চত্বরে আসুন। আমরা সেশন জটের ভয়াবহের নিখুঁত চিত্র এবং চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ করার যৌক্তিকতা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরব মহাসমাবেশের মাধ্যমে”।
জাতীয় সংসদে বুধবারের প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা যুব বয়সের মেধাশক্তিকে কাজে লাগাতে চাই। এজন্য আমরা চাই সকলে সময়মতো পড়াশুনা করে চাকরিতে প্রবেশ করুক। এজন্য চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ থেকে বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই।”
বগুড়া-৬ আসনের সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম ওমর এক সম্পূরক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ বছরের বেশি বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?
এই প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী ‘পরিকল্পনা নেই’ জানানোর পাশাপাশি কেন নেই, তার ব্যাখ্যাও দেন, “৩০ বছর পার করলে তো কেউ যুবক থাকে না। এরপর তো সবাই প্রৌঢ় হয়ে যায়। মাননীয় সংসদ সদস্য ওই প্রৌঢ়দের জন্য চাকরির ব্যবস্থার কথা বলছেন কি না, বুঝতে পারছি না। কারণ ৩০ বছরের পর চাকরি হলে সেটা তো যুবকের জন্য চাকরি হবে না, প্রৌঢ়দের জন্য হবে। ”
প্রধানমন্ত্রী এই দাবি মেনে না নেওয়ার যুক্তি হিসেবে বর্তমানে শিক্ষা ক্ষেত্রে সেশনজট না থাকার বিষয়টিও তুলে ধরেন।
“বর্তমানে ১৫/১৬ বছরে এসএসসি পাস করে শিক্ষার্থীরা ২৩ বছরে মাস্টার্স পাস করে ফেলছে। ফলে পড়াশুনা শেষ করতে ২৪-২৫ বছরের বেশি লাগে না। এরপরও চাকরির জন্য তাদের হাতে আরও অনেক সময় থাকে।”
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ঢোকার বয়সসীমা শুরুতে ২৮ বছর ছিল। পরে তা দুই বছর বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়। গত কয়েক বছর ধরে একদল শিক্ষার্থী চাকরিতে ঢোকার বয়স ৩৫ বছর করার দাবি জানিয়ে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে।