ব্রান্ডিং পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠছে দেশের নানা প্রান্তে। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ডাকাতিয়ার বিশাল মোহনার চাঁদপুরে এমনই একটি পর্যটন প্রান্তর গড়ে তোলা হয়েছে ঠিক মোহনার ধারেই। বড় নরম পাললিক তীর। ভেঙে যায়, ভেসে যায়। তাই পাথরবন্ধনী। ওখানে দাঁড়াবেন। মন ভেসে যাবে দূর দিগন্তে, চরাচরে। পৃথিবীতে বোধ করি এমন পর্যটন বিন্দু আর নেই।
না, চাঁদপুর আমার জন্মভূমি বলে পক্ষপাতের অক্ষর গড়ছি না। সুপ্রিয় পাঠক, চাঁদপুর রেলওয়ে সীমান্ত স্টেশন, বড় স্টেশন যার নাম, তা পৃথিবীর অন্যতম গণহত্যা-বধ্যভূমি হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে। চাঁদপুরসহ বৃহত্তর কুমিল্লা-নোয়াখালীর অগণিত বাঙালিদের প্রতি রাতে বেয়োনেটে-বুলেটে নিঃশেষ করে পাথুরে বন্ধনের ওপারে মেঘনাগভীরে অন্তিম ঠিকানা গড়ে দিতো পৃথিবীর অন্যতম বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। নদীমাতৃক বাংলাদেশ তাই ঊনিশশত একাত্তরে হয়ে গেলো রক্তমাতৃক। চাঁদপুরের ব্রান্ডিং পর্যটন কেন্দ্রটি মোহনা কিনারে ‘রক্তধারা’ নাম বহন করে গড়ে উঠেছে। শেষ বেলায় আসবেন ওখানে? হাজার হাজার মানুষ। নদীর পাড়ে, গাছে গাছে আলোর শিল্পিত আয়োজন। মন ভালো হয়ে যাবে। ফের রক্তধারা ভাস্কর্যস্থাপনায় মন কাঁদবে। মায়ের সন্তানেরা যে কাঁদতে জানে, ফের হাসতেও জানে। পৃথিবীতে এমন রক্তমোহনা রক্তধারা বধ্যভূমি পর্যটন প্রান্তর আর কোথা আছে!
শেষ বিকেলে নয়, সকাল দশটার ওই ‘রক্তধারা’ পর্যটন পয়েন্টে আমরা চারজন কিছু সময় কাটালাম। ৩ এপ্রিল ২০১৯। ঠিক ৪৮ বছর আগের ১৯৭১ সনের ৩ এপ্রিল। তখন রোমহর্ষক পঁচিশে মার্চের কালরাত্রি-উত্তর বাংলাদেশ। সুপরিকল্পিত ছক অনুযায়ী একের পর এক শহর দখলে হানাদার অভিযান। প্রতিটি অঞ্চলে কার্যত সামরিকভাবে নিরক্ষর লক্ষ লক্ষ প্রতিরোধী বাঙালি। বিপরীতে সামরিক হিংস্রতার বিশাল অস্ত্রভাণ্ডারের প্রশিক্ষিত হানাদার বাহিনী। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রতিরোধ করছে মানুষ। কিন্তু সে তো কিছু নয়। চাঁদপুরের ছাত্র ইউনিয়নের তরুণেরাও প্রতিরোধের উপায় নিয়ে ভাবছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নশাস্ত্রের একজন চাঁদপুরী ছাত্র তখন চাঁদপুরে। দ্বিজেন তার নাম।
বোমা বানাবার বুদ্ধি আর উপকরণের সন্ধান দিলো দ্বিজেন। বর্তমান বালুর মাঠ তখা ট্রাক স্ট্যান্ডের সাথে শংকরদের পোদ্দার বাড়ির মন্দির। সেই মন্দিরের এক কুঠুরীতে শুরু হলো বোমা বানাবার দৃপ্ত আয়োজন। একটির পর একটি। হঠাৎ সুশীলের হাত থেকে একটি বোমা পড়ে গেলো উৎসাহের গতিবেগে। বিস্ফোরিত হলো সব বোমা একসাথে। কালাম-সুশীল-খালেক-শংকর সবার রক্তমাংস একাকার হয়ে গেলো। প্রাণ গেলো সবার। জন্মগত ধর্ম পরিচয়কে এভাবে উহ্য করে অসাম্প্রদায়িক এক মাতৃভূমির মুক্তির জন্য অসাম্প্রদায়িক আত্মদানে অন্তিম ঐক্য গড়ার উদাহরণ গড়ে উঠলো ৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে। চাঁদপুরে। সে অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে একসাথে শহীদ হলেন চারজন। প্রথম শহীদ। স্বেচ্ছায় সচেতনভাবে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে শহীদ হবার গর্ব এই চারজনের। চাঁদপুরের চার নক্ষত্র। তাদের স্মরণে গড়ে উঠেছে স্মৃতিসৌধ।
শহীদ কালাম-সুশীল-খালেক-শংকর স্মৃতি পরিষদ অনেকদিন ধরেই সক্রিয়। এবারের ৩ এপ্রিল স্মৃতিদিনে হাজির থাকার সুযোগে নিজেকে গর্বিত মনে করেছি। আয়োজকবৃন্দ এক অসাধারণ কাজ করেছেন। সকালের স্মরণ আয়োজনে কয়েকশত অংশীর মাঝে দেখলাম অধিকাংশ স্কুলের ছাত্রছাত্রী। উপজেলা থেকেও এসেছে এবার অনেকে। মুক্তিসংগ্রামের আদর্শ প্রজন্ম পরম্পরায় ছড়িয়ে দেবার আন্তরিক আয়োজন। দিনের সব কর্মসূচিতেই তার ছাপ। শহীদ কালামের বাড়িতে তার ছিন্নভিন্ন মরদেহের অন্তিম সমাধি, কল্যানদি গ্রামে। সেই সমাধিতেও গেলাম। ৪৮ বছর পরেও এভাবে মুক্তিযুদ্ধের অনুভবে স্নাত হবার সুযোগে ধন্য হলাম।
তবুও বলবো, চাঁদপুর তার এই চার নক্ষত্র শহীদ, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদের মতো অপরূপ সম্পদের প্রতি যথাযথ যত্নবান হয়েছে কী? চাঁদপুর একজন ‘মুক্তিযোদ্ধা’ প্রধানমন্ত্রী পেয়েছিলো একসময়। তারপরও মন্ত্রী কম পায়নি। এখনও একজন ক্ষমতাসীন আছেন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনার প্রথম চার শহীদ চাঁদপুরের ইতিহাস-আকাশে চার নক্ষত্র হয়ে জ্বলজ্বল করছে। তাদের স্মৃতিসৌধে ৩ এপ্রিল, ২০১৯-এ মুক্তিযুদ্ধের সরকার, মুক্তিযুদ্ধের প্রশাসনের কাউকে দেখিনি। এই স্মৃতিসৌধে সম্প্রসারিত, সুন্দর করার জায়গা ও সুযোগ রয়েছে। সম্প্রসারণের জমি নিয়ে আবেদন জেলা প্রশাসনে ফাইলবন্দী অনেককাল। শহীদ চার নক্ষত্র চাঁদপুরের নানা সমাধি থেকে ওই ফাইলের পানে নিথর তাকিয়ে আছেন। যে মহান মুক্তিযুদ্ধের মর্মবস্তু আমাদের পাথেয়, শহীদেরা সে পথ রচনা করে গেছেন। আমরা যেন তার যথাযথ মূল্য দিই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)