বাপ্পারাজ। চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়ক ও নির্মাতা। সম্প্রতি তার কিছু মন্তব্যকে ঘিরে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি ও নায়করাজ রাজ্জাকের এই ছেলের মধ্যে চলছে শীতল সম্পর্ক। চলছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। এ ব্যাপারে আজ বুধবার দুপুরে গুলশানে তার বাসায় চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বাপ্পারাজ বলেছেন নানা কথা।
চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির পাঠানো নোটিশ নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?
নোটিশে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হওয়া বক্তব্য নিয়ে বলেছে। আসলে আমি কিন্তু খারাপ কিছু বলিনি। হয়তো বোঝার ভুল অথবা জ্ঞানের অভাব, এজন্য বিষয়টি তারা বোঝেনি। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতিকে নিচু করে কোনো কথা বলিনি।
কী বলেছিলেন?
তারা সবার উপরে, তারা চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে।—এ কথা বলেছি। অথচ তারা বলেছে, আমি নাকি তাদের মানহানি করেছি। তারপর আমি মনতাজুর রহমান আকবর ও বদিউল আলম খোকনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি। বিষয়টা সেখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত, কিন্তু ১৫ দিন পর আমাকে টেলিফোনে বদিউল আলম খোকন বললেন যথাযথ কারণ দর্শান, নয়তো সদস্য বাতিল করে দিব।
আপনি কী বললেন?
বাতিল করে দেন। সদস্য হিসেবে সমিতিতে জমা দেওয়া আমার ৫০,০০০ টাকা ফেরত দিয়ে দেন। কারণ আমি সমিতি করে আমি খাই না। সমিতিতে থাকা না থাকায় আমার কিছু আসে যায় না। এটা ওনাদের জন্য হয়তো অনেক বড় ব্যাপার হতে পারে। কারণ সারাদিন বসে থাকে সমিতির অফিসে। সকালবেলা যায় স্কুলের মতো, সারাদিন বসে থাকে, সিঙ্গারা খায়, চা-পানি খায়, ভাত খায় এবং বিকালে ১০০ টাকা নিয়ে চলে আসে। আমার তো আর এটা দরকার নাই।
সমিতির এক্সিকিউটিভ মিটিং নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন আপনি?
তুলব না, কী বলেন! মিটিংয়ে কী হয়? খালি প্রশ্ন তোলে। এ আসে কেন, ও আসে না কেন। সবার তো কাজ আছে তাই না? সারাদিন বসে থাকে বেকার লোকেরা। এমন লোকও আসে, যারা গত ১০ বছরেও ছবি বানায়নি। আগামী ইহজনমেও ছবি বানাবে না। অথচ গভর্নিং বডিতে বসে আছে। ফিল্ম ডুবে যাক, কেউ কাজ পাক না পাক, তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। গত কমিটির এক্সিকিউটিভ মেম্বার হিসেবে তাদের এ কাজের সাক্ষী আমি। কথায় কথায় তারা বয়কট করে। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির নেতাদের নতুন শিল্পী তৈরির ক্ষমতা নেই, খালি বয়কট করে।
আপনি জবাব পাঠিয়েছেন?
কেন পাঠাব? আমাকে ওরা যে নোটিশ পাঠিয়েছে, সেটাকেই বৈধ মনে করছি না। তাদের পাঠানো নোটিশের ওপরই আমি লিখে দিয়েছি, আমার সদস্যপদ আমি নিজেই বাতিল করে দেব। আমার প্রদান করা ৫০,০০০ টাকা ফেরত দেন। হয়তো এটা ওরা আমলে নিবে না। তারপর এক সপ্তাহ পর আমার সদস্যপদ বাতিল করার নোটিশ দেবে। এতে আমার কিছু যায় আসে না।
কেন?
সমিতিতে বসে বসে একে ওকে বয়কট করে। বয়কট করলে সমস্যার সমাধান হবে? যাদেরকে বয়কট করছে, তাদের সঙ্গে পুরো ইন্ডাষ্ট্রির স্বার্থ জড়িত। বড় কেউ বয়কট হলে তার সঙ্গে জড়িত অন্যদের কী হবে? তারা তো বেকার হয়ে যাবে! এটা তারা চিন্তা করে না। তারা বলে, শিল্পীরা ভোগায় এজন্য একটা সিস্টেমের মধ্যে আনছে। অথচ শিডিউল ফাঁসালে পরিচালক ও প্রযোজক থেকে শুরু করে সবাই যে ক্ষতির শিকার হয়, সেজন্য শিল্পীকে না বলে তারা অন্য কাজে ব্যস্ত। প্রয়োজন মতো খালি বয়কটে ব্যস্ত। তাদের এ কাজ দেখে মনে হয় শিল্পীদের ছাড়া তাদের চলে যাবে।
পরিচালকদের সাধারণ অভিযোগ, শিল্পীরা তাদের অনেক ভোগান।
শিল্পীরা ভোগায় ভালো কথা, যারা ভোগায় তাদেরকে নেন কেন? সমিতিতে একেকজন নিজেদেরকে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন মনে করেন। অথচ ছবি তৈরির সময় ভোগানো শিল্পীদের নেন। যখন সেই শিল্পীরা আবার তাদের হয়রানি করেন, তখন তার পিছে লেগে যান। কেন, পিছে না লেগে একজন নতুন শিল্পী তৈরি করেন। শাকিবকে নিয়ে তো ছবি করার দরকার নেই আপনাদের। বাংলাদেশে আরও অনেক নায়ক আছে, তাদের নিয়ে ছবি বানান। সে মুরোদ তো নেই।
শাকিব খানকে নিয়ে অনেক নির্মাতারই অভিযোগ আছে।
আমি অন্য সবার কথা বলব না। বদিউল আলম খোকন তো শাকিবকে নিয়ে একটার পর একটা ছবি বানিয়েছেন। শাকিব তাকে ভোগালো, তখন তার পেছনে লাগলেন। কেন দেশে অন্য হিরোর কি অভাব পড়েছিল? তাদেরকে আপনার নির্মাণ শক্তি দিয়ে তৈরি করতেন। সেটা না করে কেবল একজনের পেছনে ছোটেন। দোষ তো পরিচালকদেরই। যোগ্যতার অভাবে ভালো অভিনয় করা এসব ভোগানো শিল্পীদের পিছু পিছু ছুটতে হয় আপনাদের। আমি দেখেছি, আমার আব্বা যখন নায়ক ছিলেন, তখন তো সোহেল রানা, আলমগীর, ওয়াসিমরাও ছিলেন। সে সময়ে ওনারা সবাই ব্যস্ত ছিলেন। তাদের সবাইকে নিয়ে সে সময়ের পরিচালকরা ছবি বানাতেন। আর সেগুলো সুপার ডুপার হিটও হতো। আর আপনারা একজন শাকিব খানকে নিয়েই বসে আছেন। সে ভোগালে আর কোনো ছবিই আপনাদের কাছ থেকে আসে না। অথচ আপনারা বলে বেড়ান, আপনারা বিশ্ব জয় করে ফেলেছেন। এরকম ভুয়া লোকদের কারণে আজ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি আর এই ইন্ডাষ্ট্রির এমন বাজে অবস্থা!
চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে, আপনি মিটিংয়ের কথা নাকি বাইরে বলেছেন।
আমি এখনো বলিনি। সমিতি আমাকে যে হারে খোচাচ্ছে, তাতে আমি এখন বলব ভেতরে আসলে কী হয়! কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়! একজন পরিচালককে সদস্য করার পর থেকে এই সমিতির কোনো দায়-দায়িত্ব থাকে না। নতুন পরিচালকের অনেক কিছুই দরকার হয়। তারা এগুলো কিছুই দেখে না। টাকা নিয়েই তারা খালাস। টাকাও নেয় মক্কেল বুঝে। সব কিছু আমি জানি। এতদিন বলি নাই, এখন বলব। ভেতরে কী কী হয়, আরও অনেক কিছু আছে, সব বলব। এক শাকিব খানকে ডুবানোর জন্য এফডিসিসিতে সব সমিতি এক হয়ে গেল। অথচ এরা ফিল্মের উন্নয়নে কাজ করছে না। পুরো এফডিসিতে ফিল্মের শুটিংয়ের পরিবর্তে রিয়েলিটি শো, গানের অনুষ্ঠান আর টিভির নানা অনুষ্ঠান হচ্ছে। এ বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই।
চলচ্চিত্র সমিতিতে সদস্যপদ না থাকলে ছবি বানাবেন কীভাবে?
আমি স্বাধীন দেশের নাগরিক। সরকারকে ট্যাক্স দেই। আমি ছবি বানাব। সেটা প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনও করব। আমার ছবি চলবে কি চলবে না, সেটা দেখবে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড। আমাকে দেখবে তথ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি এফডিসির মধ্যে সম্পূর্ণ অবৈধ একটা বিষয়। কারণ জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার (কেপিআই) মধ্যে কোনো সমিতি থাকতে পারে না। তারা স্টাডিরুমের মতো করে সেখানে সমিতির অফিস বানিয়ে বসে আছে। এফডিসির মধ্যে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি আইনসিদ্ধ কোনো প্রতিষ্ঠান নয়।
চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি কোনো ফিডব্যাক দেয় না?
কোনো ফিডব্যাক দেয় না। সমিতির সদস্য হয়ে লাভ কী তাহলে? এজন্য এরা একটা সিস্টেম করে নিয়েছে, সদস্য না হলে ফিল্ম বানাতে পারবেন না। এটা একটা ভুয়া কথা। পৃথিবীতে এমন কোনো সংগঠন নেই, যেখানে কাজটা করার আগেই সদস্য হওয়া লাগবে। এমনকি চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সদস্য হতে চাইলে ফিল্ম মুক্তির পর সদস্যের জন্য আবেদন করে। অথচ সমিতির সদস্য হয়ে এই নতুন পরিচালকরা কে কারওয়ান বাজারে মাছ বিক্রি করছে, কে আমিন বাজারে আলু বিক্রি করছে—এসব নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। এমন অনেক সদস্য আছে, যারা কাকরাইলে নতুন নতুন ছেলেমেয়েদের ছবিতে অভিনয় করার কথা বলে নানা ভাবে প্রতারণা করছে। এগুলো যখন মানুষ বলে, তখন ওনাদের লজ্জা হয়না। অথচ আমরা যখন ভালো কথা বলি, তখন ওনাদের লেগে যায়।
আপনি ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে এসব কথা বলছেন?
একদম না। কারও সঙ্গে আমার কোনো ব্যক্তিগত বিরোধ নেই। বর্তমান কমিটির মহাসচিব বদিউল আলম খোকন কত অশ্লীল ছবি বানিয়েছেন! এজন্য তিনি নিষিদ্ধও হয়েছিলেন। অথচ তিনি সমিতির সদস্যদের বলেন, তারা একটা এলিট সমিতি। অথচ তিনি এই সমিতির মহাসচিব। আমরা যখন তার ও এই সমিতির অন্যদের অপকর্মের কথা বলি, তখন ওনাদের খুব গায়ে লেগে যায়।
নির্দিষ্ট করে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির কোনো দুর্নীতির কথা বলতে পারবেন?
অনেক দুনীতির কথাই জানি চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির বর্তমান কমিটির। সদস্যদের কাছ থেকে যে টাকাগুলো নেয় সমিতি, সরকারকে কিন্তু তা থেকে কোনো ট্যাক্স দেয় না। এখানে কোনো অডিটও হয়না। সরকারও জানে না এই সমিতি আয়–ব্যয় সম্পর্কে। আমার বাবা এতদিন ধরে ইন্ডাষ্ট্রিতে আছে, তার ছেলে হিসেবে একজন অভিনেতা হিসেবে তো আমাকে কনসিডার করা যেত। অথচ আমার কাছ থেকে ৫০,০০০ টাকা নেওয়া হয়েছে। কেন? আমার কাছ থেকেই যদি এত টাকা নেয়, তাহলে সাধারণের কাছ থেকে কত টাকা নিচ্ছে, চিন্তা করেন। একজন মহিলা সদস্যপদ নেওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। তার কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। মক্কেল বোঝে তারা টাকা আয় করছে। যেটা সম্পূর্ণ অবৈধ।
সমিতি থেকে বলা হয়েছে, এর আগেও নাকি আপনার সদস্যপদ বাতিল হয়েছে। পরে বিশেষ বিবেচনায় আবারও সদস্যপদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আমার সদস্যপদ বাতিল হয়নি। গভর্নিং বডি থেকে আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। আমি তো বেকার না। আমি তিনটা মিটিংয়ে যাই নাই, না যাওয়ার জন্য এ পদ বাতিল করেছিল।
সেন্সর বোর্ডে ছবি জমা দিতে গেলে সমিতির অনুমোদন নিতে হবে?
সেটা নিয়ে এখন আমরা সরকারের সঙ্গে কথা বলব। ছবি নিয়ে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি নো অবজেকশন দিবে, তাদের যোগ্যতা কী? তার মানে আমরা সরকারের অধীনে আছি, নাকি পরিচালক সমিতির অধীনে?
আপনি বিকল্প কিছু ভাবছেন?
অনেকের সঙ্গে আমার এ বিষয়ে কথা হয়েছে। এমনকি চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির অনেক সিনিয়র শিল্পীর সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। তারা আমাকে সাহস জুগিয়েছেন। আমি কারও বিপক্ষে নই, আমি একটি সিস্টেমের বিরুদ্ধে কথা বলছি।। এটা আমি বলে যাব। দরকার হলে আমিসহ অন্যরা মিলে নতুন একটা পরিচালক সমিতি করব। তবুও এই সমিতির অধীনে আমরা নেই। আমি জানি এ কাজে কারা কারা আমার সঙ্গে থাকবেন।
বলছেন সমিতি ইন্ডাষ্ট্রিকে ক্ষতি করছে।
অবশ্যই। আগে যারা অশ্লীল ছবি বানাতো, তারাই এখন ক্ষমতায় আছে। তারা চাইছে বয়কট বয়কট খেলা করে ইন্ডাষ্ট্রিকে শিল্পী–শূন্য করে অশ্লীল ছবির শিল্পীদের আবার ফিরিয়ে আনতে। অতীতে তারা তাই করেছে। মুনমুন, ময়ূরীদের তারা ফিরিয়ে আনতে চাইছে।
আপনি নতুন কোনো কাজ করছেন?
ঈদের পর থেকে নতুন ছবি তৈরির কাজ শুরু করব।
ছবি: সংগৃহীত