পুরো নাম ফরিদা আক্তার পপি। তবে ঢাকাই সিনেমায় তিনি ‘ববিতা’ নামে পরিচিত। চলচ্চিত্র থেকে দূরে আছেন অনেক দিন। পেছনে তার সোনালী সময়। তিন শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন। কিংবদন্তি এ নায়িকা যেমন অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন, তেমনি বিদেশের মাটিতেও তিনি সম্মানিত হয়েছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদাশীল করার জন্য সম্প্রতি চ্যানেল আই ও ওকে ওয়ার্ল্ড তাকে সম্মাননা দিয়েছে। অনুষ্ঠানের ফাঁকে এই সম্মাননা ও তার গৌরবময় অতীতসহ নানা বিষয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ববিতা।
ক্যারিয়ারে সম্মান জানানোর আয়োজনে নতুন পালক যুক্ত হলো, অনুভুতি কেমন?
আমি তো খুশি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আমার যে অবদান, সেটার জন্যই আজকে আমাকে এই সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। এই সম্মান আমার জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
বিশেষ গুরুত্ব কেন?
আমি চলচ্চিত্র মাধ্যমে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছি। সেটা সে সেক্টরে আমাকে সম্মান জানানো হয়েছে। কিন্তু একদম ভিন্ন একটা প্লাটফর্ম, যেখানে অন্য মাধ্যমের ব্যক্তিত্বদেরও সম্মান জানানো হয়েছে। সেই আয়োজনে আমিও একজন সম্মানিত ব্যক্তি। বিষয়টা আমাকে খুব গর্বিত করে তুলেছে। প্রথমবারের মতো আমাকে ভিন্ন প্লাটফর্মে পুরস্কৃত করা হলো। আমি খুশি এই পুরস্কার পাওয়ায়। চ্যানেল আইকে ধন্যবাদ।
আপনি তো অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন।
আমি পুতুল খেলার বয়স থেকে চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেছি। আমার বোন সুচন্দার স্বামী চিত্রপরিচালক জহির রায়হান আমাকে ‘সংসার’ ছবির মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটান। তারপর একের পর এক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি আর পুরস্কার পাচ্ছি। দেশ স্বাধীনের পর থেকে আমি বিশ্বের অনেক দেশে ঘুরেছি, অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছি। যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই একটি নাম উচ্চারিত হয়েছে। ববিতা বাংলাদেশ, ববিতা বাংলাদেশ। সে সময় আমি বার্লিনে প্রশংসিত হই সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ ছবির জন্য। তারপর ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ ও ফ্রান্সের ‘লা ম দে’ ও ইংল্যান্ডে ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রচ্ছদে আমাকে নিয়ে স্টোরি করা হয়। তবে একটি ঘটনায়ই আমার ক্যারিয়ারে একটি ছবি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে।
কোন ঘটনা?
সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ ছবিটি আমার জীবনের মোড় বদলে দেয়। আমার অভিনীত সত্যজিৎ রায়ের এই ছবি বার্লিন ও শিকাগো চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির পুরস্কার পেয়েছিল। এর জন্য আমি যখন এই দুই শহরে গিয়েছিলাম, তখন অনেক সম্মান করেছিল সেখানকার আয়োজক ও বিভিন্ন দেশ থেকে আসা চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীরা।
ইদানিং চলচ্চিত্রে নানা ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়ে আপনি কিছু বলেন।
এটা স্রেফ ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ছাড়া কিছু নয়। এ বিষয়ে আমি মতামত না দেই। শুধু বলব আমাদের সময়ে এমনটা ছিল না।
চলচ্চিত্রের কোন বিষয়টি আপনাকে দুঃখ দেয়?
দেখুন, আমি খুব অল্প বয়স থেকে তো অভিনয়ে আছি। অনেক কিছুই দেখেছি। তবে ইদানিং এফডিসিতে গেলে কান্না পায়। আমার দেখা সেই চলচ্চিত্র এখন যেন কেমন হয়ে গেছে।
কেন কান্না পায়?
কেন কান্না পায় তা তো অনেক বিস্তারিত কথা। তবে বাংলা চলচ্চিত্রের অনেক অধঃপতন হয়েছে। কেন যে হয়েছে, সেটা বর্তমান অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীরা বলতে পারবে। তাদের অনেক কিছু করার ছিল চলচ্চিত্রের জন্য। কিন্তু তারা তা করছে না। কেন তারা করছে না? আমাদের সময় তো আমরা করেছি এবং পেরেছি। এরা চেষ্টা যদিও করে থাকে তবে কেন পারছে না চলচ্চিত্রের উন্নতি করতে। এগুলো খুব কষ্টদায়ক আমার কাছে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো পথ আছে?
অবশ্যই আছে। আমরা আমাদের সময় অনেক কিছু করেছি। আমাদের সেক্রিফাইস ছিল। আমার ঘরে যে ৮০টি পুরস্কার আছে, এগুলো অর্জন করতে আমাকে সেক্রিফাইসিং মন নিয়ে চলতে হয়েছে, করেছিও। কাজ করতে গিয়ে কখনো আমরা অর্থকে প্রাধান্য দেইনি। তাই বলে আমরা অর্থ উপার্জন করিনি? পেরেছি, কিন্তু অর্থটা প্রাধান্য পায় চিন্তায়। ভালো ছবি করতে গিয়ে চিন্তা গিয়ে অর্থ উপার্জন করতে পারিনি প্রায়ই। কিন্তু মনকে সান্তনা দিয়েছি, আহা! একটা ভালো গল্পের ছবিতে অভিনয় করছি। সুভাস দত্তদা ‘বসুন্ধরা’, ‘ডুমুরের ফুল’ ও ‘গলির ধারের ছেলেটি’ ছবিগুলো নির্মাণ করেছেন। তাকে বলেছি, আমাকে পারিশ্রমিক দিতে হবে না। উল্টো আমিই ওনাকে গিফট দিয়েছি। এগুলো করাতে আমার লাভ হয়েছে, দেশ-বিদেশে সম্মান অর্জন করতে পেরেছি। কিন্তু বর্তমান সময়ের শিল্পীদের মধ্যে চলচ্চিত্রের জন্য সেক্রিফাইসিং মানসিকতার বড় অভাব।
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর অস্কার আয়োজনে ছবি পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো অর্জন নেই।
আসলে অস্কার পাওয়ার মতো ছবি নির্মাণ হলে তো এই পুরস্কার পাবে। আমি যেমন ‘দহন’ ছবিটি নিয়ে কার্লোভা ভেরিতে গিয়েছি। সেখানে এই ছবি প্রশংসিত হয়েছে। সেই চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজক বলেছে, তোমাদের এত কিছুর অভাব, তারপরও তোমরা এত সুন্দর ছবি বানাও কীভাবে? তার মানে আমাদের সেই যোগ্যতা আছে, কিন্তু আমরা সেই লেভেলের ছবি এখন বানাচ্ছি না। তাই তো আমরা অস্কার পাচ্ছি না।
এমন কিছু আছে যেটা এখনো পাননি
সব পেয়েছি এক জীবনে। বিশেষ করে দর্শকের ভালোবাসা। তাদের ভালোবাসাই আমাকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করাতে সহযোগিতা করেছে।
বলা হয় জুটি সফল হলে ছবি হিট, এ ব্যাপারে আপনার কী মত?
নিজের ওপর তো অভিনয়শিল্পীদের কনফিডেন্ট থাকা লাগে। জুটি বেঁধে অভিনয় করলে ছবি হিট হবে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। আমার নিজের গুণ থাকতে হবে। আমি সবার সঙ্গে কাজ করব। জুটি কেন? দর্শক জুটি পছন্দ করে করুক।
নতুনদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
যেভাবেই হউক, কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। শুধু অর্থের কথা ভাবলে হবে না। কিন্তু এখন যারা প্রডিউসার এসেছেন, তারা ভাবছেন বোম্বের ছবির মত পাঁচটা গান আর দুটো ফাইট দিয়ে ছবি হিট করবেন। কত টাকা অর্জন করবেন, সেটাই ভাবছেন এখন। এই ভাবনা পরিহার করতে হবে। কাজটা ভালো হলে আর্থিক দিক দিয়েও লাভবান হওয়া যাবে।
ছবি: ওবায়দুল হক তুহিন