স্বরলিপি: দেশসেরা শিক্ষক নির্বাচিত হওয়ায় সিরাজ স্যার আজ সন্ধ্যায় পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। বক্তৃতায় তিনি শুধু কর্তৃপক্ষকে শুভেচ্ছা জানালেন, আর তেমন কিছু বলতে আগ্রহী হলেন না।
এতে সবাই বাহ্ বাহ্ দিলো। বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করার জন্য উপস্থাপকের প্রশংসা পেলেন সিরাজ স্যার। এরপর ফটোসেশনের জন্য যারা অপেক্ষা করছিলো, তাদের অপেক্ষার সময়ও সংক্ষিপ্ত হয়েছিলো।
আলোর ঝলকানি আর সিরাজ স্যারের চোখের কোণায় এক ফোঁটা চিকচিক করা জল, সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে নেমে গেলো। নেমে গেল অন্ধকারের পথ ধরে। নিরবতার সুড়ঙ্গ দিয়ে সিরাজ স্যার ঘুমের রাজ্যে যেতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। মাকড়সার জালের মতো তার চোখে মুখে কি যেন জড়িয়ে যাচ্ছিল আর তিনি হাত দিয়ে তা সরিয়ে যাচ্ছিলেন।
লাল সাইকেল আর মাকে সংসারের প্রধান অবলম্বন মনে করেছেন পুরোটা জীবন। পরিচিত গণ্ডিতে সিরাজ স্যারের আর একটা নাম ‘চিরকুমার’।
মায়ের যত্ন আত্তির অভাব হবে, সেই বিশ্বাসে তিনি জীবনের দ্বিপ্রহর পর্যন্ত বিয়ে করার উদ্যোগ নেননি। মায়ের মৃত্যুর পর বিয়ে করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন- বিয়ে ঠিকও হয়েছিলো কিন্তু বিয়ের দিন তিনি পালিয়েছিলেন।
তিন দিন পর ফিরে আসেন, তবে রক্তাক্ত অবস্থায়। তার মাথা ব্যান্ডেজ করা ছিলো। যারা সিরাজ স্যারকে মারতে চেয়েছিলো তারা আর কেউ সেদিন টু শব্দও করলো না।
সিরাজ স্যারের এক ছাত্র নেহালের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে হয়েছিলো। নেহাল সিরাজ স্যারের প্রিয় ছাত্রদের একজন। কিন্তু বিয়ের পর সে আর স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করলো না। শেষ কথা হয়েছিলো বিয়ের আগের দিন।
সিরাজ স্যারের ঘরে এখনো বিয়ের জন্য কেনা বড় লাগেজটি আছে। বাইরে থেকে পেপার মোড়ানো। মাসে একবার খুলে দেখেন, শাড়ি, গয়না, চুড়ি। আবার সেগুলো এলোমেলো করে সাজিয়ে রাখেন। ভেতরে থাকে সব। লাগেজটি সরানোর সময় শব্দ উৎপন্ন করে।
ছোটবেলায় বাবাকে হারানো সিরাজ, বাবার ছায়া পেয়েছিলেন এক পিয়নের কাছে। স্কুলের বেতন, প্রাইভেট স্যারের টাকা, বই কেনা এইসব কখন- কীভাবে শোধ হয়েছে, তা জানা ছিলো না সিরাজের।
পড়ালেখার পাঠ চুকে গেলে সিরাজ যেদিন নিজের হাই-স্কুলের শিক্ষক নিয়োগপ্রাপ্ত হলেন, সেদিনই চাকরি ছেড়েছিলেন আকবর পিয়ন।
সিরাজের সঙ্গে সে কথা বলতেও আগ্রহ প্রকাশ করতেন না। এমনকি সিরাজকে একদিন জানিয়ে দিয়েছিলেন, সিরাজ যেন আর তার বাড়ি না যায়। আর বলেছিলেন- ভালো চায় বলেই সে চায় না সিরাজ তার বাড়িতে যাক।
এই চাওয়ার ভেতর কি ভালো কিছু ছিলো, নির্দিষ্ট করে জানতেন না সিরাজ। তার পরবর্তী জীবনে অনেক রকম অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন। একটা অর্থ পাওয়ার পর, আগের অর্থ অর্থহীন হয়ে পড়তো।
সিরাজ নিজেকে যখন ব্যর্থ মনে করতেন তখন মাটি খুঁড়তেন। খুঁড়তে খুঁড়তে ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত থামতেন না।
মাটি খুঁড়তে খুঁড়তেই সিরাজের কাছে আকাশের থেকে পাতাল বেশি রহস্যময় হয়ে ওঠে। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে একটি লাল পয়সা পেয়েছিলেন সিরাজ। একদিন আকবর পিয়নের ঘরের চালে সেই পয়সাটি ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। পয়সাটি দেখলে মনে হতো পোড়া।
সিরাজের মায়ের মৃত্যুর পর- তিনি একাই যেন, তিন জন হয়ে গেলেন। সে বাড়িতে গিয়ে ডাকতেন ‘মা, খাবার দাও’। এরপর মায়ের ঘরে যেতেন ,গিয়ে বলতেন ‘যা হাত মুখ ধুয়ে নে…’।
তারপর সিরাজের ঘর থেকে পাতিলে চাল ঢালার শব্দ আসতো। পানিতে চাল ধোয়ার শব্দ আসতো। আগুন জ্বালানোর শব্দ হতো। এরপর শোনা যেত সিরাজ স্যার আকবর পিয়নকে বলছেন, ‘চাচা টিফিনে আজ কেডা কেডা পালাইছে তুমি জানো’?
‘জানি। তুই এ নিয়ে মাথা ঘামাস না। আমি হেড মাস্টেরকে কয়ছি’।
‘তুমি দশটা বাজার সাথে সাথে স্কুলের গেট বন্ধ করে দাও ক্যা? পোলাপাইন তোমারে মারবার চায়। উরা তোমার মারবার না পারে, আমার কানমলা দেয়’।
`তুই, স্যার হয়ে যা। তারপর কানমলা ফেরত দিবি’।
কথা শেষ হয়, সিরাজ সফলভাবে স্কুল পালানো কিশোরের মতো হাসেন।
এরপর সিরাজের হাত ধোয়ার শব্দ হয়। ভাত খান। সিরাজ গুনগুন করে মায়ের গাওয়া গান গাইতে থাকেন। সিরাজ আকবর পিয়নের মতো নাক ডাকতে ডাকতে ঘুমাতে যান।
আকবর পিয়নের বাড়িতে তিনি কখনও রাতে ঘুমাননি। সিরাজের মায়ের সঙ্গে আকবর পিয়নের কোনদিন দেখা হয়নি।
সিরাজের মা নাকে দুটি নাকফুল পরতেন। স্বামীর মৃত্যুর পরেও সে তার নাকফুল খুলে ফেলেননি। কিন্তু সিরাজ ছাড়া অন্যকারও সঙ্গে কথা বলার সময় তার মুখ অনেকাংশে ঢাকা থাকত।
সিরাজ মায়ের মৃত্যুর পর নাকফুল দুটি কাচের পাত্রে রেখে দেন। এবং ঘুম থেকে জেগে ওই পাত্রে পানি দেন।
বলেন- ‘কি ফুল, মা’।
নিজেই উত্তর দেন ‘নাকফুল বাবা’।
সিরাজ বলেন, ‘খুলে ফেললে’?
নিজেই উত্তর দেন – ‘না, ওদের একটু বিরাম দিলাম’।
বলে চলেন- ‘বিরাম দরকার হয়। সারা জনমে বিরাম পাইলাম কই। হাঁটলাম একটা ঘরের দিকে। হাঁটলাম আর হাঁটলাম। ঘরের মধ্যে থাইকাও ঘর পাইলাম না’।
সিরাজ থামেন। লম্বা দম নেন। বলেন- ‘ক্যান, বাজানতো তোমার ঘর বানাই দেছে’।
নিজেই বলেন- ‘প্রথমঘর খাইছে নদী। দ্বিতীয় ঘর খাইছে তোমার বাজানরে। দিনরাত গায়ে গতরে খাটা মানুষটা ফোলার রোগ হয়ে মরে গেছে। তোমারে নিয়া সেই দিনটার মধ্যেই ঘুরপাক খাইলাম। ঘর কই, ঘর’।
সিরাজ মায়ের ভূমিকা থেকে বের হয়ে এসে বলে ওঠেন- ‘ঘর কই, ঘর’।
অথচ মায়ের সেই ঘরটা নষ্ট করেছেন নিজেই। চাকরি হওয়ার পর, আকবর পিয়নের বাড়িতে যাওয়া বন্ধ হলে- সিরাজ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ঘরের চাল খুলিয়ে নিয়েছিলেন। মিস্ত্রিরা চালের বদলে চাল, বেড়ার বদলে বেড়া, টিনের বদলে ইট দিয়ে তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলো ঘর।
সেই ঘরের এক রুমে নিজে থাকেন, একঘরে থাকতেন তার মা আর একরুম খালি। বাড়িতে কোনো ছাত্র আসলে ওই খালি রুমেই বসতে দিতেন সিরাজ।
সিরাজ যে ‘বয়েজ স্কুলে’ পড়তেন। তার পাশেই ছিলো ‘গার্লস কলেজ’। জানালা দিয়ে সে কলেজের মেয়েদের বৈশাখে কাঁচা আম ছুঁড়ে দিতেন কলেজের দিকে। ক্লাস এইটে থাকার সময়- এই অভ্যাসের জন্য কান ধরে উঠ-বস করেছিলেন তিনি। যে মেয়ে তাকে কান ধরতে বাধ্য করেছিলো- মেয়েটি সিরাজের কাছে কলেজছাত্রীই রয়ে গেছে। সিরাজ বিশ্বাস করতে চেয়েছেন, মেয়েটি কলেজ পেরোয়নি।
সেবার কান ধরে উঠবস করার কারণে আর কোনোদিন মেয়েদের দিকে কাঁচা আম অথবা মারবেল ছুঁড়ে দেননি সিরাজ।
সিরাজ স্যার সেরা শিক্ষক নির্বাচিত হওয়ার পর, পুরস্কারের ক্রেস্ট মায়ের নাকফুলের পাশে রাখেন।
সিরাজের সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা করতে আসে নেহাল। নেহালের সঙ্গে কথা বলতে রাজী হন না সিরাজ। নেহাল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চ-কর্মকর্তা। যাওয়ার সময় সিরাজ স্যারের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে যায়।
সিরাজের এক ছাত্র বিদেশে থাকে। বিদেশের স্কুলে শিক্ষকতা করে। ছাত্র বিনিময় করতে চায় দুই স্কুলের মধ্যে। চুক্তি হয়ে গেছে- সিরাজের স্কুলের ছাত্ররা সেই স্কুলের পক্ষ থেকে ক্যাপ আর ব্যাগ উপহার পেয়েছে। বড় প্রজেক্টরে বিদেশের সেই স্কুলের ঝকঝকে সব ছবি-ভিডিও সিরাজের স্কুলের শিক্ষার্থীরা দেখেছে। নেহাল নিজে উপস্থিত থেকে এই সব আয়োজন করেছিলো। আয়োজনের শেষে সেরা শিক্ষকের পুরস্কার তুলে দিয়েছে সিরাজ স্যারের হাতে।
সিরাজ স্যার, তার সারা জীবনের সব ছত্রের নাম মনে করতে চান। আটকে যায় কোন কোন নামে, মোহন নতুন ভার্সিটিতে পড়তো। নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে চেয়েছিলো। এক গুলি তার পথের বাঁক বদল করে দিয়েছে। মোহন এখন পঙ্গু। পঙ্গু কোটায় সরকারি চাকরি পেয়েছে। খালি চোখে দেখলে, চোখ বিশ্বাস করে ভালো আছে।
চাঁদাবাজির দায়ে জেলে আছে সিরাজ স্যারের আর এক ছাত্র রুয়েল। বাড়ি-গাড়ি সব আছে, ছেলে মেয়েরা এইসব ভোগ করছে। রুয়েল জেল থেকে আত্মজীবনী লিখছে। রুয়েলের আত্মজীবনীতে আসার চরিত্রগুলোর একটি হতে পারেন সিরাজ স্যার আর তার লাল সাইকেল। এই সাইকেলে চরে সিরাজ স্যারের সঙ্গে অনেক দিন স্কুলে গিয়েছে রুয়েল।
সাইকেলের কথা মনে পড়তেই, সিরাজ স্যার বারান্দায় আসেন। তালা খুলে-সাইকেলটি কোনোমতে ঠেলে উঠোনে নামান। তারপর ঘরের দরোজা বন্ধ করে ঘুমাতে চেষ্টা করেন। সিরাজ স্যার বুকের উপর হাত রাখেন, তিনি সাইকেলের চেইনের শব্দ পান। সিরাজ স্যার বুঝতে পারেন- সাইকেলটি কে যেন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত। তারপর শব্দ উধাও হতে থাকে। সিরাজ স্যার চোখ বন্ধ করে একটি বাক্য বলেন।