চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

চরাঞ্চলে সবজি চাষ: অপার সম্ভাবনার হাতছানি 

জামালপুর জেলার বখশিগঞ্জ ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বালুর চর, টেরির চর, মেরুর চর, আমখাওয়া, চখারচরসহ বিভিন্ন চরে এখন সবজির সমারোহ। চারিদিকে শুধু সবজি আর সবজি। চাষিরা যেসব সবজি বেশি করে আবাদ করেছেন সেগুলো হলো-পটল, কাঁকরোল, ঝিঙা, চালকুমড়ো, শসা, লাউ, মিষ্টিকুমড়ো, পুইশাক। এসব সবজি মূলত মাচা পদ্ধতি চাষ করা হয়। এই পদ্ধতিতে আবার একই সাথে মরিচ, ডাটা, ধনেও আবাদ করা হয়।

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চরের জমিতে বৈচিত্র্যময় এসব সবজি চাষ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন চরে বসবাসরত ক্ষুদ্র কৃষকেরা। প্রতিবিঘা জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি উৎপাদন করে বছর অন্তে খরচ বাদ দিয়ে গড়ে তারা ২৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা লাভ করতে পারছেন। তবে শুধু সবজি উৎপাদনই নয়, একই সাথে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং কোনোভাবেই যেন পরিবেশ ও মানবদেহের কোনো ধরনের ক্ষতি না হয়-এ বিষয়েও তারা খুবই সতর্ক ও সচেতন। কৃষকেরা তাই বৈচিত্র্যময় সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন না। পেস্টিসাইড ব্যবহারের ক্ষেত্রে কৃষি অফিসের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করেন।

বখশিগঞ্জের চরে উৎপাদিত বিভিন্ন সবজির চাহিদা এখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। খোদ রাজধানী ঢাকা শহরেও আসছে বখশিগঞ্জের বিভিন্ন চরে উৎপাদিত সবজি। একসময় বখশিগঞ্জের চরাঞ্চলে কেবলই ধান, পাট, গম চাষ করতেন কৃষকেরা। কিন্তু ফলন কম হওয়ার কারণে এবং উৎপাদন খরচ অধিক হওয়ার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৃষকেরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়তেন। পারিবারিক বিভিন্ন চাহিদাও তারা মেটাতে পারতেন না। কিন্তু সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। সবজি চাষ চরের কৃষকদের মুখে অনাবিল হাসি এনে দিয়েছে। সবজি চাষে ভাল লাভ হওয়ার কারণে চরের কৃষকেরা এখন যেমন পারিবারিক চাহিদাগুলো মেটাতে পারছেন, তেমনি সঞ্চয়ও করতে পারছেন।

একই দৃশ্য সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার দুর্গম যমুনার বিভিন্ন চরেও। একদল কৃষক স্থানীয় এনজিও মানব মুক্তি সংস্থা (এমএমএস)-এর কারিগরি সহযোগিতায় গড়ে তুলেছে আধুনিক পদ্ধতিতে মাচায় সবজি চাষ। এই চাষের মধ্য দিয়ে তারা স্বাবলম্বি হবার দুনির্বার স্বপ্ন দেখছেন। চৌহালী ভাঙন কবলিত চর। এই চরের মানুষের দুঃখ সীমাহীন। প্রতিবছরই ঝড়, বন্যায় এই চরের মানুষের নিঃস্ব হতে হয়। সেই নিঃস্বতার মাঝে স্বস্তির পরশ এনে দিয়েছে সবজি চাষ।

পূর্বে চৌহালী উপজেলার চাষীরা গতানুগতিক পদ্ধতিতে কেবল ধান চাষের মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতেন। কৃষকেরা বছরে দুইবার শুধু ধান চাষ করতেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময় আগাম বন্যার করণে ফসল ঘরে তুলতে পারতেন না। এছাড়া বছরের একটা বড় সময় জমি প্রায় অনাবাদি অবস্থাতেই পড়ে থাকত। এ অবস্থায় বেশিরভাগ সময় চরের কৃষকেরা অর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে হতো। কিন্তু এসবে ঢের পরিবর্তন এখন লক্ষ্যণীয়। এসবই সম্ভব হয়েছে কৃষি অফিস এবং স্থানীয় উন্নয়ন সংগঠনগুলোর সহযোগিতার কারণে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অক্সফাম ইন বাংলাদেশের রেজিলেন্স থ্রু ইকোনমিক এপাওয়ারমেন্ট, ক্লাইমেট চেইনঞ্জ এডাপটেশন, লিডারশিপ অ্যান্ড ট্রোনিং (রিকল) প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় বেসরকারি সংগঠন উন্নয়ন সংস্থা চরের কৃষকদের মাঝে কাজ করার ফলে কৃষকেরা সবজি উৎপাদন ও বিপননে বড় ধরনের এক সম্ভাবনার জায়গা তৈরি করতে পেরেছেন। যেখানে জলবায়ুজনিত সব ঝুঁকি সামলিয়ে চরের কৃষকেরা ফসল উৎপাদন ও বিপণন করতে পারছেন। সম্প্রতি চরবেষ্টিত চৌহালী এবং বখশিগঞ্জ ঘুরে এই পরিবর্তনগুলো দেখা গেল। 

বখশিগঞ্জের বগার চর ইউনিয়নের বালুর চরের কৃষক নূর আলী, জিয়ারুলসহ অনেকেই জানিয়েছেন রিকল প্রকল্প তাদের সাফল্যে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। বালুর চরের কৃষক নূর আলী জমির মালিককে ১ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়ে ৩ বিঘা জমিতে সবজি চাষ করেছেন। খুব ভালো সবজি হয়েছে তার ক্ষেতে। সব খরচ বাদ দিয়ে বছর অন্তে লক্ষাধিক টাকা লাভের স্বপ্ন দেখছেন তিন। কৃষক নূর আলী বলেছেন পরিবেশসম্মতভাবে তারা এখন চাষবাস করছেন। তার মতে, আগে কৃষি ও পরিবেশের অনেক সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম বিষয় জানা না ছিল। কিন্তু কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং রিকল প্রজল্পের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক কিছুু জেনেছেন। কৃষক জিয়ারুল জানিয়েছেন, আগে থেকে চাষবাস করলেও নতুন নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা কম ছিল। তবে রিকল প্রকল্পের সাথে সংযুক্ত হবার সিবিও (কমিউনিট বেস অর্গনাইজেশন) করার  পর আধুনিক কৃষি এবং একই সাথে পরিবেশ সংরক্ষণ সম্পর্কে তিনি অনেক কিছু জেনেছেন।

বখশিগঞ্জে বেসরকারি সংগঠন উন্নয়ন সংঘের রিকল প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর জোস্না আক্তার। অনেকদিন ধরে চরের কৃষকদের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করছেন। রিকল প্রকল্প সম্পর্কে তিনি বলেন, এই প্রকল্পের আওতায় চরের চাষীদের শুধু কৃষি উৎপাদনই নয়, পাশাপাশি কীভাবে পরিবেশ সংরক্ষণ করা যায়, পরিবেশসম্মত কৃষির গুরুত্ব, কীটনাশক ব্যবহার না করা, জৈব সার ব্যবহারের গুরুত্ব নানামুখী কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে কৃষকদেরকে এসব বিষয়ে সচেতন করা হয়। নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও ওরিয়েন্টেশন পাওয়ার পর চরের কৃষকেরা এখন অনেক সচেতন এবং দায়িত্বশীল। কৃষকদের এই অগ্রযাত্রা দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ধরনের প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়েছে। তিনি আরো বলেন, জলবায়ুজনিত যে সব ঝুঁকি রয়েছে সেগুলো সম্পর্কেও এখন চরের কৃষকেরা সচেতন। কৃষকেরা জলবায়ুজনিত ঝুঁকি মাথায় রেখে চাষাবাদ করেন যাতে করে নিরাপদে তারা ফসল তুলে বিক্রি করতে পারেন। 

বখশিগঞ্জের চরগুলোতে সবজি উৎপাদনে সাফল্য বিষয়ে বখশিগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল হামিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, সবজি উৎপাদন চরের কৃষকদের মাঝে নতুন এক উদ্দীপনা তৈরি করেছে। কৃষকেরা সবজি বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে আগের চেয়ে অনেক বেশি লাভবান হচ্ছেন। আগে কৃষকেরা ধান উৎপাদন করে খুব একটা সুবিধা খরতে পারতেন না। সবজি চাষ এখন তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এনে দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, কৃষি অফিস চরের কৃষকদের যেকোন ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তত।

এ বিষয়ে বখশিগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ তালুকদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, বখশিগঞ্জে বিভিন্ন চরে পরিবেশ সম্মতভাবে সবজি চাষ বর্তমানে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চরের দরিদ্র কৃষকেরা আগের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে আরো এগিয়ে যাচ্ছে-এটি খুবই ভালো সংবাদ। চরের কৃষকদের আরো উন্নয়নে উপজেলা পরিষদ আগামীতে আরো নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে তিনি জানান।

অক্সফাম ইন বাংলাদেশের পলিসি, অ্যাডভোকেসি, ক্যাম্পেইন অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স ম্যানেজার এস এম মনজুর রশীদ বলেন, দেশের চরের কৃষি অপার এক সম্ভাবনার জায়গা। কিন্তু বহুবিধ কারণেই চরের উন্নতকৃষি ব্যবস্থাপনায় এখনও নানান ধরনের জটিলতা বিদ্যমান। চরের কৃষিসেবা ও ব্যবস্থাপনাকে আধুনীকিকরণের মধ্যে দিয়ে অধিক হারে খাদ্য উৎপাদনের প্রচেষ্টা সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আরো জোরদার করা প্রয়োজন। চরের কৃষিতে অধিক হারে বিনিয়োগ করা হলে দেশের খাদ্যচাহিদার বিরাট অংশ পূরণ করা সম্ভব। তিনি আরো বলেন, চরের কৃষিজমিতে যদি কৃষি বিপ্লব করা সম্ভব হয় তাহলে এটি নিশ্চিত করেই বলা যায় প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের যে পরিমাণ খাদ্য আমদানী করতে হয় তা অনেক কমে আসবে। একই সাথে চরের অতিদরিদ্র মানুষের নিত্য যে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মাঝে বসবাস সেটাও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। চরের কৃষিব্যবস্থার উন্নয়নকে একটি অগ্রগণ্য এজেন্ডা হিসেবে নেওয়া এখন সময়ের দাবি। চরাঞ্চলে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়টিকে জাতীয়ভাবে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।

চরাঞ্চলে মানুষের জীবন জীবিকার প্রধান অবলম্বন কৃষি। বেশিরভাগ চরে ধান, ভুট্টা, পাট, গম, বাদাম, পিঁয়াজ, মরিচ, কুমড়া, টমেটোসহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি উৎপাদিত হয়। চরাঞ্চলে আরেকটি সম্ভাবনার জায়গা হলো গবাদি পশুপালন। কিন্তু দেশের সব চরে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা এবং উৎপাদিত পণ্যের বিপণন প্রক্রিয়ায় এখনো নানাবিধ সমস্যা বিদ্যমান। ফলে চরে যে বিস্তীর্ণ আবাদী জমি রয়েছে সেখানে সেই মাত্রায় অধিক ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ-চরাঞ্চলে নতুন নতুন কৃষিপ্রযুক্তির অভাব, উন্নতমানের বীজের সংকট, উন্নত জাতের ফসল চাষের প্রচলন না থাকা, সেচ সংকট এবং উৎপাদিত পণ্যের সঠিক বিপণন ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা এবং কৃষকদের দ্রুত ঋণ সহায়তা পাওয়ার ব্যবস্থা না থাকা। 

কৃষিতে আমাদের বিরাট সাফল্য থাকলেও এটি সত্য আমরা সব আবাদী জমি অধিক উৎপাদনের আওতায় এখনও আনতে পারিনি। এ ক্ষেত্রে চরাঞ্চলের জমি এবং কৃষক সমাজ অনেক ক্ষেত্রেই অবহেলার শিকার। আধুনিক চাষবাস সুবিধা না থাকায় চরাঞ্চলে কৃষি উৎপাদন আশানুরুপ নয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর তাই চরের কৃষিজমি এবং কৃষকের প্রতি আরো নজর দেওয়া এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে। চরের কৃষি জমিতে অধিক উৎপাদন করতে হলে প্রথমেই চরের কৃষককে বিভিন্ন ধরনের কৃষি সহায়তা, প্রশিক্ষণ, কৃষি প্রযুক্তি প্রদানের বিকল্প নেই। একই সাথে কৃষকদের হাতে স্বল্পমূল্যে উন্নত মানের বীজ সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষককে উদ্বুদ্ধ করতে চরাঞ্চলে বেশি করে কৃষি প্রদর্শণী প্লট করতে হবে-যাতে করে কৃষকরা চরবান্ধব ফসল চাষবাস করতে সবচেয়ে বেশি অগ্রহী হয়।

এছাড়াও কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের ঘন ঘন চরের কৃষকদের সাথে সভা-সমাবেশ করতে হবে। কারণ চরগুলো দুর্গম হওয়ার কারণে কৃষি কর্মকর্তা ও ব্লক সুপারভাইজাররা চর এলাকায় যেতে চান না। এর বাইরে চরের  ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষীদের জন্যে স্বল্পসুদে ঋণ প্রদান এবং সেচ সুবিধাদির ব্যবস্থা করতে হবে। জামালপুর জেলার বখশিগঞ্জ ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা এবং সিরাজগঞ্জ  জেলার চৌহালীর চরগুলোতে বাণিজ্যিক পদ্ধতি সবজি উৎপাদনে যে সফলতা এসেছে সেই অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে পড়ুক অন্যসব চরেও।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)