হাওর আর পাহাড় দুর্যোগের পর কদিন ধরে দেশের উত্তর ও মধ্য অঞ্চলের বড় অংশ জুড়ে শুরু হয়েছে বন্যা। প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বন্যায় এখন সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, বগুড়া, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট জেলার চরাঞ্চল। এর বাইরে আগেই বৃহত্তর সিলেট জেলার বড় অংশ বন্যা কবলিত হয়। বন্যার কারণে গৃহবন্দী বা আক্রান্ত হয়ে আছে কয়েকলক্ষ মানুষ, যারা মূলত চরাঞ্চলের মানুষ। চরেই যাদের স্বপ্ন, জীবন-মরণ আবর্তিত। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী সর্বশেষ এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত বন্যায় ১৩ জেলার ছয়লক্ষের বেশি মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তবে বাস্তবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। কেননা প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এখানে স্মরণযোগ্য যে গত বছর ১৬ জেলার প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছিল। এবারের বন্যা এখনও সেই মাত্রায় পৌঁছায়নি।
জনবসতি প্লাবিত হওয়ার কারণে মানুষ ঘরের বাইরে যেতে পারছে না। রান্না-বান্না করতে পারছে না। স্কুলে যেতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। কয়েকশত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। চরাঞ্চলের যারা নিত্য দিনমজুরি করেন তারা কাজে যেতে পারছেন না। পানি ঘরে ঢোকার কারণে বেশিরভাগ পরিবারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক জায়গাতে ফসল ও সবজির ক্ষেত তলিয়ে গেছে। বিভিন্ন চর ও আশ্রয় কেন্দ্রে খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন বাঁধ ও আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন তাদেরকে সেভাবে ত্রাণ সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে না। ফলে অনেক জায়গাতে বন্যা আক্রান্ত অসহায় মানুষকে চিড়া মুড়ি খেয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। কোথাও কোথাও রোগব্যাধিরও প্রকোপ বেড়েছে। বন্যা আক্রান্ত চরের নারী আর শিশুদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।
বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় নদীবক্ষের চরের মানুষ। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বন্যা এলে স্বপ্নগুলো তাদের দ্রুতই ভেঙেচুরে খান খান হয়ে যায়। পানি বাড়ার সাথে সাথেই উত্তরের যমুনা, পদ্মা, তিস্তা, ব্রক্ষপুত্র নদীতে শুরু হয় তীব্র নদীভাঙন। আর ভাঙন শুরু হলে চরবসতি দ্রুতই নদীতে বিলীন হয়ে পড়ে। গণমাধ্যমে এসেছে এবারের বন্যায়ও বিভিন্ন জেলার অনেক চরই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। তবে পত্রপত্রিকার ছাপা খবর মতে, এবার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি, গাইবান্ধার সদর উপজেলা, ফুলছড়ি, সাঘাটা, জামালপুর জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা, বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলা, কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীসহ বেশ কয়েকটি উপজেলা। বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের উল্লেখযোগ্য চর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। একই অবস্থা ঘটেছে গাইবান্ধা জেলাতেও। এই জেলার সদর উপজেলার কামারজানি, ফুলছড়ির ফজলপুর ইউনিয়নের অনেক পরিবার নদী ভাঙনের কারণে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতরো হয়ে গেছে।
সর্বশেষ তথ্যমতে বিভিন্ন উপজেলার দশ হাজারেরও বেশি পরিবার সম্পূর্ণরূপে গৃহহীন হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ তাদের বাড়িঘর, বাস্তুভিটার কোনো নাম নিশানা নেই। ১৪ জুলাই দৈনিক ইত্তেফাক পেছনের পৃষ্ঠায় লিখেছে ‘খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে বন্যার্তরা। টেলিভিশনগুলোতেও এ ধরনের খবর প্রচারিত হচ্ছে। বিষয়টি মোটেও ভালো নয়। সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন কোথাও খাদ্য সমস্যা নেই, খাদ্যের যথেষ্ট মজুত রয়েছে। এই স্টেটমেন্ট সত্য হলেও বরাবরের মতো এবারও সমন্বয়হীনতা সব জায়গাতে লক্ষণীয়। এ কারণেই অনেক আশ্রয়কেন্দ্রেই খাবার ঠিকমতো যেমন পৌঁছায়নি তেমনি বিতরণও হয়নি। সমন্বয় হচ্ছে না সরকারি এবং বেসরকারি সংগঠনগুলোর মাঝেও। বন্যা আক্রান্ত চরের অনেক মানুষকেই কাঁদতে দেখা গেছে।
দেশের যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় দেখা গেছে সমন্বয়হীনতার চরম অভাব। এবারও সেই অভাব লক্ষণীয়। এবার আরও একটি অভাব লক্ষ্য করা গেছে যে বন্যায় আক্রান্ত মানুষের পাশে দেশিয় এনজিওগুলোর তৎপরতা খুবই কম। অবশ্য নিজ উদ্যোগে বা নিজস্ব ফান্ড সহায়তায় দেশি এনজিওরা কখনও বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে এরকম উদাহরণ কমই রয়েছে। এনজিওরা বরাবরই ক্যাটালিস্ট হিসেবে কাজ করেছে। এনজিওরা তখনই তৎপরতা দেখিয়েছে যখন কোনো আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা তাদের হাতে কাড়ি কাড়ি অর্থ তুলে দিয়েছে। অর্থাৎ দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ফান্ড বা অন্যান্য সহায়তা সরবরাহ করেছে। বিগত দিনগুলোতে বরং দেশি এনজিওদের অনেকেই দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষগুলোর জন্যে বরাদ্দকৃত টাকা প্রকৃতই খরচ না করে নানা অজুহাতে সরিয়ে নেওয়ার উদাহরণ রেখে গেছে। তবে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ডিএফআইডি, নোরাড, সিডা, অক্সফাম, কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড, কেয়ার, অ্যাকশন এইড, সিসিডিবি, ব্রেড ফর দা ওয়ার্ল্ডসহ ইউনিনেফ, ইউএনডিপিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংগঠনগুলো সবসময়ই বাংলাদেশে যে কোনো দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষগুলোর ঘুরে দাঁড়াতে সহযোগিতা করেছে। বরাবরের মতো এবারও বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি সবার আগে বন্যা আক্রান্ত মানুষের সাহায্যে হাত বাড়িয়েছে।
এ কথা সত্য যে, দেশিয় এনজিওদের কাজের নানা সীমাবদ্ধতা যেমন রয়েছে তেমিন সংকীর্ণতাও রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লাভ লোকসানটাও এখন তারা নগদে দেখে। নিজস্ব কর্মএলাকা বা লক্ষিত জনগোষ্ঠী বা উপকারভোগীর বাইরে কেউ আক্রান্ত হলে সেখানে সামান্য সহযোগিতা করার ইচ্ছে তারা কখনই পোষণ করে বলে মনে হয় না। বন্যায় প্রায় দশ থেকে পনেরোটি জেলার বড় অংশ প্লাবিত হলেও এনজিওদের তৎপরতার কোনো খবর নেই। দেশের যে ধনী এনজিওগুলো রয়েছে তারাও নিশ্চুপ রয়েছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবসায় ট্রেডমার্ক হিসেবে পরিচিত ব্র্যাক, টিএমএসএস, আশা, জাগরণী চক্র, ব্যুরো বাংলাদেশসহ বৃহৎ এনজিওগুলো একেবারেই চুপচাপ। অথচ এইসব ধনী এনজিওগুলোর ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা এফডিআর হিসেবে পড়ে আছে। অধিকার, মানবাধিকারের কথা তারাই বেশি বলে। কিন্তু এনজিওগুলোর মাঝেও চরম সমন্বয়হীনতা লক্ষণীয়।
এই সমন্বয়হীনতার অন্যতম কারণ জাতীয় পর্যায়ে এনজিওদের দুটি এসোসিয়েশন এডাব এবং এফএনবির নিশ্চুপ বা নিষ্ক্রিয় থাকা। একসময় এডাবই ছিল এনজিওদের জাতীয় পর্যায়ে একমাত্র সমন্বয়কারী সংগঠন। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বিএনপিপন্থী উন্নয়ন সংগঠনগুলোর নেতারা এডাব ভেঙে এফএনবি তৈরি করেন। এডাব ভেঙে যাওয়ার পর থেকে এনজিওদেও মাঝে চরম সমন্বয়হীনতা চোখে পড়ে। তবে স্থানীয় পর্যায়ের ছোট ছোট এনজিওগুলো বরাবরই বন্যার্ত মানুষের প্রতি সহনশীল। তারাই সর্বপ্রথম স্বল্প শক্তি নিয়ে হলেও বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে কার্পন্য বোধ করে না।
বন্যা হবে এটি আগেই অনুমান করা হয়েছিল। বন্যা এদেশের জন্যে নতুন কোনো বিষয় নয়। বলা যায় প্রতিবছরই রুটিনমাফিক বন্যা আসে। সেই বন্যার তীব্রতা কখনও বেশি থাকে, কখনও কম থাকে। তবে যেভাবেই বন্যা আসুক কয়েকদিন ধরে বন্যা স্থায়ী হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় চরের মানুষ। এবারও একই ঘটনা ঘটেছে। বন্যায় নদী ভাঙনের কারণে কয়েক হাজার মানুষ বসতবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব রিক্ত হয়ে পড়েছে। গতবছর পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল প্রতিবছর অন্তত ৫০ হাজার মানুষ নদীভাঙনের করুণ শিকার হয়। এবারও ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না। বরং বন্যা একটু স্থায়ী হলে আরও বেশি মানুষই গৃহহীন হয়ে পড়বে।
বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর আবার চরবাসী চরেই ফিরে যাবে। নিজ বসতি খুঁজে না পেলে নতুন কোনো চরে গিয়ে আবার বসতি গড়ে তুলবে। আবার শুরু হবে তাদের সংগ্রামী জীবন। কিন্তু তাদের সমস্যা সমাধানের জন্যে কী কোনো দীর্ঘস্থায়ী পন্থা বের করা সম্ভব হবে? বছরের পর বছর শুধু গবেষণা চলছে, সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেই। বুয়েটের বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন জলবায়ু পরিবর্তন, নদীর নব্যতা না থাকা, নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়া বন্যার অন্যতম কারণ। কিন্তু দেশের প্রধানতম নদীগুলোর নব্যতা বাড়ানোর উদ্যোগ কই?
সবশেষে বলবো চর আর হাওরের মানুষের জন্য এবারের অর্থবাজেটে দুই শত কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অনুরোধ রাখবো বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর এই বরাদ্দৃকত টাকা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ চরের মানুষের উন্নয়নে যেন ব্যয় করা হয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)