রাজধানী ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়ে গেল। দায়িত্ব বুঝে নিতে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে নির্বাচিতদের অপেক্ষা করতে হবে মাস চারেক। এ অপেক্ষা বড়ই কষ্টের! তবে উত্তরের মেয়র পদে জয়ী আতিকুল ইসলামের তেমন সমস্যা নেই। তিনি মেয়র পদে রয়েছেন এবং পরবর্তী মেয়াদের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু দক্ষিণে মেয়র বদল হতে চলেছে। বর্তমান মেয়র সাইদ খোকনকে মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ। বিষয়টি তিনি যে খুব উদারভাবে নিয়েছেন, সেটা বলা যাবে না। মেয়র পদে দলের নতুন প্রার্থীর পক্ষে তিনি সক্রিয় ছিলেন, তেমন প্রমাণ মেলেনি। যুক্তি অবশ্য তিনি দিয়েছেন রাজধানী মহানগরীর মেয়রের পদটি মন্ত্রী মর্যাদার। এ প্রটোকল ভোগ করে নির্বাচনের প্রচারে অংশ নিলে সেটা হবে আচরণবিধির মারাত্মক লঙ্ঘন। বরিশাল অঞ্চলে ‘আইনের মানু’ অনেকটা প্রবাদের মতো। আইনের প্রতি অনুগত কিংবা আইন প্রণয়নে বা প্রয়োগে যুক্ত এর দ্বারা এ ধরনের ব্যক্তিদের বোঝানো হয়। ঢাকা দক্ষিণের বিদায়ী হতে চলা মেয়র সাইদ খোকনও আইনের মানু বটে! তিনি আরও মাস চারেক এ মর্যাদায় থাকবেন।
দুটি সিটি করপোরেশনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কাউন্সিলর পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন। তাদের সমস্যা নেই। ক্ষমতা রয়েছে তাদের এবং সেটা ভোগ করতে থাকবেন। অন্যদিকে, উত্তরে ও দক্ষিণে যারা কাউন্সিলর পদে নতুন নির্বাচিত হয়েছেন তাদের হা-হুতাশের শেষ থাকবে না। তাদের ওয়ার্ডের বর্তমান কমিশনার ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছেন, নির্বাচিত হয়েও এটা দেখে যেতে হবে, সহ্য করে যেতে হবে।
দক্ষিণের মেয়রের ক্ষেত্রে সমস্যাটি বিশেষভাবে প্রকট হয়ে দেখা দিতে পারে। আইন অনুযায়ী নীতিগত ও জরুরি বা প্রয়োজনে উদ্ভূত যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার সমস্যা নেই। তিনি এমনকি নতুন নিয়োগও দিতে পারেন। যে কোনো ‘অসমাপ্ত’ প্রকল্প উদ্বোধন করতে পারেন। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে করপোরেশনের বাজেট থেকে অর্থব্যয় করতে পারেন। ঋণ করে ঘি খাওয়াও সম্ভব। এতে নতুন মেয়র দায়িত্ব গ্রহণের পর সমস্যায় পড়বেন কী-না, সেটা দেখার কথা তার নয়।
নির্বাচিত না হওয়ার কারণে দুটি সিটি করপোরেশনের যে সব কাউন্সিলরকে মে মাসের পর বিদায় নিতে হবে, তারা যদি অনিয়ম করেন এ সময়ে? তারা যদি আখের গুছিয়ে নিতে ব্যাকুল হয়ে পড়েন? আমাদের মনে রাখতে হবে, দুটি সিটি করপোরেশনের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কাউন্সিলর আইন অনুযায়ী না চলার কারণে সদস্যপদ হারানোর ঝুঁকিতে ছিলেন। প্রধান অভিযোগ ছিল, সভায় হাজির না হওয়া। কেউ কেউ ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে যুক্ত হয়ে পড়েন।কিন্তু দুর্ভাগ্য, কোনো মেয়রই অভিযুক্ত কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণে উৎসাহী ছিলেন না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কেও এ বিষয়ে পর্যাপ্ত উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। অভিযুক্ত কাউন্সিলররা স্বপদে রয়েছেন। তাদের মধ্যে যারা মে মাস পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে বিদায় দেবেন, তারা আগামী চার মাস ‘সুবোধ বালক’ হয়ে থাকলেই ভাল।
অপেক্ষার চার মাস দক্ষিণের মেয়রের জন্য হোমওয়ার্ক করার চমৎকার সুযোগ এনে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় নভেম্বরের প্রথম মঙ্গলবার। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেন পরের ২০ জানুয়ারি। নতুন কেউ নির্বাচিত হলে এ আড়াই মাসের মতো সময়টি কাজে লাগে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার কলাকৌশল শিখতে। ঢাকায় এখন অনেক সমস্যা। গত বছর মশা দাপট ও ডেঙ্গু নাগরিকদের নাকাল করেছে। মেয়ররা দৌঁড়ঝাঁপ করেছেন। অর্থ ব্যয় করেছেন। এর আগে চিকুনগুনিয়াও উদ্বেগের কারণ ছিল। মেয়র ও কাউন্সিলররা নিজ হাতে মশা মারবেন, এমন প্রত্যাশা কেউ করে না। তারা পাকিস্তানের গোড়ার দিকের প্রাদেশিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাববুল্লাহ বাহারের মতো নাও হতে পারেন। তিনি দায়িত্ব পালনকালে সে সময়ের ঢাকায় পরিচ্ছন্নতা অভিযানের ওপর বিশেষ জোর দেন এবং এ কারণে সাত দশক পরও স্মরণীয় হয়ে আছেন। সে সময়ে এখনকার মতো ওষুধ ছিল না, ওষুধ ছিটানোর আধুনিক যন্ত্রও ছিল না। কিন্তু ভেজাল ওষুষের জন্য করপোরেশনের অর্থ অপচয়ের অভিযোগও ওঠেনি। দুর্ভাগ্য, ন্যায়-নীতি-সততার প্রশ্নে আমরা না এগিয়ে বরং অনেক অনেক পিছিয়েছি। বছরের পর বছর মশা মারার ওষুধ ও সরঞ্জাম কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও এমনকি একজনকেও শাস্তি দেওয়ার ঘটনা জানা নেই আমাদের। এটা নিয়ে নতুন মেয়র ভাবতে পারেন।
জাতীয় নির্বাচনের মতো রাজধানীর দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ, সন্দেহ নেই। নির্বাচিতরা তাদের সু-কাজের দ্বারা তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারেন। তারা বলবেন, সব সমস্যার সমাধান করপোরেশনের হাতে নেই। দুর্নীতির প্রশ্রয় দেওয়া হবে না এটাও কসম কেটে বলতে পারবেন না। একজন না চাইলেও আরেকজনের দুর্নীতি, অদক্ষতা বা গাফিলতির কারণে নাগরিক সেবায় ঘাটতি হতে পারে। কিন্তু নিষ্ঠা ও আন্তরকিতা দেখাতে তো সমস্যা হওয়া কথা নয়। লিফ সার্ভিস দিয়ে অনেক মানুষের মন জয় করা যায়। দুর্ভাগ্য, বিনা পয়সার এ কাজেও ঘাটতি কখনও কখনও প্রকটভাবে ধরা পড়ে। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে একটি বিষয় নজরে এসেছে ‘সেলফি স্টাইল’। মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকরা টেলিভিশন ক্যামেরার বড় ভক্ত। টিভি চ্যানেলগুলো এসেছে কী-না, সে বিষয়ে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর জনসংযোগ শুরু হয়েছে, এটা জেনেছি সাংবাদিকদের কাছ থেকে। মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষে যারা প্রচারে নেমেছে, তাদেরও দেখা গেছে সেলফি তুলে বা অন্যভাবে ফটো তুলে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিতে। অনেক ভিডিও ইউটিউব ও ফেসবুকে স্থান পেয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মীরা এটা করেছে। তেমন জনভিত্তি নেই, সে দলের প্রার্থীরাও এটা করেছে। অথচ ঢাকার মানুষের কাছে অঙ্গীকার করার মতো কত কিছুই না রয়েছে।
সব কিছু ঢাকায় কেন্দ্রীভূত। দেশের আট ভাগের এক ভাগ লোক এখানে বসবাস করে। এটাই স্বাভাবিক যে এখানে সুবিধা যত বাড়ানো হবে, তত বেশি লোক আকৃষ্ট হবে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য। আবার এটাও মনে রাখতে হবে, যত সুবিধাই বাড়ানো হোক না কেন, মানুষ চাইবে আরও বেশি। বরিশালের অমৃত শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধার বিজয় কৃষ্ণ দে বছর দশেক আগে বলেছেন, রাজধানীর উন্নয়নের সঙ্গে দেশের সব বিভাগীয় শহর এবং অনেকগুলো জেলা শহরের উন্নয়নের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকা দরকার। অন্যথায়, ঢাকার বাইরে যাদের বসবাস, তারা নিজেদের বঞ্চিত মনে করবে। রাজধানীকেন্দ্রিক উন্নয়ন অব্যাহত থাকলে এখানে জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তিনি জোর দিয়েছেন রাজধানীর আশপাশের জেলা ও বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য ট্রেন সার্ভিস চালুর ওপর। যারা মেয়র পদে নির্বাচিত হয়েছেন, এটা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নাও হতে পারে।
তারা বলবেন, আমরা দেখব আমাদের নিজেদের এলাকার স্বার্থ। কিন্তু এ জন্য তো নির্ভর করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া বাজেটের ওপর। রাজধানীতে যাতায়াত সহজ করার জন্য ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের যে মেট্রোরেল প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, তার সুফল ভোগ করবে দুই সিটি করপোরেশনের বাসিন্দারা। কিন্তু অর্থ জোগান দেওয়া হবে জাতীয় বাজেট থেকে। অর্থাৎ এ ব্যয় জোগাবে সারা দেশের মানুষ। প্রশস্ত সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, সড়ক উন্নয়ন ফ্লাইওভার, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং এ ধরনের আরও বড় বড় প্রকল্পের ব্যয় নির্বাহ করা হয় জাতীয় বাজেট থেকে। সিটি করপোরেশনকে যদি বলা হয়, আপনাদের এলাকায় যে সব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে তার ব্যয়ের কিছু অংশ নাগরিকদের কাছ থেকে ট্যাক্স হিসেবে আদায় করে দিন নিশ্চিত করে বলতে পারি, কেউ রাজি হবেন না। তবে একটা বিষয়ে মেয়র-কাউন্সিলররা অভিন্ন মত দেবেন উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদারি তাদের পছন্দের লোককে দিলেই ভাল হয়। অন্যথায়, সমর্থকদের ধরে রাখবেন কী করে!
বাংলাদেশে এখন অন্তত লাখ খানেক লোক রয়েছে, যাদের ব্যাংকে এক কোটি টাকা বা তারও বেশি অর্থ জমা রয়েছে। গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, বারিধারা, উত্তরার মতো এলাকায় যার মাত্র একটি ফ্লাট রয়েছে, তার বাজার মূল্যও ন্যূনতম এক কোটি টাকা হবে। রাস্তায় বের হলে কোনো প্রশস্ত সড়কে যানজটের সময় গুণে দেখবেন ১০০ টা প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে আছে। আর বাসের সংখ্যা একটি বা দুটি। রাস্তার দু’পাশের বাসস্ট্যান্ডগুলোতে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে অগণিত নারী-পুরুষ। অথচ একটি বাস যতজন যাত্রী বহন করে, তা বহন করার জন্য ৫০ থেকে ১০০টা প্রাইভেট কার দরকার। কোনো মেয়র প্রার্থীই কিন্তু এ জলন্ত সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেননি। ধনবানদের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় বাড়িয়ে নাগরিক সুবিধা বাড়ানো হবে, এমন প্রতিশ্র“তি দিতে কেউ রাজী নয়।
সিটি করপোরেশন চালানোর জন্য আয়ের নিজস্ব উৎস চাই ভোটারদের কাছে এটা জনপ্রিয় ইস্যু হওয়ার কথা নয়। সঙ্গত কারণেই এ পথ পরিত্যাজ্য। ভারতের রাজধানী দিল্লিতে আম আদমি পার্টির সরকার মাসে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ এবং ২০ কিলোলিটার পানি ফ্রি করে দিয়েছে। সরকারি বাসে নারীদের ভাড়া দিতে হয় না। তারা আরও কিছু সুবিধা অপেক্ষাকৃত দরিদ্রদের জন্য চালু করেছে। দরিদ্রদের শিক্ষার মান বাড়াতে নিয়েছে বিশেষ পদক্ষেপ। দিল্লি একটি রাজ্য। আমাদের রাজধানী রাজ্য নয় কেবলই সিটি করপোরেশন। ধনবানদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে অপেক্ষাকৃত দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন যে কোনো দেশে কর-শুল্ক আদায়ের অন্যতম উদ্দেশ্য। আমাদের সিটি করপোরেশন কি এ ধরনের কিছু সুবিধার কথা ভাবতে পারে না? কল্যাণমুখী সিটি করপোরেশন কিন্তু এটাই দাবি করে।
বাংলাদেশে সম্পদ বণ্টনে বৈষম্য বাড়ছে, এটা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে। রাজধানীতে এ বৈষম্য আরও প্রকট। সিটি করপোরেশনের হাতে এ সমস্যার সমাধান নেই। কিন্তু তারা এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে যাতে অপেক্ষাকৃত কম সচ্ছল ও স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠী মনে করবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আছেন তাদের পাশেই। আমরা জানি, যাদের হাতে অর্থ রয়েছে অঢেল কিংবা যথেষ্ট পরিমাণে, তাদের একটি অংশ কর ফাঁকি দিতে অভ্যস্ত। আরেক দল হয়ত কর-শুল্ক দিতে চায়, কিন্তু তার ব্যয় কীভাবে হবে সেটা নিয়ে থাকে প্রবল শঙ্কা। সরকারি মাল দরিয়া মে ঢাল, এটা তারা জানে। সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি-অনিয়ম বিস্তর, এটাও কেবল শোনা কথা নয়।
বাস্তবেই তারা ঘটতে দেখে। পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কিংবা সরকারি হাসপাতাল অথবা সড়ক ও রেল সেতুর প্রকল্প সর্বত্র কেনাকাটায় গলাকাটা দর!এর সুবিধা লোটে মুষ্টিমেয় লোক, আর বোঝা চাপে অগণিত মানুষের কাঁধে। ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনেও কিন্তু এ ধরনের সমস্যা রয়েছে।
ঢাকা সিটি করপোরেশন নেতৃত্ব কি নতুনচমক দেখাবে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)