চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

গৌতম থেকে অনন্যা হওয়ার গল্প

সমাজে টিকে থাকতে অবিরাম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে সমাজের বিশেষ এক শ্রেণীর মানুষ ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। বাইরের মানুষ দূরের কথা, এমনকি পরিবারের কাছেও নেই তাদের আশ্রয়। সমাজে এখনও নানাভাবে বিড়ম্বনা এবং বৈষম্যের শিকার তারা৷

এমনই বৈষম্যের শিকার গৌতম বণিক, যিনি বর্তমানে অনন্যা বণিক নামে একজন কর্মজীবী নারী হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত। বর্তমানে ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’র লিয়াজোঁ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন অনন্যা। পাশাপাশি কাজ করছেন ‘স্বত্বা’ নামে একটি নাচের স্কুল নিয়ে। এছাড়া ‘সাদাকালো’ নামে নিজস্ব একটি সংগঠন থেকে তিনি কাজ করেন হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়ন ও বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে। বন্ধুর কর্মকর্তা হিসেবে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রেও (আইসিডিডিআরবি) কাজ করেছেন অনন্যা।

চ্যানেল আই অনলাইনকে সম্প্রতি তিনি জানিয়েছেন নিজের সংগ্রামী জীবনের কথা। নিজের কষ্টের দিনগুলো সম্পর্কে অনন্যা বলেন: রুচিশীল শিক্ষিত পরিবারেই জন্ম আমার, আমি ছিলাম গৌতম বণিক। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট ছিলাম আমি। ছোটবেলায় বাবা বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে আমাকে নাচ শিখিয়েছেন। বাবা সংস্কৃতিমনা ছিলেন, ভালোই কাটছিল তখন। কিন্তু হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়ার পর আমাকে ভাইদের অত্যাচার ও নিপীড়নের মুখে পড়তে হয়।

‘হিজড়া’ শব্দকে নিজের মতো আপন করে নিয়ে নিজের এ লৈঙ্গিক পরিচয়ে গর্ববোধ করেন অনন্যা

‘বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের পুরো কর্তৃত্ব চলে যায় ভাইদের হাতে। তারা আমার বিষয়টা সহজে মেনে নিতে পারেনি, কিংবা কখনোই মেনে নিতে চায়নি। তাই পরিবার থেকে আমার ছিটকে আসা’, বলছিলেন অনন্যা বণিক।

তখনকার সময়গুলোকে চ্যালেঞ্জিং উল্লেখ করে অন্যন্যা বলেন: পরিবার থেকে চলে আসা কিংবা পরিবারকে মুক্তি দেওয়ার পর একটা মানুষ একা হয়ে যাওয়া, এরপর নিজেকে নতুন করে তৈরি করার বিষয়টি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের ছিল আমার জন্য। আমি আমার ট্র্যাকে থেকে ভালো কিছু করার চেষ্টা করেছি এবং সফল হয়েছি।

এই সফলতার পেছনের কথা জানতে চাইলে অন্যন্যা বণিক বলেন: বেকার অবস্থায় বেশ কিছুদিন চাকরি খুঁজি। এক সময় ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’তে কাজ পাই। এরপর নতুনভাবে পথ চলা শুরু।

নিজের কর্মস্থল নিয়ে গর্ব করে অনন্যা বলেন: আজকে যে অন্যান্যাকে দেখছেন সুন্দর ও পরিপাটি করে কথা বলছে, সেই অন্যন্যা ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’র তৈরি। আমি ‘বন্ধু’র ব্র্যান্ড। আমাকে তৈরি করতে তারা সবকিছু্ করেছে।

চাকরি কেমন উপভোগ করছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে চাইলে অন্যন্যা বলেন: আমার চাকরি মূলত সারা বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার হিজড়াদের সঙ্গে নেটওয়ার্কিং। বাংলাদেশ ট্র্যাকে থেকে কিভাবে হিজড়াদের মান উন্নয়নে কাজ করতে পারবে সেটা পর্যবেক্ষণ করা। তাদের জন্য কাজ করতে পারাটা আমি উপভোগ করি।

কর্মসূত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানান: বাংলাদেশে হিজড়াদের অবস্থান এখনও চ্যালেঞ্জিং। বিশ্বের অনেক দেশে এখন হিজড়ারা নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন পেশায় কাজ করছেন। ইউরোপের রাস্তায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে হিজড়াদের কোন পার্থক্য নেই। সেখানে রাস্তায় চোখ উল্টে বাঁকাভাবে দেখার কেউ নেই। কিন্তু বাংলাদেশে হিজড়াদের সম্মান দেওয়া হয় না।

নিজের ব্যস্ততার কথা তুলে ধরে অনন্যা বলেন: প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয়, বিভিন্ন ধরনের কাজ থাকে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কাজ করছি, কোথায় কোথাও পড়াতেও হচ্ছে।

চাকরির পাশাপাশি নাচ, র‌্যাম্প, নাচের দল সবই করছেন অনন্যা

সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরূপ বিষয় তুলে ধরে তিনি বলেন, আমি থাকি সাভারে আমার অফিস কাকরাইলে। প্রতিদিন বাসে আসার সময় আমার ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়। আমি বাসে উঠার পর যে পর্যন্ত কথা না বলি তখন পর্যন্ত সবাই আমাকে মহিলা মনে করে। ভাড়া সংক্রান্ত বিষয়ে কথা হলেই পাশে বসা মানুষটি বুঝে যায় আমি হিজড়া। তখন তারা অস্বস্তি বোধ করে, সিট পরিবর্তন করতে চায়।

‘এটা আমার সম্মানে লাগে, আমি প্রচণ্ড কষ্ট পাই। আসলে আমি তো মানুষ, আমার পাশে তো বসায় যায়। কেন বসা যাবে না? আমি যখন বাসে কোথাও যাই তখন কিন্তু কে মুচি, কে ডোম সেটা দেখি না। আমি মনে করি সে আমার সহযাত্রী, আমরা সবাই নিদিষ্ট গন্তব্যে টাকা দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমি হিজড়া বলে আমার পাশে কেউ বসতে পারবে না, এই ধ্যান-ধারণা আমাকে কষ্ট দেয়’, বলছিলেন অনন্যা বণিক।

বর্তমান সরকার হিজড়াদের সুখ স্বাচ্ছ্যন্দের দিকে নজর দিচ্ছেন জানিয়ে অন্যন্যা বলেন: এ যাবৎকালীন কোন সরকার আমাদের স্বীকৃতি নিয়ে চিন্তা করেনি। এই সরকার বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে হিজড়া সম্প্রদায়কে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দিয়েছে। আমি সরকারকে অনুরোধ করবো, অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে, সবকিছুর সঙ্গে যেন আমাদেরও রাখে। স্বীকৃতির পাশাপাশি আমাদের অধিকার আমরা চাই।

‘সরকার চাইলে আমাদের জন্য বিশেষ আইন করতে পারে, যার মাধ্যমে আমরা নিজেদের তৈরি (আচার, আচরণ) করা শিখব’, বলেন অন্যন্যা বণিক।