ফুটবলে গোলই প্রথম কথা। গোলই শেষ কথা। সেই গোল করার পথে কেউ কেউ হয়ে যান গোল্ডেন বুটের দাবিদার। শুধু নিজের ফর্ম আর নৈপুণ্য দেখালেই সেটা হয় না। দলকেও হতে হয় ভারসাম্যপূর্ণ। তাতে দল অনেকটা পথ পাড়ি দিলে ব্যক্তিগত অর্জনের সম্ভাবনাটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
নেইমার, মেসি, রোনালদো, মুলাররা এবার ভালোভাবেই আছেন গোল্ডেন বুটের লড়াইয়ে। দেখে নেয়া যাক রাশিয়া বিশ্বকাপের সম্ভাব্য ছয় গোল্ডেন বুটের দাবিদার ও তাদের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সকে।
নেইমার (ব্রাজিল)
বিশ্বের সবচেয়ে দামি ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপের ময়দানে পা রাখতে যাচ্ছেন নেইমার। চার বছর আগে ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে যেমন দলের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন, রাশিয়া বিশ্বকাপেও ব্রাজিলের তুরুপের তাস তিনিই। গত মৌসুমে ক্লাবের হয়ে দুর্দান্ত শুরু করলেও ইনজুরির কারণে সেটার পূর্ণতা দিতে পারেননি। তার জন্য পূর্ণতার সুযোগ নিয়ে আসছে রাশিয়া বিশ্বকাপ।
পিএসজির হয়ে গেল মৌসুমে ৩০ ম্যাচে ২৮ গোল করেন নেইমার। সঙ্গে ১৮টি অ্যাসিস্টও আছে তার।
সময়টাতে জাতীয় দলের জার্সিতেও দারুণ খেলেছেন নেইমার। বিখ্যাত হলুদ জার্সিতে এপর্যন্ত ৫৩ গোল করে ফেলেছেন ২৬ বছরের তরুণ। জাতীয় দলের হয়ে তার চেয়ে বেশি গোল আছে কেবল পেলে, রোমারিও এবং রোনাল্ডোর। এই তিনজনের সবাই বিশ্বকাপ জিতেছেন। দ্রুতই হয়ত তাদের গোলস্কোরকে ছাড়িয়ে যাবেন নেইমার। তবে যোগ্য উত্তরাধিকার হতে হলে বিশ্বকাপটা জিততে হবে।
লিওনেলে মেসি (আর্জেন্টিনা)
মেসি ২০২২ বিশ্বকাপে খেলবেন কি না, সেই প্রশ্ন ইতিমধ্যে উঠে গেছে। তিনি নিজেও কয়েকবার বলেছেন, ২০১৮ বিশ্বকাপই তার জন্য শিরোপা জেতার শেষ সুযোগ।
এই কথাটা মনে রেখেই, নিজের অস্ত্র ভাণ্ডারের সমস্ত শক্তি নিয়ে রাশিয়া যাচ্ছেন মেসি। গত কয়েক বছর ধরে একজন আর্কিটেক্টের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তিনি। যেখানে গোল করার চেয়ে করানোতেই বেশি মনোযোগী। তারপরও গত মৌসুমে ৪৭ গোল করেছেন। যার মধ্যে ৩৪ গোল লা লিগায়। যেখানে তারা শিরোপা জিতেছে। টপ স্কোরার হিসাবে মেসি পঞ্চমবারের মতো জিতেছেন ইউরোপিয়ান ‘গোল্ডেন সু’ও।
বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে আর্জেন্টিনাকে প্রায় একক নৈপুণ্যে টেনেছেন মেসি। একদিন আগে প্রীতি ম্যাচে হাইতির বিপক্ষে করেছেন দুর্দান্ত হ্যাটট্রিক।
বিশ্বকাপে মেসির পারফরম্যান্সটা একটু বির্বণই! প্রথম দুই বিশ্বকাপে জাল খুঁজে পান মাত্র একবার। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে আগের চেয়ে বেশ উন্নতি করেন। সাত ম্যাচে করেছিলেন ৪ গোল। এবার রাশিয়ায় কি মেসি ব্রাজিলের সংখ্যাটা অতিক্রম করবেন? তার উত্তর কিন্তু বেশি দূরে নয়। ১৪ জুন থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা মেসিও তাই দাবিদার।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো (পর্তুগাল)
বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টের ইতিহাসে রোনালদোর দাগ কাটার মতো কিছু নেই। তবে পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে তাকে গোল্ডেন বুটের দাবিদার থেকে বাদ দেয়াটা সমীচিত নয়। যেখানে গত মৌসুমেও ৪৩টি গোল করেছেন সিআর সেভেন।
মৌসুমের প্রথমার্ধটা ভালো কাটেনি রোনালদোর। তবে দ্বিতীয়ার্ধে দারুণভাবে ফিরে আসেন। একের পর এক গোল করে নিজেকে প্রমাণ করেন। জাতীয় দলের হয়ে ২০১৬ ইউরো জেতার পর ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্রফিটা জয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সিআর সেভেন।
জাতীয় দলে মেসির মতো মিডফিল্ডে খেলতে হয় না বলে গোলের সুযোগটা রোনালদোর জন্য বেশিও। পর্তুগাল দলে বেশ কয়েজন দুর্দান্ত মিডফিল্ডারও রয়েছেন। আদ্রিয়েন সিলভা, বের্নাদো সিলভা ও উইলিয়াম কারভালহোরা দারুণ সব পাস দিতে পারবেন রোনালদোকে।
রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন। এবার বিশ্বকাপ জিতলে অবশ্যই রোনালদোকে ব্যালন ডি’অর দেয়া হবে এবং সেই লক্ষ্য পূরণে বিশ্বকাপে গোলের পর গোল করার জন্য আর বেশি কোনো অনুপ্রেরণার প্রয়োজন হবে না রোনালদোর!
অ্যান্টনে গ্রিজম্যান (ফ্রান্স)
২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে ফেভারিট লাইনের বহুদূরে দাঁড়িয়ে ছিল ফ্রান্স। কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে বিদায় নিতে হয়েছিল তাদের। সে বছর ফরাসিদের বলার মতো পারফরম্যান্স ছিল কেবল রিয়াল সোসিয়েদাদের ‘ছোট’ ছেলে গ্রিজম্যানের।
চার বছর পর গ্রিজম্যান রাশিয়া বিশ্বকাপে নামছেন একটি শক্তিশালী দলের ‘নিউক্লিয়াস’ হয়ে। গত চার বছরে তিনি উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছেন। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে প্রতি বছর গড়ে ২৮টি করে গোল করেছেন। গ্রিজম্যানের সবচেয়ে বড় শক্তি বহুমুখিতা। প্রায় সব পজিশনে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন। একজন ফরোয়ার্ড হিসাবে এটা তাকে বাড়তি শক্তি দিয়েছে।
গত মৌসুমেও ধীরগতির শুরুর পর নিজেকে ধীরে ধীরে ফিরে পান। ক্লাবের হয়ে ২৯ গোলের পাশাপাশি ১৩টি গোলে অবদান রাখেন। তার মধ্য অ্যাটলেটিকোকে শিরোপা জেতানো ইউরোপা লিগের ফাইনালে জোড়া গোল আছে। গ্রিজম্যানের ফর্মে ভর করেই লা লিগায় নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদকে টপকে দ্বিতীয় স্থানে থেকে মৌসুম শেষ করেছে অ্যাটলেটিকো।
ঘরের মাঠের ২০১৬ ইউরোতেও দুর্দান্ত ছিলেন গ্রিজম্যান। সর্বোচ্চ ৬ গোল করে আসরের ‘গোল্ডেন বুট’ জিতেছিলেন। সেইসঙ্গে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কারও হাতে উঠেছিল। যদি এই পারফরম্যান্স বিশ্বকাপেও ধরে রাখতে পারেন, তাহলে ফ্রান্সও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে।
হ্যারি কেন (ইংল্যান্ড)
৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বকাপ জিততে পারেনি ইংল্যান্ড। শক্তিশালী দল নিয়েও প্রায় প্রতি আসরেই হতাশ হতে হয় তাদের। এবার ইংলিশদের সেই ‘অপয়া’ তকমা মোছার দায়িত্ব অর্পিত দুর্দান্ত ফর্মে থাকা হ্যারি কেনের কাঁধে।
প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব টটেনহ্যামের হয়ে গত চার মৌসুমে নিয়মিতই জাল খুঁজে পেয়েছেন কেন। যার ফলে বিশ্বের অন্যতম দামি স্ট্রাইকারের তকমাও পাচ্ছেন। রাহিম স্টার্লিং ও মার্কাস র্যাশফোর্ডের সঙ্গে গড়া কেনদের আক্রমণভাগ যেকোনো দলের জন্যই বড় হুমকি।
গত মৌসুমে ৫০ ম্যাচে ৪৩ গোল করেছেন কেন। যার মধ্যে প্রিমিয়ার লিগে তার ক্যারিয়ার সেরা স্কোর এবারের ৩০ গোল। কেনের চেয়ে দুই গোল বেশি করেছেন লিভারপুলের মিশরীয় স্ট্রাইকার মোহামেদ সালাহ। নিজের অভিষেক বিশ্বকাপে ২৪ বছরের কেন তাই বেশ চাপেই থাকবেন। এরকম বড় আসরে তিনি কেমন করেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।
থমাস মুলার (জার্মানি)
থমাস মুলার এবং বিশ্বকাপ বিষয়টায় ফুটবল ভক্তদের বোঝার বাইরেও কিছু কিছু জিনিস আছে। তিনি বায়ার্ন মিউনিখ এবং জার্মানি দুদলের জন্যই দুর্দান্ত পারফর্ম করেছেন। তবে বিশ্বকাপ তাকে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জায়গায় নিয়ে গেছে।
২০১০ সাউথ আফ্রিকা বিশ্বকাপে ‘গোল্ডেন বুট’ জিতে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন ২০ বছরের মুলার। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে শিরোপার সঙ্গে কয়েকটি ব্যক্তিগত পুরষ্কার জিতেছিলেন। এবার রাশিয়া, যেখানে নিজেদের শিরোপা ধরে রাখার ক্ষেত্রে মুলারের ওপর অনেকটা নির্ভর করছে জার্মানরা। যদি তারা সেটা পারেন, তাহলে ১৯৬২ সালের ব্রাজিলের পর জার্মানিই হবে প্রথম দল; যারা টানা দুবার বিশ্বকাপ জিতবে।
২০১৬ ইউরো থেকে নিজে গোল করার দিক থেকে একটু সরে এসেছেন মুলার। বরং সতীর্থদের দিয়ে গোল করানোতেই বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। পরিসংখ্যান তেমনটাই বলছে। গত মৌসুমে মুলার করেছেন ১৬ গোল। তার অ্যাসিস্টের সংখ্যাও ঠিক সমান। তাহলে কি বিশ্বকাপে তাকে ‘গোল্ডেন বুট’ প্রতিযোগীদের কাতারে ধরা যায়? অবশ্যই! কারণ, বিশ্বকাপের মুলারই যে আসল ‘মুলার’।