চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

গৃহকর্মী নির্যাতনের নির্মমতা, ভয়াবহতা ও আমাদের দায়

নানান ভাবে প্রতিদিন আমাদের চোখের সামনে উঠে আসছে ‘গৃহকর্মী নির্যাতন’ চিত্র। ভয়াবহতা প্রতিদিনই মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি নির্যাতনের পেছনে বেশির ভাগ সময়ই থাকছে সমাজের বিত্তশালী শ্রেণী, বিকৃত মানসিকতার কিছু মানুষ। তবে সবচেয়ে বেশি থাকছে ঘরে থেকে সংসার চালাচ্ছেন এমন কিছু ‘নারী’! অন্তত মিডিয়ার কল্যাণে আমরা তেমনটাই দেখছি।

লিখতে চেয়েছিলাম কিছুটা হলেও মনের ক্ষোভ, হতাশা এবং নির্যাতিত সব শিশু কিশোর বা কিশোরীদের প্রতি আমাদের দায়, ভালোবাসা এবং সভ্য একটি রাষ্ট্রের করণীয় কি হতে পারে এই ক্ষোভ থেকে। বিশেষ করে ফেসবুক এবং অন্যান্য মিডিয়ার বদৌলতে হয়তো ব্যাপক নির্যাতনের অল্প কিছুই উঠে আসে আমাদের চোখের সামনে এবং দুঃখজনক হলেও সবচেয়ে নিষ্ঠুর সত্য হচ্ছে ‘’নির্যাতক’’ সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণী হওয়াতে কিছুতেই তাদের আনা যাচ্ছেনা আইনের আয়ত্তে!!!

আজকের বাংলাদেশে গৃহকর্মী নির্যাতনের যে বর্বর এবং নির্মম চিত্র, তেমনটি কেন হলো, কিভাবে হলো!!! পেছনে তাকাই একটু, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশ পারিবারিক কাঠামো, আর্থিক অবকাঠামো যেমন ছিলো সেখানে গৃহকর্মী’র মত একজন সদস্যের পরিবারে অন্তর্ভুক্তি ছিল মুলতঃ কৃষিকাজের জন্য। গ্রামের কৃষিনির্ভর পরিবারের সার্বক্ষণিক বাইরের গৃহঃস্থালি কাজের জন্যে, বাড়ির গবাদী পশু লালন পালনের জন্যে দুই একজন বাড়ির একজন সদস্য হিসেবেই থেকে যেত।

বলাই বাহুল্য, পরিবারটিতে সেই ‘মানুষ’টির গুরুত্ব ছিলো অন্যরকম। বাড়ির মুলকর্তা ব্যক্তি, কাজের কোন অমনোযোগিতার জন্যে তাকে কিছু বললেও অন্যদের সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশ কাছেরই হতো। এমনকি মাঝ বয়সী বা সিনিয়র হলে বাড়ির ছোট সদস্যদের প্রয়োজনে ছোট খাটো ধমক দেয়ার এখতিয়ারও থাকতো গৃহকর্মে সাহায্য করা মানুষটির।

শিশু ধর্ষণ

জীবিকার প্রয়োজনে শহরকেন্দ্রিক জীবনমুখী হয়ে উঠে মানুষ। যৌথ পরিবারের ভাঙ্গন এবং পারিবাহিক চাহিদার জন্য আশি-নব্বই দশক থেকেই শহুরে উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত পরিবারেও গৃহকর্মীর প্রবেশ খুব বেশিই অত্যাবশ্যক হয়ে উঠে।

অনেকের মনে আছে নিশ্চয়ই ওই সময়ের নাটক সিনেমাতেও পরিবারের এই প্রতিচ্ছবি উঠে আসতো। বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদের নাটকে ‘গৃহকর্মীর’ চরিত্র উঠে এসেছে ভীষণভাবে জোড়ালো অবস্থান নিয়ে, খুব আপন কেউ ‘একজন’ হয়েই।

আমাদের বেড়ে উঠা সময়ে পরিবারে পেয়েছি অনেকগুলো সমবয়সী খেলার সাথীসম এমন পারিবারিক সদস্য। স্বাভাবিক ভাবেই পাড়ার কাছাকাছি থাকা অস্বচ্ছল পরিবারের কেউই হতো এই মানুষটি। টুকিটাকি কাজের বিনিময়ে পেট ভরে তিনবেলা খেতে পারাটাই ছিলো তাদের জীবনের মুখ্য লক্ষ্য। তারপর একটু বড় হয়ে উঠলেই মা-বাবা বিয়ে দিয়ে দেবে বলে উঠে পড়ে লাগতো। বলাই বাহুল্য বেশীর ভাগ সময় মেয়েগুলো রাজি হতোনা।

নিজের পরিবারেই দেখেছি এমনতর ঘটনা। কাউকে কাউকে ভালোবেসে ‘বুজি’ বা আপা বলতাম। নিজের থেকে বড় বয়েসী কাউকে কাউকে নাম ধরেও ডাকা হতো, তবে বেশ আদর নিয়েই। তাদের বিদায় দিয়েছি চোখের জলে, নাকের জলে। তারাও রীতিমত কান্নাকাটি করে বাবা চাচাদের সাথে চলে যেতো, মানে যেতে বাধ্য হতো।

এটাই ছিল সাধারণ চিত্র। ৯০ পরবর্তী সময় মিডিয়ার কল্যাণে আমাদের সামনে আসতে থাকলো গৃহকর্মী নির্যাতনের নির্মম সব ঘটনা এবং বেশীর ভাগ নির্যাতনের চিত্রই ছিলো ঢাকা কেন্দ্রিক। পুরো বাংলাদেশের যে এমন হতোনা, বিষয়টি নিশ্চয়ই তা নয়।

পত্রিকা পড়ে, আমরা গ্রাম বা মফস্বল শহরে থাকা অনেকেই অবাক হয়ে ভাবতাম এমন করে কিভাবে সম্ভব। আসে পাশে বা নিজ পরিবারে দেখেছি মাঝে মাঝে গৃহকর্মে নিয়োজিত থাকা কাউকে কাউকে অল্প বিস্তর শাসন করতে। সেই শাসন এমন যা হয়তো অনেক সময় বাড়ীর অন্য কোন জুনিয়রের জন্যও ছিলো বরাদ্দ সেই লেভেলেরই কিছু।

এই কিছুদিন আগে ক্রিকেটার শাহাদাত এবং তার স্ত্রীর গৃহ পরিচারিকা কিশোরী মেয়েটির উপর অমানবিক নির্যাতনের কথা আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারি। ঘটনার নির্মমতায় আমাদের কষ্ট হয়, ন্যায় বিচারের আশায় বাঁধি বুক। কিন্তু অল্প ক’দিনেই বদলে যায় সেই মেয়েটির ‘নির্যাতনের চিত্র’, নির্যাতিতার পরিবার হয়ে যায় বিক্রি টাকার কাছে। যার অল্প বিস্তর জানলেও বেশিটুকু আমরা জানতে পাইনা।

জানতে পাই, গৃহকর্মী মাহফুজা আক্তার হ্যাপি নির্যাতনের মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন ক্রিকেটার শাহাদত হোসেন ও তার স্ত্রী। এই তো গেল কোন এক রোববার এক রায়ে এই দম্পতিকে খালাস দেন আদালত। অনেকেই পড়েছেন নিশ্চয়ই খবরটি।

জানি এই পোড়া দেশে শুধু টাকা হলে অনেক সময় কেনা যায় ‘মানুষ, মানবিকতা’। হ্যাপি’র মা-বাবার মুখের কথাই হয়তো ছোট্ট এই মেয়েটিকে সব শারীরিক কষ্ট, (মানসিক সে আর না-ই বলি)  ভুলিয়ে আদালতে মিথ্যা সাক্ষি দিতে প্ররোচিত করেছে। মেয়েটিকে তার বাকি জীবনে সেই নির্যাতন কতোটা তাড়িয়ে বেড়াবে তা আমরা আর কোনদিন জানতে পারবোনা, যেমনটি জানতে পারবোনা আয়নায় দাঁড়িয়ে শাহাদাত বা ওর মানসিক ভাবে বিকৃত স্ত্রী কি কোনদিন বুঝবে কিনা বাংলাদেশে যে বাচ্চাগুলো বাড়িতে কাজ করতে আসে তারা কি ভীষণ ভাগ্যবঞ্চিত, ওদের শৈশব-কৈশোরের কোন সুস্থ সুন্দর স্মৃতি থাকেনা, এইসব শাহাদাত ও তার অসুস্থ অসুন্দর স্ত্রীদের কারো কারো জন্যেই।

বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক কাঠামো বদলে যাচ্ছে, বেড়েছে জিডিপি। উন্নত হয়েছে মানুষের জীবন যাত্রার মাত্রা। খেতে না পাওয়া মানুষের সংখ্যার অনুপাত এদিক সেদিক হলেও খেটে খাওয়া কিছু মানুষ এবং সেই পরিবারের শিশু কিশোরদের জীবনেই আসেনি কোন ছোঁয়া।

তাদের প্রতি যে বৈষম্য এ আমাদের লালন করা মানসিকতা। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, খুব অল্প বিস্তর বদলাচ্ছে, তবে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় ‘নাহ, গৃহকর্মী মানেই এরা ভীষণ ছোট এক ক্লাস, এক টেবিলে খাওয়ার তো প্রশ্নই উঠেনা।

কিন্তু ক’দিন আগেই ফেসবুকে উঠে এলো একটা ছবি, শপিং সেরে টাকা বাঁচাতে আলাদা রিক্সা না নিয়ে গৃহকর্মীকে রিক্সার পেছনে ঝুলিয়ে নিয়ে আসতে, এ বড় বেশি বেদনার ঘৃণ্য এক দৃশ্য!

নির্যাতনের নির্মম চিত্র আমাদের সামনে আরো আছে। আছে কোন একটিরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না পাওয়ার দৃষ্টান্ত।

এটা ঠিক আজকের নানান প্রেক্ষাপটে, মানুষের মানবিকতা একটু বেশিই দুর্লভ এক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোটা সামাজিক চিত্র আমাদের দেখায় মানুষের ভিতরের কোমলতা, মানুষ হিসেবে নুন্যতম মানবিকতার এক তীব্র খরা। নির্যাতনের ভয়াবহতা বিশেষ করে শিশুদের উপর আমাদের ভীষণ ভাবে শঙ্কিত করে তোলে।

আজ শুধু বলতে চাইছি গৃহকর্মে আছে অল্পবয়সী এই সুবিধা বঞ্চিত বাচ্চাদের নিয়ে। অভাবের তাড়নায় যে পিতা-মাতা বাধ্য হচ্ছেন তার সন্তানকে সচ্ছল একটা পরিবারে পাঠাতে, তাদের বাচ্চাটি খেতে পারবে এই আশাতেই কেবল। পড়ালেখা, চিকিৎসা সেসবের বিষয় বাদ দিয়েও, একটা বাচ্চা কত ঘণ্টা কাজ করছে এনিয়ে তাঁদের কোন নিয়ম বা প্রত্যাশা নেই।

বলা যায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম আইনের প্রয়োগ অনেকটাই দুরাশা।

অনেক গৃহকর্মী ভালো আছে, নিজের মনের মতনই নতুন একটা পরিবার পাচ্ছে, তেমনটি আমরা যে দেখছিনা, তা না। আছে নিশ্চয়ই আছে, তবে নির্যাতনের চিত্রগুলো অনেক বেশিই হতাশ করে দেয় আমাদের।

কাজ করতে হবে এই বিষয়টি নিয়ে। ভাবছেন, সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগ নিচ্ছেন এমন ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিষ্ঠান সবাইকে একযোগে। সরকারি উদ্যোগের বিষয়গুলোর ইতিবাচক যদি কিছু থেকে থাকে তা উঠে আসা উচিত এবং উচিত নেতিবাচক কর্মকাণ্ডগুলোও। পদবী নিয়ে দায়িত্ব নিয়ে বসে আছেন, কোন রকম কাজ করছেননা তাদেরকে আনতে হবে জবাবদিহিতায় আমাদেরকেই।

মিডিয়ার সোচ্চার ভূমিকায় আমরা আজ পারছি, অন্তত নির্যাতককে চিনতে অনেক ক্ষেত্রেই, সামাজিকভাবে তাদের বয়কট তো করতে পারছি। দেখছি সেইসব মানুষদের যারা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করছেন নির্যাতকদের। এইটুকু পাওয়াও আমাদের আশাবাদী করে তোলে গৃহকর্মীর উপর যেকোন ধরনের শারীরিক মানসিক নির্যাতন বন্ধ হোক, না একটিও না, কিছুতেই না আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশে।

বাংলাদেশে বাস্তবতা যতদিন না আমাদের শিশু কিশোরদের গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ বন্ধ করার পরিবেশ পরিস্থিতির জন্য সবটুকু সহায়ক হচ্ছে ততদিন তাদের দুর্ভোগ কমানোর কাজটা অন্তত দরকার, ভীষণ দরকার। একের পর এক নির্যাতন চিত্রগুলো বড় বেশি নির্মম, বড় বেশি কষ্টের। বুঝতেই পারছিনা, এর শেষ কোথায়। একটি সভ্য দেশের মানুষ হিসেবে এ দায় আমি আপনি রাষ্ট্র কেউ কি এড়াতে পারি, পারা উচিত!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।