সেই নব্বই দশকের শুরুর দিকের কথা। পাশের ঘরে কোনো এক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে গান বাজছে। আমি পড়ায় মন দিয়েছি। কিন্তু হঠাৎ এক এক্সট্রা অর্ডিনারি ভয়েস ও টিউন পড়া থেকে আমার মন কেড়ে নিলো। কৌতুলী প্রশ্ন এভাবে কে গাইছেন? কিন্তু সাহস হলো না পড়া ছেড়ে ওঠার। তবে সারা রাত মাথায় ঘুরতে লাগলো গানটি।
পরদিন ঘুম থেকে উঠেই দিলাম ছুট, ক্যাসেটের দোকানে। ভাই, ‘তুমি কেন বোঝনা তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়’ এই গানটা আছে? শুনে দোকানদার মহাবিরক্ত। সরাসরিই বলেদিলেন, ‘না রে ভাই নাই।’ আরেকটু যোগ করে বললেন, ‘সকাল থেকে একশ’ কাস্টমার এই গান খুঁজছে, আমিও তো বুঝতে পারছি না এটা কোন শিল্পীর গান।’
বিকাল নাগাদ ‘চলো বদলে যাই’ এর বিরহের আগুন ছুঁয়ে গেলো মধ্যবিত্ত কিশোর-কিশোরী আর তরুণ তরুণীর বিরহী অন্তর। এ্যালবামের নাম ‘সুখ’ আমরা পাগল হয়ে খুঁজতে লাগলাম এই শিল্পীর অন্য এ্যালবামগুলো। আমাদের মধ্যবিত্ত পাড়ায় পাওয়া গেলো না। তবে খবর এলো ‘সোলস’ ভেঙে গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চু নতুন ব্যান্ড করেছেন। নাম ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’ বা এলআরবি। শুধু ‘সুখ’ না, এরা একটি ডাবল এ্যালবামও করেছেন। সারগাম থেকে রিলিজ হয়েছে।
তবে সব দোকানে পাওয়া যায় না। দাম বেশি। চেনা নেই, জানা নেই এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে চলে গেলাম এলিফেন্ট রোডের গানের ডালিতে। পেয়ে গেলাম এলআরবি’র ডাবল এ্যলবাম। জানতে পারলাম, এরই মধ্যে এই ব্যান্ডর গান হকার, মাধবী, ঢাকার সন্ধ্যা, উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং ধনী পরিবারের তরুণের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয়। পাগলের মতো শুনতে লাগলাম এলআরবি’র একের পর এক গান। এরই মধ্যে এলআরবি লিটল রিভার ব্যান্ড থেকে ইয়োলো রিভার ব্যান্ড হয়ে লাভ রানস ব্লাইন্ড এ স্থির হয়েছে। বাংলা সব ব্যান্ডকে পেছনে ফেলে শীর্ষে আছে কনসার্টে।
আমিও এলআরবি’র গান শুনতে শুনতে একটু বড় হচ্ছিলাম। জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রদায়কের কাজ শুরু করলাম। জীবনের প্রথম এ্যসাইমেন্ট পড়লো আইয়ুব বাচ্চুর সাক্ষাতকার। বাচ্চু ভাইয়ের তখন নিঃশ্বাস নেবার সময় নেই। আমি তার ভীষণ ভক্ত এই সুযোগ নিশ্চয়ই হাতছাড়া করবো না, এই ভেবেই হয়তো আমাকে বলা হয়েছিলো। দেখা আমি ঠিকই করলাম। কিন্তু হাত পায়ের কাপাকাপি আর থামতে চায় না। বস হয়তো বুঝলেনও। কফি খাওয়ালেন। গান শোনলেন। ততক্ষণে আমি ধাতস্থ হয়েছি। শুরু হলো ইন্টারভিউ।
তা চললো টানা এক ঘণ্টা। তার সম্পর্কে আমার জানাশোনায় মুগ্ধ হলেন। বললেন, যোগাযোগ রাখতে। অফ দ্য রেকর্ড জানালেন; চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এসে স্ট্রাগল লাইফের কথা। চট্টগ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানের টিভি দেখে গিটার শেখা আর ঢাকার শাজাহানপুরের জলে ডোবা ম্যাসে শুকনো মরিচ দিয়ে দিয়ে আলুভর্তা আর ভাতের কাহিনী।
যোগাযোগ রইলো। আমি বিস্ময় নিয়ে দেখতে লাগলাম এই মহাতারকার আর্বিভাব এবং বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের জয়। তিনি ব্যন্ডের গন্ডি ছড়িয়ে চলচ্চিত্রসহ গানের সব ক্ষেত্রে বিচরণ শুরু করলেন। এতে আমরা যারা উনার পপ ইমেজকে ভালোবাসতাম, তারা কিছুটা মনক্ষুন্ন হলাম। উনি থেমে থাকেননি। হয়তো কিছুটা বিভ্রন্ত হলেন। তবে তার ভক্তের সিমা ছাড়ালো সবকিছু। আমিও উনার গাওয়া ‘এক আকাশ তারা’, ‘সখী’, ‘নদীর বুকে চাঁদ’সহ গোটা ২০/২৫টা গান তার জন্য লিখে সাক্ষি হলাম ইতিহাসের।
নব্বই দশকের বাংলা ব্যন্ড গানের যে প্রসার ঘটে তার অন্যতম অবদান যে এই লিজেণ্ডের। তা আজকের দিনে আরো সুস্পষ্ট। এখন অবশ্য অনেকে তাকে গায়কের চেয়ে গিটারে বড় করে দেখতে চান। হয়তো খোদ আইয়ুব বাচ্চুও এভাবেই ভাবতে ভালোবাসেন। তবে আমারা যারা এক জীবনে তার ভক্ত, সেই আমারা জানি তার ওই কণ্ঠই আমাদের প্রথম আলাদা করেছিলো বাংলা গানে। তার ওই কণ্ঠই জানিয়েছিলো আমাদের, ইয়েস… বাংলা গান এভাবেও গাওয়া যায়। সমমনা অনেকেই ইদানিং বলেন, এই গানটা কেন বস গাইলো?
ওটা না করলেও পারতেন। আইয়ুব বাচ্চুর গীতিকার হিসেবে নয়, তার ছোট্ট একজন ভক্ত হিসেবে তার জন্মদিনে আজ বলতে চাই … হয়তো বা ভক্তদের অনেক অভিযোগ কোন কোন ক্ষেত্রে সঠিক। তবে আইয়ুব বাচ্চুর গানের ইতিহাস অনেক বড়, আকাশের মতো। ছোটখাট ভুলত্রুটি মানুষ ভুলে যাবে। মনে রাখবে একদিন এক গিটারওয়ালা এসেছিলেন এই শহরে। গানে গানে বশ করেছিলেন গোটা তরুণ প্রজন্মকে। সেই মন্ত্রে মুগ্ধ গোটা ব্যন্ড মিউজিক ভক্ত…. এই ঘোর কাটার নয়। বিশ্বাস না হলে এখনো সুযোগ আছে। একবার ফুল ভলিউমে এলআরবি বাজিয়েই দেখুন। হিন্দি নয়, বাংলা গানে আস্থা ফিরে পাবেন। আল্লাহ আইয়ুব বাচ্চুর নেক হায়াত দান করুন।
শুভ জন্মদিন বস…
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)