রাজধানীর মালিবাগ রেলক্রসিং-এর ওপর নির্মাণাধীন মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসের পর অনেকের মনেই প্রশ্ন: গার্ডার জিনিসটা আসলে কী? এর কাজটাই বা কী? গার্ডার ধসে পড়ার পেছনে কি ফ্লাইওভারের এই অংশের নির্মাণ প্রক্রিয়ার কোন ত্রুটি ছিল? নাকি অন্য কোন সমস্যা? এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলতঃ ক্রেনের পরিচালনাগত ত্রুটিতেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।
তারা বলছেন, নিচে ঢালাই করে গার্ডারের কাঠামো তৈরির পর ক্রেনের সাহায্যে তা ওপরে তোলা হয়। এ প্রক্রিয়ায় ‘নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত দুটি ক্রেনের সমন্বয়হীনতার কারণে’ মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে বলে ফায়ার সার্ভিস এবং প্রকৌশলীরা মনে করছেন।
রোববার দিবাগত রাত ২টার সময় ধসে পড়ে নির্মাণাধীন মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভারের গার্ডার। সেসময় একজন পথচারী ছাড়াও তিনজন নির্মাণকর্মী ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েন। তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যে পাঠানো হলে স্বপন (৪০) নামে একজন নির্মাণ শ্রমিক মারা যান।
গার্ডার কী?
গার্ডার কী এবং দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ জানতে প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলেছে চ্যানেল আই অনলাইন। প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান শুভ গার্ডার বিষয়ে ব্যাখ্যা করেছেন।
ভবনের ক্ষেত্রে যেমন বিম, ফ্লাইওভারের জন্য তেমনি গার্ডার
তিনি বলেন, ভবনের ক্ষেত্রে যেমন বিম, ফ্লাইওভারের জন্য তেমনি গার্ডার। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে কলামের উপর বিম বসানো হয়, আর গার্ডার বসানো পিলারের ওপরে। পিলার ও স্ল্যাবের মাঝখানে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য এই গার্ডার বসানো হয়।
‘মূলতঃ ভার্টিকাল লোড নেওয়ার জন্য গার্ডার ব্যবহার করা হয়। ব্রিজের উপর দিয়ে গাড়ি বা অন্যান্য পরিবহনের ভার বা লোড সামাল দেওয়াই গার্ডারের কাজ।’
দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ
খিলগাঁও ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র কর্মকর্তা মোঃ নজরুল ইসলামের মতো মাহমুদুর রহমানও ক্রেনের পরিচালনাগত ত্রুটির কারণেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে ধারণা করছেন। এ দুর্ঘটনার পেছনে ‘ক্রেনের মিস হ্যান্ডেলিংয়ের বিষয়টাই কারণ’ বলে ধারণা করছেন প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান।
ক্রেনের ত্রুটিও থাকতে পারে
‘তবে ক্রেনের ত্রুটিও থাকতে পারে,’ জানিয়ে তিনি বলেন, তদন্তের আগে এ বিষয়ে চূড়ান্ত করে কিছু বলা যাবে না।
দুর্ঘটনার কারণ তদন্তের জন্য এরইমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন। দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় তিনি বলেন, কমিটির তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে দোষীদের কঠোর শাস্তি দেয়া হবে।
যেভাবে বসানো হয় গার্ডার
নির্মাণাধীন মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভারের ক্ষেত্রে ভিন্ন জায়গায় গার্ডারের কাঠামো নির্মাণের পর তা ক্রেনের সাহায্যে উপরে তুলে নির্ধারিত জায়গায় বসানো হচ্ছে। আবার নির্ধারিত জায়গাতেই শাটারিং করে ঢালাইয়ের সাহায্যে কাঠামো নির্মাণের প্রক্রিয়াও রয়েছে। তবে ফ্লাইওভার নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রথম পদ্ধতিটিই ব্যবহার করা হয়।
প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান বলেন, আসলে অন্য জায়গায় শাটারিং বা ছাঁচ তৈরি করে ঢালাই করে গার্ডারটির কাঠামো তৈরি করা হয়। পরে ক্রেনের সাহায্যে তা উপরে তোলা হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলে প্রিকাস্ট (precast)। অন্য ক্ষেত্রে নির্ধারিত স্থানেই শাটারিং করে ঢালাই দেওয়ার প্রক্রিয়াকে বলা হয় কাস্ট ইন সিটু (cast in situ)।
‘এখানে প্রিকাস্ট পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে।’
তিনি অবশ্য বলেন: গার্ডার নির্মাণ বা গার্ডারের কোন ত্রুটি ভাবার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে এক জায়গায় গার্ডারের কাঠামো ঢালাই দিয়ে পরে তা ক্রেনের সাহায্যে উপরে তোলা হয়। উপরে তোলার সময় ক্রেনের পরিচালনাগত ত্রুটির কারণেই এমনটি হতে পারে।’
মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভারটি নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা গ্রুপ। আহতদের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির একজন প্রকৌশলীও রয়েছেন।
২০১২ সালে চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট জংশনে নির্মাণাধীন উড়ালসড়কের গার্ডার ভেঙে অন্তত ১৩ জন নিহত হয়েছিলেন। এবার রাজধানীর মালিবাগে ঘটলো একই ধরনের দুর্ঘটনা।