ছেলে-মেয়েদের গান শেখার ক্ষেত্রে বাজনার ব্যবহার নিয়ে নিজের ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন সিটিগ্রুপের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাংবাদিক সাখাওয়াত রাব্বী অনিক।
তার স্ট্যাটাস-
বাচ্চা কাচ্চা কে যদি গান বাজনা শিখাতে চান, দয়া করে হারমোনিয়াম যন্ত্রটি দিয়ে এদের মিউজিকের জগতে ঢুকাবেন না ।
মানুষ যখন গান গায়, তার গলাটাকে বলা হয় লিড বা মূল বা নেতা। আর পেছনে মিউজিক যেটা বাজে তাকে বলে একোম্পানিমেন্ট বা সহকারী বাজনা। লিড ভোকাল একটা সুর তোলে গলা দিয়ে, আর পেছনের বাজনা গুলো সেই সুরের চারিদিকে নানা ধরণের শব্দের সম্ভার দিয়ে লিড গানটাকে ভরাট করে তোলে। এই কারণে দেখবেন কোন গানের শুধু বাজনাটা যদি ট্র্যাক হিসেবে শুনেন তাহলে মনে হবে ঠিক মধ্যখানে কিছু একটা মিসিং বা নেই। এই মিসিং জায়গাটা খালি রাখা হয় লিড ভোকালের জন্যে। অনেকটা বড় নেতার বা ভিআইপির জন্যে রাস্তায় লেন ফাঁকা রাখার মতোই একটা ব্যাপার।
হারমোনিয়াম যন্ত্রটা মিউজিকের উপরের ফর্মুলা ফলো করে না। গলা সরিয়ে দিয়ে যদি কোনো গানের শুধু হারমোনিয়ামটা আপনি শুনেন, তাহলে দেখবেন কোন কিছু মিসিং নাই। কোনো লেইন ফাঁকা নেই। গলা দিয়ে যেই সুর তোলার কথা, সেই একই সুর হুবহু হারমোনিয়ামেও বাজানো হচ্ছে। ভিআইপির লাইনে সহকারী দৌড়াচ্ছে। একই সুর গলা ও সহকারী বাদ্য যন্ত্রে একই সাথে বাজাতে, মিউজিকের ভ্যালু এড বা বিস্তার কম হচ্ছে।
হারমোনিয়ামের উপরের এই সীমাবদ্ধতার সুদূর প্রসারী প্রভাব আছে। এই সীমাবদ্ধতাটা কি এবার একটু বুঝাবো, ব্যাপারটা কিছুটা টেকনিক্যাল।
গান মানে হলো স্বরলিপির উঠানামা। যেমন ধরেন, ৪/৪ —– সা সা গা মা । মা গা সা পা । গা রে সা মা । মা পা সা ধা । —— ০ এখানে যেটা লিখলাম এটা একটা সুর। দুনিয়ার যেকোণ যন্ত্রে এটা বাজালে একই সুর বাজবে, হারমোনিয়ামে বাজালে, গিটারে বাজালে, কিংবা খালি গলা দিয়ে গেলেও হুবহু একই সুর বাজবে।
সমস্যা হলো হারমোনিয়াম দিয়ে উপরের সুরটা যে শিখবে সে একই সুর ছন্দে ছন্দে তালে তালে গলা দিয়েও বাজাবে, আবার হার্মোনিয়ামেও বাজাবে। এক্ষেত্রে কে ভালো গাইলো আর কে খারাপ গাইলো তা নির্ভর করবে কে কার গলা কত পারফেক্টলি হারমোনিয়ামের সাথে মেলাতে পারছে, বা ফলো করতে পারছে তার উপর। গানের মাস্টাররা একেই বলে “গলাটা ঠিক মতো বসা”
এই কারণে ভোর বেলা দেখবেন হারমোনিয়াম ধরে গান যারা শিখে তারা ” সা রে সা রে গা গা , রে গা রে গা মা মা ” করছে । অর্থাৎ হারমোনিয়ামের সাথে গলা বসাচ্ছে !!
এই কাজটা একটা তোতা পাখি এফেক্ট সৃষ্টি করে। একই গান কে কতো পারফেক্টলি গেতে পারলো তার কম্পিটিশন শুরু করে, পুরোন গান নতুন ভাবে গান গাওয়াকে নিরুৎসাহিত করে। বলতে পারেন কল্পনা শক্তি বা ইমাজিনেশন নষ্ট করে, মিউজিকের ফলোয়ার সৃষ্টি করে, গানের নির্মাতা বা লিডার বানাতে পারে কম। ব্যাপারটা আবার বুঝাই।
কেউ যখন গিটার বা পিয়ানো দিয়ে কোন একটা গান তোলে, সে লিখে রাখে কিছু কর্ড। যেমন “আবার এলো যে সন্ধ্যা” গানটা আমার গানের খাতায় লেখা আছে সি, ই মাইনর, এ মাইনর। জাস্ট ৩ – ৪ তা কর্ড। বাকিটা আমার মনে মনে থাকে, স্বাধীন ভাবে গানটা গাওয়ার সাহস জোগায়।
এবার কর্ড ব্যাপারটা বুঝাই।
— সা গা পা — এই তিনটা নোট বা স্বর একসাথে ধরলে একটা কর্ড হয়। কর্ডের মজা হলো, উপরের একটা মাত্র কর্র্ডে আপনি সা গা পা, সা পা গা, পা গা সা, পা সা গা , সা সা পা, সা সা পা , সা সা গা ইত্যাদি অনেকগুলো সুর গেতে পারবেন, বেসুরা লাগবে না। এই কারণে যারা পিয়ানো বা গিটার বাজায় গান শেখে, তাদের মধ্যে শুরু থেকেই যে কোন চেনা সুরকে হুবহু না গাওয়ার প্রবণতা থাকে। তারা জানে একই কর্ডের উপর নিজের মতো করে গেলেই চেনা একটা গান উঠে যাবে।
একারণে যখন ফিডব্যাকের মাকসুদ কিংবা কবির সুমন রবীন্দ্র সংগীত গায়, তারা ন্যাচারালি অনেক বেশি ফ্রিডম নিয়ে গায়, এটা তাদের কর্ড ধরে গান গাওয়ার ওরিয়েন্টেশনের কারণে হয় বলে আমার ধারণা।
অন্য দিকে হারমোনিয়াম যারা ব্যবহার করে, তাদের কাছে – সা গা পা — বলতে শুধু একটা সুরই বুঝায়, তারা একই সুর একই ভাবে যুগ যুগ ধরে গায়, কেননা তাদের স্বরলিপির খাতাতে সুরটা সেই ভাবেই লেখা থাকে । এটা সৃষ্টি করে এক ধরণের অতীত মুখিতা, মিউজিক্যাল মৌলবাদ।
এবার আসি হিউম্যান এবিলিটির উপর।
আল্লাহ মানুষকে হাত দিচ্ছে ২ টা, আঙ্গুল দিচ্ছে ১০ টা। গানিতিক ভাবে, দুই হাত আর দশ আঙ্গুলের সব গুলোকে যদি সুর তোলার জন্যে ব্যবহার করা যায়, তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই অনেক বেশি স্বরলিপি একবারে বাজানো যাবে, সুরটা বৈচিত্রময় হবে, শুধু এক হাত দিয়ে কিংবা পাঁচ আঙ্গুল ব্যবহার করে সুর তোলার চাইতে।
হারমোনিয়াম যখন কেউ বাজায়, তখন এক হাত ব্যস্ত থাকে ফিজিক্যাল লেবার বা কামলা খাটার কাজে, সুর তোলার কাজে না। বাকী যে হাতে সুর তোলা হয়, বেশি ভাগ হারমোনিয়াম বাদক সেটারও মাত্র ২ থেকে ৩ আঙ্গুল ব্যবহার করেন, ৫ আঙ্গুল না। এটা আল্লাহর দেয়া বাকি ৬ – ৭ টা আঙুলের অপচয়।
পিয়ানো বা গিটারে দুই হাতের দশ আঙুলের প্রতিটাকেই একই সাথে সুর তোলার কাজে ব্যবহার করা যায়। এই কারণে এই দুই যন্ত্রে তোলা সুর বা বাজনা অনেক বেশি বৈচিত্রময় হয়, ৩ আঙুলে বাজানো হারমোনিয়ামে তোলা বাজনার থেকে। এই পার্থক্যটা রীতিমত গাণিতিক, এটা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ খুব কম।
উপরের আলোচনার আলোকে উপসংহার হলো, বাচ্চাদের প্রথম মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট হিসেবে গিটার বা পিয়ানো দিয়ে শুরু করুন। আর এর সাথে রাখুন তবলা কিংবা ড্রাম। তবলা বনাম ড্রামেও ফিজিক্যাল এবিলিটির ব্যাপার আছে।
ড্রাম বাজাতে ২ হাত ২ পা লাগে, তবলা বাজাতে শুধু ২ হাত। কিন্তু তবলা ড্রামের সাথে সমানে সমান পাল্লা দিতে পারে, কেননা তবলা বাদকের দুই হাতের ১০ আঙ্গুল আলাদা আলাদা শব্দ তৈরী করে, আর ড্রাম বাদকের আঙুলের কোন ব্যবহার থাকে না, তার দুই হাত একই সাথে ২ টা শব্দ তৈরী করতে পারে, সেই সাথে দুই পা শুধু দুইটা শব্দ। ড্রামার তার এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে নেয় ১০ – ১২ প্রকারের ড্রাম একসাথে জোড়া দিয়ে, যাকে বলে ড্রাম সেট। তবলার সেটে সাধারণত ২টা তবলা থাকে, বেশী হলে ৩ টা, এর বেশি এক সাথে থাকে না। সব মিলিয়ে, মিউজিকের কেরামতির খেলায় তবলা ও ড্রাম তাল লয় সেখার জন্যে সমানে সমান।
হারমোনিয়াম নিয়ে লাস্ট কথায় আসি । এই যন্ত্রটা বাংলার যন্ত্র না, ঠিক যে ভাবে পিয়ানো গিটারও বাংলার যন্ত্র না। সুতরাং আজাইড়া মায়ার জালে এই হারমোনিয়াম যন্ত্রটাকে জড়াবেন না।
হারমোনিয়াম যন্ত্রটি সায়েন্টিফিক দিক থেকে দুর্বল, এবং সব চাইতে বড় কথা এইটাকে যে হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে এর আবিষ্কারক বানিয়েছিল (লিড সিনথে-সাইজার হিসেবে) , আমরা তার থেকে অনেক বেশী গুরুত্বপূরর্ন কাজ একে দিয়েছি। এটা যন্ত্রের কোন দোষ না, দোষটা আনাড়ি বাঙালি/দক্ষিণ এশিয়ানদের।