গবেষণা একটি পবিত্র দায়িত্ব, নিবিষ্ট চিত্তে সততার ন্যায় ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে গবেষণা কর্মটি সম্পাদন করতে হয়। এক একটি গবেষণা যথেষ্ট শ্রম সাপেক্ষ এবং এতে যথেষ্ট আর্থিক ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। অন্যের লেখা নিজের নামে চালিয়ে দেওয়ার রীতিকে গবেষণা বলে না, এসব রীতিকে বলা হয় প্রবঞ্চনা, প্রতারণা ও শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের পায়তারা। সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণায় মূলত দুটি প্রধান উদ্দেশ্য থাকে। একটি হচ্ছে নতুন কিছু আবিষ্কার করা অন্যটি হচ্ছে প্রচলিত বিষয়গুলির পরীক্ষণ সম্পন্ন করে নির্ভরযোগ্যতা যাচাই।
আর একজন প্রকৃত গবেষক সচেতনভাবে মূল্যবোধে বলীয়ান হয়ে গবেষণা কর্ম সম্পাদন করে থাকেন। সুতরাং একজন প্রকৃত গবেষক কখনোই অন্যের আবিষ্কৃত তথ্য নিজের নামে চালিয়ে দিতে পারে না। বিগত কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় গবেষণা তথ্য চুরি তথা প্ল্যাজিয়ারিজম নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। তাই আগ্রহী ছাত্র এবং নতুন প্রজন্মের গবেষকদের জন্য নিবন্ধটি লেখার চেষ্টা করে হয়েছে।
শুরুতেই বলে নিচ্ছি বিভিন্ন ওয়েবসাইটের সাহায্য নিয়ে নিবন্ধটি তৈরি করা হয়েছে। নিবন্ধে গবেষণায় প্ল্যাজিয়ারিজমের ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক, প্ল্যাজিয়ারিজম থেকে বাঁচার উপায়, রেফারেন্স ব্যবহারের ধরণ, সাইটেশন দেওয়ার নিয়ম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্ল্যাজিয়ারিজমের প্রত্যয়টির সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়ন নেই।
এক এক সাইটে এক এক ভাবে দেওয়া হয়েছে, তবে মোদ্দাকথা হচ্ছে, ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃতভাবে যদি অন্যের বুদ্ধিভিত্তিক তথা সৃজনশীল ধারণা, সৃষ্টিকর্ম, আর্টিকেলের লেখা বা অন্যান্য যে কোন ব্যবহৃত উপাদান (গবেষণায়) যথাযথভাবে কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করেই নিজের নামে অবলীলায় চালিয়ে নেওয়াকেই প্ল্যাজিয়ারিজম বলে। বুদ্ধিভিত্তিক সম্পত্তি হল সৃজনশীল কর্ম যাহা সুস্পষ্টরূপে প্রকাশের মাধ্যমে (অন্যদের দ্বারা ব্যবহারযোগ্য হবে) মর্যাদা রক্ষিত হয়ে থাকে যেমন: কৃতিসত্ব (আবিষ্কৃত দ্রব্য কিংবা তথ্য তৈয়ার বা বিক্রয়ের একমাত্র অধিকার), পণ্যচিহ্ন (কোম্পানীর লগো সম্বলিত অথবা গ্রন্থস্বত্ত্বে উল্লেখিত থাকে। বাজারে যে সব বই পাওয়া যায় সেখানেও উল্লেখ থাকে, লেখকের অনুমতি ব্যতীত বইয়ের কোন অংশ ব্যবহার করা যাবে না।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক সত্যতা নিরুপনের জন্য এবং গবেষণায় ছাত্রদের একনিষ্টভাবে আত্ননিয়োগের জন্য প্ল্যাজিয়ারিজম রোধ করতে বিভিন্ন ধরনের পলিসি কিংবা বিধি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। যদি তত্ত্বাবধায়ককারী বুঝতে পারেন ছাত্র গবেষণা করার ক্ষেত্রে অসৎ উপায় অবলম্বন করেছে অর্থাৎ প্ল্যাজিয়ারিজম দোষে আদিষ্ট তাহলে তাকে ডিনের মুখোমুখি হয়ে জবাবদিহি করতে হয়। এরকম ব্যবস্থা গ্রহণের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, গবেষণালব্ধ ফলাফলের মাধ্যমে নিজের দেশকে সহজেই সারাবিশ্বে মর্যাদার সহিত প্রতিষ্ঠিত করা যায়। যেমন: পাটের জিনোম আবিষ্কারের মাধ্যমে মাকসুদুল আলম বাংলাদেশকে বিশ্বে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে সক্ষম হন। সুতরাং গবেষণা সামাজিক বিজ্ঞানে কিংবা বিজ্ঞানে হোক সেটা বিষয় নয়, বিষয় হচ্ছে যথার্থতা ও গ্রহণযোগ্যতা। আর গ্রহণযোগ্য তখনই হবে যখন যথাযথ নিয়মনীতি ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মাধ্যমে ফলাফল আনয়ন সম্ভবপর হবে।
অনুমতি বা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা ছাড়া অন্যের লেখা নেওয়া গবেষণা নীতিমালার ঘোরবিরোধী তথা প্ল্যাজিয়ারিজম । তাই গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় (বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ গবেষণা করা) চুরি করার (লেখা কিংবা তথ্য) শাস্তির বিষয়ে বিভিন্ন নীতিমালা তাদের বিধিতে উল্লেখ করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়; Stark State College of Technology- এ ছাত্রদের জন্য নিয়ম উল্লেখ করে দিয়েছে।
যেমন:
১. প্রথমবার অপরাধের ক্ষেত্রে যে বিষয়ে (প্রজেক্ট, পেপার, টেস্ট, এ্যাসাইনমেন্ট) তথ্য গোপনের অভিযোগ পাওয়া যায় সে বিষয়ে ফেল দেওয়া হয় । ধরুণ: সমসাময়িক অপরাধবৈজ্ঞানিক ইস্যু নিয়ে আপনাকে একটা এ্যাসাইনমেন্ট করতে দেওয়া হলো। শিক্ষক যদি কোন কারণে সামান্যতমের জন্য হলেও কপি ধরতে পারেন তাহলে সেই এ্যাসাইনমেন্টে আপনাকে ফেল দেওয়া হবে।
২. দ্বিতীয়বার প্ল্যাজিয়ারিজমের অপরাধের ক্ষেত্রে ওই বিষয়ে ফেল দেওয়া হয়। অর্থাৎ, ধরুণ এপ্ল্যাইড ক্রিমিনোলজি কোর্সে যদি আপনি ২য় বার তথ্য নকল করেন তাহলে ওই বিষয়ে আপনি ফেল হিসেবে বিবেচিত হবেন।
৩. তৃতীয়বার অপরাধের ক্ষেত্রে ওই সেমিস্টার থেকে বাতিল করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, ১ম বর্ষ ২য় সেমিস্টারে যদি আপনি ৩য় বারের মত প্ল্যাজিয়ারিজম করে থাকেন তাহলে ওই সেমিস্টারে আপনি অযোগ্য প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হবেন।
৪. চতুর্থবার এ সংক্রান্তে অপরাধের ফলে ভর্তি বাতিল হয়ে যায়। অর্থাৎ, প্ল্যাজিয়ারিজম সংক্রান্ত অপরাধ যদি চতুর্থবারের মত করেন তাহলে আপনার ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যাবে।
বিশ্বের বিভ্ন্নি দেশে ছাত্রদের দ্বারা তৈরি এ্যাসাইনমেন্ট, টার্ম পেপার, সেমিনার, মনোগ্রাফ, থিসিস পেপার, ডিজার্টটেশন পেপারে কপি-পেস্ট কিংবা তথ্য চুরি সংক্রান্ত এমন বিধান রয়েছে। বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্ল্যাজিয়ারিজম সংক্রান্ত এমন কোন লিখিত নিয়মের বালাই নেই। আপনি যদি অন্যের লেখা যথাযথ রেফারেন্স ব্যবহার না করে নিজের নামে প্রকাশ করেন, তাহলে গ্রন্থকার গ্রন্থস্বত্ত্ব আইনে আপনার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে। আর একবার ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখেন আপনার লেখা কোন তথ্য যদি যথাযথ কৃতজ্ঞতা না দিয়ে নিজের নামে প্রকাশ করে তাহলে আপনার কেমন লাগতে পারে?
কাজেই, যথাযথ সাইটেশন আপনাকে একাডেমিক নিয়মকানুন অনুসরণ এবং অপ্রীতিকর ঘটনা থেকে রক্ষা করবে এবং এটি খুবই প্রয়োজন। তাই প্ল্যাজিয়ারিজম থেকে মুক্ত থাকার জন্য আপনাকে রেফারেন্সের সুনির্দিষ্ট স্টাইল সম্বন্ধে জানতে হবে। যেমন: অক্সফোর্ড স্টাইল, শিকাগো স্টাইল, হার্বাড স্টাইল, এমএলএ স্টাইল, তুরাবিয়ান স্টাইল, এপিএ স্টাইল; এ রকম প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের মতো রেফারেন্সিং সিস্টেম চালু করেছে। তার আগে জেনে নেওয়া যাক, সচরাচর কোন বিষয়গুলোতে রেফারেন্স ব্যবহার করা অবশ্য কর্তব্য।
আপনাকে যে বিষয়গুলিতে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে হবে। তা হল; সরাসরি উধ্বৃতি, পরিসংখ্যান, ধারণা, কারো মতামত, প্রতিষ্ঠিত ফ্যাক্ট, বিশেষ তথ্য যা সকলের কাছে পরিচিত নয়, যে সকল তথ্য কম্পিউটার কিংবা ইন্টারনেট থেকে নেওয়া, ফটোগ্রাফ, গ্রাফিক্স, চার্ট যেগুলো আপনার নিজস্ব নয় সবগুলোতে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে হবে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আপনি সাইটেশন ব্যবহার করতে পারেন। এখন প্রশ্ন হতে পারে সাইটেশন কি? সাইটেশন হচ্ছে কারো লেখা কোড করা, নিজের মতো করা (প্যারাপেইজ করা); আইডিয়া ব্যবহার করা, অথবা লেখা থেকে সারাংশ নেওয়ার সময় ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা। সাইটেশন বুঝিয়ে দিবে লেখাটি কিংবা তথ্য আপনার নয় এবং প্রকৃত লেখকের সাথে শ্রোতাকে পরিচয় করিয়ে দিবে।
গবেষণা প্রবন্ধ কিংবা যে কোন কিছু লেখার ক্ষেত্রে বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কারও আবিষ্কৃত কোন উৎস থেকে তথ্য নেওয়া হলে সাইটেশন খুবই জরুরী। তার কয়েকটি কারণ রয়েছে প্রথমত: অন্যরা কিংবা নতুন গবেষকরা সহজেই আপনার উদঘাটনের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে অবগত হবেন; দ্বিতীয়ত: পূর্বেকার লেখকরা যথাযথভাবে কৃতজ্ঞতা পায়; তৃতীয়ত: পাঠকমাত্র আপনার এবং অন্যের ধারণা, বিশ্বাস এবং গবেষণালব্ধ ফলাফল জানতে পারবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আপনি কিভাবে প্ল্যাজিয়ারিজম থেকে মুক্ত থাকতে চান, এ ক্ষেত্রে আপনি paraphrasing (শব্দান্তরিত করা) এর সাহায্য নিতে পারেন। তবে এর দুটি নিয়ম অনুসরণ করতে হবে।
• লেখকের গবেষণা ফলাফল কিংবা ধারণা কিংবা পয়েন্টসকে সারাংশ আকারে নিয়ে আসতে হবে।
• তবে এর মানে এই নয় যে সামান্য কিছু শব্দ পরিবর্তন করে কাজটি হয়ে যাবে, সম্পূর্ণ বিষয়টিকে নিজের ভাষায় নিয়ে আসতে হবে সাথে সাথে, লেখকের লেখার কৃতজ্ঞতা তথা নোট প্রদান করতে হবে।
এছাড়া কোটেশনের মাধ্যমে প্ল্যাজিয়ারিজম থেকে মুক্ত থাকা যায়।
• যখন আপনি লেখকের কয়েকটি লাইন সরাসরি ব্যবহার করবেন কোটেশন দেওয়ার মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারবেন।
• যে কোন সময় কোটেশন প্রয়োগ করে লেখকের যে কোন শব্দ কিংবা আইডিয়া ব্যবহার করতে পারবেন।
তাই গবেষকদের কাছে অনুরোধ থাকবে যথাযথ নিয়মকানুন অনুসরণ করে গবেষণার প্রক্রিয়া শুরুর পাশাপাশি ফলাফলে যেন কোনভাবেই অন্যের লেখা নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া না হয়। শুরুতেই উল্লেখ করেছি, গবেষণা অনুধাবনের বিষয়, দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফসল; সুতরাং কোনভাবেই এটিকে কলুষিত করা যাবে না। চুরি করা গবেষণালব্ধ ফলাফল অনেক সময় হিতে বিপরীত হয়ে থাকে। কেননা, ৩০ বছর পূর্বের গবেষণাকর্মের ফলাফল বর্তমানে প্রয়োগ করতে গেলে নেতিবাচক ইঙ্গিত বহন করবে।
গবেষণার চৌর্যবৃত্তি রোধ করতে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালা করা সময়ের দাবি। এর মাধ্যমে গবেষকরা গবেষণার বিষয়ে আরো অধিক মনোযোগী ও সৃজনশীল হবেন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বার্থেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)