চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

গতি পেয়েছে এই শহর!

আমাদের এই শহরের গতি কত? কেউ কি স্থির করে বলতে পারবেন; ঢাকা শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণপ্রান্তে গাড়ি ছুটিয়ে যেতে ঠিক কতটা সময় লাগে?

দুদিন আগে, ভরদুপুরে উত্তরার আজমপুর থেকে মহাখালীর আমতলী সিগনাল পর্যন্ত পৌঁছতে সময় লাগলো পাক্কা আড়াই ঘণ্টা, বাসে। পরের দিন সকালবেলা একই দূরত্ব অতিক্রম করতে সময় লাগলো মাত্র কুড়ি মিনিট।

আজ থেকে ঠিক ত্রিশ বছর আগে দক্ষিণের বুড়িগঙ্গা তীর থেকে উত্তরের তুরাগ তীর গাড়িতে রাস্তাটা পারি দিতে, স্বাভাবিক গতিতে সময় লাগতো অর্ধঘণ্টার একটু বেশি।

আর এখন ‘কর্মদিবসে’ কতঘণ্টা লাগে কেউ জানে না! সেই স্থবির হয়ে যাওয়া, বিরক্তিধরা এই শহর কখনো কখনো গতি পেয়ে যায় ভীষণ। বছরে দুটো ঈদবেলা তার মধ্যে স্মরণযোগ্য। ঈদ এলে এই শহরের মানুষ অনেক কিছুর টানে ছড়িয়ে যায় ছোট্ট দেশটার শরীরজুড়ে। অনেকে স্রেফ ‘ছুটিকাটাতে’ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে চলে যায় অন্যদের গড়া পরিপাটি-চমকলাগা শহরে। এই কটাদিন জটমুক্ত শহরে চলতে গিয়ে অনেকে বলে উঠে- ‘এমন যদি থাকতো ঢাকা শহর!’

দুই.
সত্যি সত্যি এই হাহাকার ধ্বনির মতো যদি ঢাকা শহর হয়ে যেতো বা থাকতো, তাহলে কি ভালো লাগতো? প্রতিটি শহরের আলাদা রূপ-চরিত্র থাকে। দিনে দিনে ঢাকা বদলাচ্ছে। ভেতর থেকে-বাইরে থেকে বদলে যাচ্ছে শহরের রূপ আর চরিত্র। এখন ঢাকার ভেতর অনেক ঢাকা। সদরঘাট, গেন্ডারিয়া, আরমানিটোলা, গুলিস্তান আর শাহবাগ এক ঢাকা নয়। এক ঢাকা নয় ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা আর মিরপুর। এক ঢাকা নয় রামপুরা, শাহজাদপুর, বাড্ডা, নূরেরচালা, সোলমাইদ আর ভাটারা। উত্তরে-দক্ষিণে এই শহর শরীর মেলতে পারছে না, পারবে না; তাই পূর্ব-পশ্চিমে গিয়েছে অনেক দূর। দিনে দিনে কোথায় গিয়ে স্থির হবে কে জানে!

এমনি এক এলোঝেলো শহরের হঠাৎ গতি বেড়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়! সেই গতি কখনো কখনো এমনি বেপরোয়া হয়ে যায় যে হুট-হাট মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতেও ছাড়ে না। আমাদের শহর সংস্কৃতিটা এমনি যে যারা বনেদি, যারা একটু অবস্থাসম্পন্ন, যাদের নতুন টাকা হয়েছে তাদের নিজস্ব গাড়ি থাকবে। আর সেই গাড়ির জন্য চালক থাকবে। তো ঈদকালে সেই চালকেরওতো শহর ছাড়তে হয় ‘নাড়ীর টানে’। তাহলে উপায়? অগতির গতি, ঠ্যাকা দেয়া চালক হয়ে যেতে হয় গাড়ির মালিক অথবা মালিকের ছেলে-মেয়েকে। হাত পাকেনি; তাতে কি ‘রাজপথ’ ফাঁকা; তাই গতি বাড়াও-দাও টান! তারপর, পরিণতি ভয়াবহ!

অনেক বছর উত্তরায় থাকি। তাই প্রতি ঈদের সময় এয়ারপোর্ট রোডে এমনসব দুর্ঘটনার দৃশ্য দেখতে হয়েছে আমাকে। এমনো দেখেছি গতির ধাক্কায় গাড়ি সড়ক বিভাজন পেরিয়ে উল্টো হয়ে গেছে। সেই গাড়ির চালক-যাত্রীদের কী হাল হয়েছে তা আর জানার কথা ভাবিনি! এটা কার কথা যেন, যাযাবর কী? ‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’ এই সময়ে, এই শহরের জন্য কথাটা এভাবে বলা যায় যে, ঈদের ছুটি ঢাকা দিয়েছে গতি আর কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ। আমরা নানা কারণে দিনে দিনে যেভাবে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি তাতে করে শহরে গতি যদি বেড়ে যায় তাহলে নিত্য দুর্ঘটনা ঠেকানো মুশকিল হয়ে পড়বে। গতি নেই, প্রায় স্থবির শহর, তারপরও অতিনিকট অতীতে বাসের চাপায় হাত হারিয়ে মরতেই হলো রাজীব নামে এক কলেজছাত্রকে। ফ্লাইওভারে বাসের চাপায় প্রাণ গেলো একজনের। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর পা থেতলে দিলো বাস! মানুষ যদি মানুষের মূল্য বা বুঝতে চায়; জীবন যে একটা ঐশ্বর্যের নাম-এটা যদি উপলব্ধিতে না আসে তাহলে দুর্ঘটনা ঘটবেই। আমরা ফেসবুকে ঝড় তুলবো। গণমাধ্যমে শিরোনাম হবে। কেউ কেউ হাহাকার করবে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হবে না। ‘একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না’ হয়ে থাকবে যার গেছে তার কাছে।

তিন.
অতএব, নিবেদন এই যে, কটা দিনের জন্য গতি পাওয়া এই শহরে আসুন আমরা বুক ভরে বাতাস নিই। প্রত্যাশা করি যারা ফিরে গেছেন, যাচ্ছেন নিকটজনের কাছে, তাদের সব কিছু নির্বিঘ্ন হোক, নিরাপদে থাকুক এবং তারা ফিরে আসুক নিরাপদে এই ‘কাজের শহরে’। কেনো না, তিতিবিরক্ত হয়ে আপনি আমি, কতিপয়, যতোই বলি না কেনো-‘আহারে ঢাকা শহর যদি থাকতো এমন ফাঁকা ফাঁকা’- তাহলে কিন্তু এই শহর চলতো না। থাকতো না কসমোপলিটন আদলটি! এটাতো সত্যি যে ঢাকা একটা কাজের শহর। ‘কাজকাম’ আছে বলেই দেশের সবপ্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে এখানে। চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, রংপুর, বগুড়া, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ শহরকে আমরা যদি সত্যিকারের ‘কাজকামের’ শহর করে গড়ে তুলতে পারতাম তাহলে মানুষ এতো বেদনা সয়ে এই শহরে পড়ে থাকতো না; এটা আমি বিলক্ষণ মানি!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)