গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে ‘বসনিয়ার কসাই’ খ্যাত রাটকো ম্লাডিচের বিরুদ্ধে বিচারের রায় পড়ছিলেন বিচারক। এসময় অসুস্থতার কারণে সেশন মুলতবির আবেদন করে তার আইনজীবী। তা প্রত্যাখাত হওয়ায় বিচারকের উদ্দেশে চিৎকার করেন এই সাবেক বসনীয় কমান্ডার। এসময় জেনারেল ম্লাডিচকে আদালত থেকে বের করে দেয়া হয়। পরে রায়ে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক বিচার থেকে দীর্ঘ সময় পালিয়ে থাকা ম্লাডিচ গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
বসনিয়া ও হার্জিগোভিনার পূর্বাঞ্চলীয় ছোট পার্বত্য শহর স্রেব্রেনিৎসায় চালানো গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন ম্লাডিচ। ১৯৯৫ সালের জুলাইয়ের ওই ঘটনায় অন্তত ৮ হাজার নিরস্ত্র মুসলিম পুরুষ ও বালককে হত্যা করা হয়েছিল। ম্লাদিচ ওই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
বসনিয়ার কসাই খ্যাত ম্লাডিচের বিচারের রায়ের মাধ্যমে বিশেষ এই ট্রাইব্যুনাল যুগোস্লাভিয়ায় যুদ্ধাপরাধ নিয়ে কাজ শেষ করলো। এটাই যুগোস্লাভিয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিটিওয়াই) শেষ রায়।
স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যার পাশাপাশি সারায়েভো অবরোধ করে হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগও ছিলো ম্লাডিচের বিরুদ্ধে। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সার্ব বাহিনী সারায়েভো অবরোধ করে রেখেছিল। তাদের নিক্ষেপ করা গোলা ও স্নাইপারদের গুলিতে প্রায় ১১ হাজার বেসামরিকের মৃত্যু হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
২০ বছরেরও বেশি সময় পরে ‘স্রেবেনসিয়া গণহত্যা’সহ বিভিন্ন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেন ম্লাডিচ। বিচারকের উদ্দেশ্যে চিৎকার এবং কোর্ট থেকে ম্লাডিচকে বের করে দেওয়ার জন্য এই রায়ে পাঠে আধা ঘন্টারও বেশি সময় বিলম্ব হয়।
নেদারল্যান্ডসে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিটি) দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এই বিচারের রায় দেয়া হয়। জাতিসংঘের ট্রাইব্যুনালে জেনারেল ম্লাডিচের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ১১টি অভিযোগ ছিলো। সব অভিযোগই অস্বীকার করেন ম্লাডিচ।
ম্লাডিচকে আদালত থেকে বের করে দেওয়ার কিছু সময় পরেই সেশনটি আবার শুরু হয়। আলাদা একটি কক্ষে রাখা হয় ম্লাডিচকে। সেখানকার একটি টিভিতে এই রায় শুনেন তিনি।
অবশ্য সেশনের শুরুতে বেশ স্বচ্ছন্দ ছিলেন ম্লাডিচ। নিরুদ্বেগ, হাস্যজ্জ্বল ম্লাডিচকে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ইশারাও করতে দেখা যায়। রায় পড়া শুরু হওয়ার প্রায় ৪৫ মিনিট পরে তার আইনজীবী একটি বিরতি চান, যাতে তিনি বাথরুমে যেতে পারেন।
পরে ম্লাডিচের আইনজীবী বিচার কার্যক্রম স্থগিত রাখতে বলেন বা রায়ের কারণ পাঠ না করে শুধু ঘোষণা দেওয়ার অনুরোধ করেন। এই অনুরোধ বাতিল হওয়ায় জেনারেল ম্লাডিচ চিৎকার করে বলেন: তারা মিথ্যা বলছে, তুমি মিথ্যা বলছো। আমি সুস্থ অনুভব করছি না।
ম্লাডিচের আইনজীবীদের দাবি ছিলো, সার্ব বাহিনী ও তার মিত্রদের গণহত্যা এবং বেসামরিকদের ওপর ‘জাতিগত নির্মূল অভিযানে’ ম্লাডিচের জড়িত থাকার অকাট্য প্রমাণ মেলেনি। তাই অভিযুক্ত হলেও তাকে ১৫ বছরের বেশি কারাদণ্ড দেয়ার সুযোগ নেই।
দণ্ডিত হলেও যুগোস্লাভিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মুসলিম-ক্রোয়াটদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দ্রুতগতিতে সার্বদের হয়ে বসনিয়ার ৭০ শতাংশ দখলে নেওয়ায় এখনো অনেকের চোখেই ম্লাডিচ ‘নায়ক’।
এর আগে আইসিটিওয়াই ম্লাডিচের চার অধস্তনকে গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে যাবজ্জীবন দিয়েছিল।
বসনিয়ার সার্ব নেতা রাদোভান কারাদজিচ ও সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লোভোদান মিলোসেভিচের সঙ্গে মিলে ম্লাডিচ বসনিয়া থেকে মুসলমানদের সরিয়ে ‘বৃহত্তর সার্বিয়া’ প্রতিষ্ঠা করতে স্রেব্রেনিৎসায় গণহত্যার পরিকল্পনা করেন বলেও ভাষ্য তদন্ত কর্মকর্তাদের।
বসনিয়া যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আইসিটিওয়াই বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনেগ্রো ও কসোভোর ১৬১ জনের বিচার করেছে। এর মধ্যে ৮৩ জনই দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই জাতিগতভাবে সার্ব।