এক বনে সিংহ, বাঘ, শিয়ালসহ নানা প্রাণী বাস করতো। যেমনি বাস করে অন্যান্য বনেও। তারা সেখানে সুখে শান্তিতে বসবাস করতো। একদিন শিয়াল ভুল করে শক্তিশালী বাঘের পশ্চাদদেশ চুলকে দেয়। বাঘ দারুণ রাগ করে শিয়ালকে ধাওয়া দেয়। ধাওয়া খেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে শিয়াল ঢাকা শহরে ঢুকে পড়ে।
ঢাকা শহরের জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক জ্বালো জ্বালো। শিয়াল এই পত্রিকার রিসেপশনের চেয়ারে বসে মুখের উপর পত্রিকা ধরে রাখে যাতে তার মুখ দেখা না যায়। খুঁজতে খুঁজতে বাঘও জ্বালো জ্বালো পত্রিকার রিসেপশনে চলে আসে। জিজ্ঞাসা করে, এখানে কি কোন শিয়াল এসে ঢুকেছে?
ধূর্ত শিয়াল নাকি সুরে উত্তর দেয়, কোঁন শিঁয়াল যেঁটি বঁনের বাঁঘকে চুঁলকেছে! এ কথার সঙ্গে সঙ্গে বাঘ পেছন ঘুরে দে দৌড়। আর বলতে থাকে, হায় হায়, আমাকে শিয়ালের অপমানের খবর পত্রিকা অফিস চলে এসেছে? আমি তো শেষ । কাল যদি ছাপানোর অক্ষরে এটি প্রকাশ পায় তাহলে আমার কি মান-ইজ্জত কিছু বাকী থাকবে!
যুগে যুগে সংবাদপত্রকে বাঘের মতো ক্ষমতাবানরা ভয় পেয়েছে। শিয়ালের মতো ধূর্তরা একে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছে। এই দু-পক্ষের মাঝখানে একটি অংশ এই পান্ডুলিপিকে জনগণের পক্ষে ক্ষমতাবানকে প্রশ্ন করা ও সত্যকে প্রকাশ করার শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এই স্বাধীনতার মানে কি? আমাদের এখানে দুষ্ট লোকেরা বলে, দুর্নীতিবাজদের কাছ থেকে পুলিশ ঘুষ খায়, সাংবাদিক পুলিশ থেকে ঘুষ খায়। তাহলে কে বড়– সাংবাদিক নাকি পুলিশ?
রাষ্ট্রে ব্যক্তি মানুষের ক্ষমতা সীমিত বলে ব্যক্তি মানুষেরা সবাই মিলে একটি পেশাকে তাদের পক্ষে সব ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার আনুষ্ঠানিক অধিকার দিয়েছে। ব্যক্তির পক্ষে ক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলার এই শক্তির কারণে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা যুগে যুগে সব সমাজে নমস্য।
হালে বাংলাদেশে সংবাদপত্রের পাশাপাশি টেলিভিশন ও অনলাইন প্রতিষ্ঠানের বিস্তারের কারণে সাংবাদিকের সংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে। দেশে সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের জন্য ওয়েজবোর্ড বা বেতন কাঠামো রয়েছে। বতর্মানে ৮ম ওয়েজবোর্ড চালু আছে। তবে কয়টা সংবাদপত্র এই ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন করেছে সেটি নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে সাংবাদিকদের মধ্যে।
বেসরকারি টেলিভিশন শিল্পের বিকাশ ঘটলেও সেখানে বেতন নিয়ে হতাশা আছে। আর অনলাইনে (যেগুলো শুধু অনলাইন হিসেবে চালু) তো বেতন-ভাতা নিয়ে মালিকপক্ষ এক ধরণের অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন। এরই মধ্যে নতুন দাবি নিয়ে সাংবাদিক সংগঠনগুলো হাজির হয়েছে। সরকার দেশে সম্প্রচার নীতিমালা করলেও আইনের পূর্ণাঙ্গতা দিতে পারেনি। উল্টো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার টুঁটি চেপে ধরতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে খড়গ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বলে সমালোচনা রয়েছে।
রাষ্ট্রীয় নানা কাঠামোর কারণে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চিন্তার পূর্বেই মস্তিকে অকালমৃত্যু ঘটছে। সেখানে বেতন নিয়ে হতাশাকে উস্কে দেয়া গেলে আখেরে ক্ষতাবানদেরই লাভ সেটি তারা বুঝেন। এজন্যই বলেই ৮ম ওয়েজবোর্ডকে পুরোপুরি বাস্তবায়ন না করে ৯ম নিয়ে টানাটানি শুরু হওয়াকে বিজ্ঞ সাংবাদিকরা নেতিবাচকভাবে দেখছেন।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে উচ্চকিত করতে অতীতে ঢাকার উচ্চ আদালত বেশ কিছু রায় দিয়েছে। পাকিস্তান আমলে স্বৈরশাসকরা তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার পত্রিকা প্রায়ই তালাবদ্ধ করে দিতো। এস .এম মুরশিদের মতো বিচারপতিরা ঝুঁকি নিয়ে আইয়ুব খান সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মানিক মিয়ার প্রেস খুলে দিতে নির্দেশনা দিতেন। বিভিন্ন সময় বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করতে উচ্চ আদালত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করেছে।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার গুরুত্ব অনুধাবন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রথম সংবিধান প্রণয়নের ১০ বছরের মধ্যে বিল অব রাইটস সংশোধন করে। সেখানে বলা হয়েছে, কোন ভাবেই এবং কোন পরিস্থিতিতে জনগণের জানার অধিকার তথা সংবাদপত্রের অধিকার খর্ব করা যাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনকদের অন্যতম টমাস জেফারসন দাবি করতেন, সবার সব ধরণের নিরাপত্তা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর নির্ভরশীল।
উচ্চ আদালতে নবম ওয়েজ বোর্ড নিয়ে শুনানীতে একটি জনপ্রিয় পত্রিকার সম্পাদক নতুন মজুরি বোর্ডের বিরোধিতা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অথচ দেশের গণমাধ্যম ইতিহাসে এই সম্পাদক অনন্য যিনি তার প্রতিষ্ঠানকে কর্পোরেট সংবাদপত্রের কাঠামো দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমও সেটি। এমন সংবাদপত্রের সম্পাদকের সাংবাদিকদের বেতন বাড়ানোর বিরোধিতা আপাত দৃষ্টিতে সাংবাদিকদের বিপক্ষে বলে মনে হতে পারে।
কিন্তু গণমাধ্যম পরিচালনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি তাকে হয়তো এই সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য করেছে যে, সবগুলো ক্ষেত্রে মজুরি বোর্ড নির্ধারণ না করে হুট করে তার মূল খরচ বাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা সাংবাদিকতার পক্ষে নয়, বিপক্ষে যাবে।
তার এই অবস্থানের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হতে পারে। তবে এটি পরিলক্ষিত যে, সত্য প্রকাশের দুসাহ:স জাতিগতভাবে বাঙ্গালীর কমে যাচ্ছে। তাই বিচারের বাণী কি সংবাদপত্র কি আদালত সবখানে নিরবে নিভৃতে কেঁদে মরছে। বুদ্ধিমান রাষ্ট্রযন্ত্র এমনিতে দুর্বল করে দিয়েছে গণমাধ্যমকে। আপন শক্তিতে বলিয়ান হয়ে থাকা যে কয়টি পত্রিকা এখনো জনগণের কন্ঠস্বর হিসেবে রয়েছে সেটিকেও বন্ধের কৌশল যদি নেয়া হয় তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশংকা সত্যে পরিণত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের জাহাজে কখন কোথায় কোন ছোট ছিদ্র হচ্ছে তার খবর রাখে সংবাদপত্র । যদি কোন ছুঁতোয় তাকে সেই ছিদ্র খোঁজার কাজ করতে দেয়া না হয় তবে একদিন বড় কোন ছিদ্র দিয়ে প্রবল বেগে পানি ঢুকে পুরো জাহাজকে ডুবাইয়া দিতে পারে। তখন রাষ্ট্র জাহাজকে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করা সরকারের সাধ্যাতীতও হতে পারে।
সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে উচ্চ কক্ষ , নিম্ন কক্ষ, রাণীর পর ৪র্থ হলো সংবাদপত্র। সংবাদপত্র একটি জাতির বা রাষ্ট্রের প্রতিদিনের পান্ডুলিপি লেখে। তাই সতর্কতা খুব জরুরি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)