গণমাধ্যমকর্মী, লেখক ও সাংবাদিক হয়রানির বিরুদ্ধে সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে সবসময় একতাবদ্ধ হওয়া আবশ্যক। সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাহরণ সমাজ প্রগতির প্রধান অন্তরায়। লেখনীর প্রতিবাদ লেখনীতে করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন গ্রেফতার ও মামলা দিয়ে হয়রানি? সিদ্দিকুর রহমান ও শিহাব সিপনের লেখার প্রতিবাদ লেখা দিয়ে করা যেত। প্রতি সংবাদ পত্রেই প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ করার রীতি চালু রয়েছে। যারা মামলা করেছেন তারা কি মামলা দায়েরের আগে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ লিপি পাঠিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। মানে প্রতিবাদ প্রকাশ করা হয়নি তাই তারা ক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেছেন, বিষয়টা কি এরকম?
যদি তা না হয় তাদের এই মামলা অযৌক্তিক নয় কি?দেশব্যাপী সংবাদ কর্মীদের এই বিষয়ে সোচ্চার ভূমিকায় অবতীর্ন হওয়া উচিত। কে কোন পত্রিকার সাংবাদিক, কোন সাংবাদিক ফোরামের সদস্য, কোন ক্লাবের সদস্য এগুলো বিবেচ্য নয়। রাজধানী হতে উপজেলা পর্যন্ত সর্বস্তরেই মানব বন্ধন, সভা, সেমিনার ও আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকদের প্রতিবাদ মুখর হতে হবে।
সাংবাদিক সিদ্দিকুর রহমানের গ্রেফতারের প্রতিবাদে অধিকাংশ সাংবাদিক ও সাংবাদিক সংগঠনই প্রতিবাদ মুখর হয়েছেন। সাংবাদিক হয়রানীর বিরুদ্ধে অপরাপর সংবাদ কর্মীদের এই প্রতিবাদ মুখরতা প্রশংসনীয়। সব শ্রেণী-পেশার অধিকার ভিত্তিক সক্রিয় একতাবদ্ধতা রয়েছে। শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা, শ্রমিক, সরকারী বেসরকারী চাকরিজীবী, সংবাদপত্রের মালিক সবাই নিজেদের ব্যাপারে সোচ্চার। কিন্তু যারা অন্যের অধিকার প্রতিষ্ঠায় লেখালেখি করে সেইসব লেখক, সাংবাদিক নিজের অধিকারের ব্যাপারে থাকে উদাসীন। এদেশে আজও অনেক সাংবাদিক অবৈতনিক হিসাবে কাজ করে।
অনেক লেখক সংবাদপত্রে বিনা পয়সায় কলাম লেখে। আবার অনেকে টাকার বিনিময়ে রাজাকারের মালিকানাধীন পত্রিকায় কলাম লিখে। আবার অনেকেই প্রকাশককে টাকা দিয়ে নিজের লেখা বইও বের করে। এভাবেই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সৃজনশীল মেধাবী ও প্রতিভাবানরা নিজেরাই নিজেদের মেধা ও প্রতিভা বিকাশের অন্তরায় হয়ে উঠছেন। যে কোনো পেশার পূর্বশর্ত তার পেশাদরিত্ব ও অধিকার সচেতনতা।
মুক্তিযোদ্ধাদের নানা সমস্যার প্রতিকার ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্যবিভাগের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সমস্যা শোনা ও তার প্রতিকারের জন্য রয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি বিষয়ক কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সমস্যা শোনা ও তার প্রতিকারের জন্য রয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। তেমনই রয়েছে সমাজসেবা মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় প্রভৃতি।
সাংবাদিকদের মন্ত্রণালয় হলো তথ্য মন্ত্রণালয়। দেশব্যাপী সাংবাদিকদের নানা সমস্যা ও হয়রানির বিষয়ে এই মন্ত্রণালয়ের কী ভূমিকা? তবে কি এই মন্ত্রণালয় সাংবাদিক নয় সংবাদপত্র মালিকদের অধিকার রক্ষার জন্য? অন্যায়ভাবে সংবাদপত্র কর্মীদের চাকরিচ্যুত করা হয়। তাদের বঞ্চিত করা হয় বকেয়া বেতন ভাতা প্রাপ্তি হতে। কই তখনতো তথ্য মন্ত্রণালয়কে কোন ভূমিকা নিতে দেখা যায় না।
সংবাদপত্র মালিকদের মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হতে বলা হয় না তাদের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দিতে। সাংবাদিক সংস্থাগুলোকেও দেখা যায় না এব্যাপারে কোন ভূমিকা নিতে। বিষয়টা যেন যার বিষয় তার পর্যায়েই থাকে। একারণেই সাংবাদিক হয়রানি দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। সিদ্দিকুর রহমানের গ্রেফতার ও শিহাব সিপনের বিরুদ্ধে মামলার ব্যাপারে সারাদেশের সাংবাদিক সমাজ কেন একযোগে ফুঁসে উঠল না? এই দুটি বিষয়ে তথ্যমন্ত্রণালয়ের কী বক্তব্য তাও জাতি জানতে চায়।
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ফাঁসি হওয়া মীর কাসেম আলী মৌলবাদী ও পাকিস্তান পন্থী অর্থনৈতিক ভিতকে মজবুত করতেই নয়াদিগন্ত পত্রিকা ও দিগন্ত টেলিভিশন প্রতিষ্ঠা করে। এই দুটি সংবাদ মাধ্যমে জামায়াত শিবিরের ছেলেদের ডেকে ডেকে এনে সাংবাদিক নিয়োগ করা হয়। পেশাদার সাংবাদিকরাও অনেকেই রাজাকার মালিকানাধীন মিডিয়ায় হুমড়ি খেয়ে ছুটে চাকরি পেতে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কবিতা, গল্প, উপন্যাস লিখিয়েরাও নয়াদিগন্তে লেখালেখি করতে থাকে।
স্বাধীনতা নিয়ে লিখে স্বাধীনতা পদকও নেবেন আবার স্বাধীনতার দুশমনের পত্রিকায় লিখে অথবা চাকরি করে অার্থিক সুবিধাও নেবেন এটা কি পরস্পরবিরোধী হয়ে গেল না? যদি বলি তা হলো গণমাধ্যমকর্মীর চেতনহীনতা, তা কি ভুল বলা হবে? স্বাধীনতাবিরোধী অর্থনীতিকে মজবুতের ভূমিকায় শুধু নয়াদিগন্ত নয়; আরও অনেকেই হয়ত নেপথ্য হতে কাজ করে যাচ্ছে। গণমাধ্যম কর্মীদের মধ্যে এ ব্যাপারে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন চেতনাবোধের ভীষণ অভাব।
অনেকেই আবার চাকরির প্রয়োজনে চাকরি করছেন মালিক রাজাকার না মুক্তিযোদ্ধা সেটা তাদের বোধে নেই। বলা যায় সেটা একধরনের পেশাগত অসহায়ত্ব। পাকিস্তানপন্থীরা সাংবাদিক ও লেখকদের মত সচেতন নাগরিকদেরও অসহায় করতে পারেন। অচেতন করতে পারেন। এটা কি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় শক্তির ব্যর্থতা আর বিপক্ষীয় শক্তির সফলতা নয়? রাজাকারের পত্রিকায় কেউ যদি না লিখতেন কিংবা চাকরি না করতেন তাহলে কি সেই পত্রিকা প্রতিষ্ঠিত হতে পারতো? সামান্য স্বার্থের বশে একটা অসামান্য অপশক্তিকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা কতটুকু বিবেক সম্মত? এই প্রশ্নটা তাদের বিবেকের কাছেই রইল।
(এ
বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর
সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)