বিচারাধীন বিষয় নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা যাবে না—সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের এমন একটি নির্দেশনা নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে যে উদ্বেগ ও সংশয় তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন সংগঠন এমনকি সবশেষ খোদ আইনমন্ত্রীও তার প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মূল রচয়িতা থমাস জেফারসন বলেছিলেন, তাকে যদি এই বিকল্পটি দেওয়া হয় যে তিনি কি সংবাদপত্রবিহীন সরকার চান নাকি সরকারবিহীন সংবাদপত্র চান? তাহলে তিনি পরেরটা বেছে নেবেন। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, কোনো দেশে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করলে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না। এসব কারণে রাষ্ট্রের প্রধান তিন স্তম্ভ বা খুঁটির (আইন, বিচার ও নির্বাহী) মতোই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় বলে সংবাদমাধ্যমকে এরপরেই বিবেচনা করা হয়।
গণতান্ত্রিক রীতি হলো রাষ্ট্রের এই বিভাগসমূহ প্রত্যেকে যে যার জায়গায় স্বাধীন এবং প্রত্যেকে পরস্পর নির্ভরশীল। সংসদ আইন পাস করে, কিন্তু সেই আইন সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হলে তা বাতিলের ক্ষমতা আছে উচ্চ আাদলতের, অর্থাৎ বিচার বিভাগের। আবার নির্বাহী বিভাগের সর্বোচ্চ ব্যক্তিদেরও সংসদ তথা আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারেন। রাষ্ট্রের এই তিনটি স্তম্ভ তথা পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর নজরদারি তথা ‘ওয়াচডগের’ ভূমিকায় থাকে চতুর্থ সম্ভটি, অর্থাৎ সংবাদমাধ্যম। আবার দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগ যেসব সিদ্ধান্ত ও রায় দেন, তা মানুষ জানতে পারে সংবাদমাধ্যমেই। ফলে গণমাধ্যম বরাবরই আদালতের, তথা বিচার বিভাগের বন্ধু হিসেবে কাজ করেছে এবং এখনও করছে।
বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন গত ৯ এপ্রিল সাংবাদিক নেতাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতকালে বলেছিলেন, ‘আদালতে যা দেখবেন তাই লিখবেন।’ কিন্তু এই ঘটনার এক মাসের মাথায় হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার মো. গোলাম রাব্বানী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিটি মাননীয় প্রধান বিচারপতির ওই বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী বলে মনে করে ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ)। একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দিয়ে এডিটরস গিল্ড, বাংলাদেশের তরফে বলা হয়েছে, বিচারাধীন মামলার প্রতিবেদন প্রকাশের ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্ট যে ভাষায় নির্দেশনা দিয়েছেন, তা অনুসরণ করতে গেলে বিচারাধীন কোনো মামলার কোনো বিষয়েই সংবাদ পরিবেশন করা যাবে না। তাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার দৃষ্টিকোণ থেকে উচ্চ আদালত প্রশাসনের নির্দেশনা স্পষ্ট করা প্রয়োজন।হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার মো. গোলাম রব্বানী স্বাক্ষরিত ওই নির্দেশনায় বলা হয়, ‘ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, কোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়া তাদের চ্যানেলে এবং কোনো কোনো প্রিন্ট মিডিয়া তাদের পত্রিকায় বিচারাধীন মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন/স্ক্রল করছে, যা একেবারেই অনভিপ্রেত। এমতাবস্থায়, বিচারাধীন কোনো বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন/স্ক্রল করা হতে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হল।’ এরপরই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়।
বাস্তবতা হলো, সারা বিশ্বেই আদালত একটি উন্মুক্ত স্থান এবং আদালতকক্ষের ভেতরে সংবাদকর্মীদের প্রবেশাধিকার রয়েছে। তারা মামলার যুক্তিতর্ক শোনেন এবং শুধু আদেশ বা রায়ই নয়, বরং আদালত যেসব পর্যবেক্ষণ দেন, তারও বিস্তারিত তুলে ধরেন। এতদিন সেভাবেই চলে এসেছে। বিভিন্ন আলোচিত মামলার বিচারের অগ্রগতি ও শুনানির সংবাদ সাংবাদিকরা গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ ও প্রচার করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলা, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ও চ্যারিট্যাবল ট্রাস্ট মামলাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানিকালে আদালতকক্ষের কর্মকাণ্ডের খবর গণমাধ্যমে সবিস্তারে এসেছে। ফলে হঠাৎ করে বিচারাধীন বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন ইস্যুতে উচ্চ আদালতের এই নির্দেশনা বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে বলে সাংবাদিকরা মনে করেন। কেননা, এই নির্দেশনা অনুসরণ করতে গেলে কোনো মামলার রায় হওয়ার পরেই কেবল সংবাদ প্রকাশ বা প্রচার করা যাবে—যা আদৌ বাস্তবসম্মত নয়। কারণ, একটি মামলায় চার্জশিট দেয়া থেকে রায় হওয়া পর্যন্ত সবই বিচারাধীন। কিন্তু মানুষ বিচারের প্রতিটি পর্যায়ে কী হচ্ছে, শুনানিতে কী কী যুক্তিতর্ক হলো, আদালত কী বললেন—মানুষ তার সবিস্তারে জানতে চায়। এতদিন এভাবে চলে এলেও তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু হঠাৎ করে কী এমন হলো যে, আদালতের এমন একটি নির্দেশনায় গণমাধ্যমের কাজকে সংকুচিত করে ফেলতে হলো?
গত ১৬ মে যখন উচ্চ আদালত থেকে এই নির্দেশনা আসে, তার আগে একটি ঋণ সংক্রান্ত মামলার রায় অনৈতিকভাবে পাল্টে দেয়া সম্পর্কিত একটি ঘটনা নিয়ে আপিল বিভাগের কিছু কর্মকাণ্ড গণমাধ্যমে আসে। এ বিষয়ে সিনিয়র আইনজীবী হাসান আরিফ সাংবাদিকদের বলেন, তারা সবাই সমস্বরে আপিল বিভাগের কাছে অ্যাটর্নি জেনারেলের আবেদনকে সমর্থন জানিয়েছেন। কারণ অস্বাভাবিক আদেশে আদালতের যে ইমেজ ও মর্যাদা, তা ব্যাহত হয়, ক্ষুণ্ন হয় এবং অবনমিত হয়। সেজন্য তারা আদালতের কাছে আবেদন করেছেন যে বিষয়টি রাষ্ট্রপতির কাছে বা আদালত যেভাবে বিবেচনা করেন, সেভাবে যেন ব্যবস্থা নেয়া হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর পরিবেশনের পরই বিচারাধীন বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন সম্পর্কিত বিধিনিষেধ আসে।
কিন্তু এই ইস্যুতে কিছু প্রশ্নও সামনে এসেছে। যেমন, আদালতের আদেশ বা রায় ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন গণমাধ্যমের জন্য এ ধরনের একটি নির্দেশনা দিতে পারেন কি না? এই আদেশের আইনি ভিত্তি কী? গণমাধ্যম কি এই নির্দেশনা মানতে বাধ্য? যদি না মানে তাহলে আদালত সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারেন? বিচারাধীন বিষয় বলতে আসলে কী বোঝানো হয়েছে?
চার্জশিট হওয়ার পর রায় হওয়া পর্যন্ত সবই বিচারাধীন। তাহলে বিচারাধীন বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করা যাবে না—এই নির্দেশনার অর্থ দাঁড়ায় আদালতের কোনো সংবাদই করা যাবে না। এটা কি আদৌ বাস্তবসম্মত? যদি বিচারাধীন বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করা না যায় তাহলে এসব বিষয়ে মানুষ জানবে কী করে? এ মুহূর্তে যেসব মামলা বিচারাধীন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলাগুলো। এসব মামলার অগ্রগতি জাতি কী করে জানবে যদি সাংবাদিকরা এসব নিয়ে লিখতে নাই পারেন?
অতীত ইতিহাস বলছে, উচ্চ আদালত বরাবরই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে। জনস্বার্থে দায়ের করা বিভিন্ন রিট এবং এসব বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে সংবাদমাধ্যম যে বিরাট ভূমিকা রাখে, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই কেউ দ্বিমত করবেন না। তবে এও ঠিক যে, সংবাদামাধ্যমের এমন কিছু পরিবেশন করা উচিত নয় যা আদালত সম্পর্কে মানুষের মনে অশ্রদ্ধা তৈরি হয়। অর্থাৎ আদালতের অবমাননাকর কিছু প্রকাশ ও প্রচার করা নিশ্চয়ই দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা নয়। রিপোর্টিংয়ে অনেক সময় আদালতের মূল বিষয়বস্তুর বাইরে গিয়ে অনেক কিছু পরিবেশন করা হয়; বিচারপতি ও আইনজীবীদের মধ্যে অনেক কথাবার্তা হয়, অনেক সময় যা হয়তো মূল বিচার্য বিষয়ের সাথে জড়িতও নয়। ফলে এসব বিষয় সংবাদে উঠে এলে তাতে আদালতের গোস্বা করার অবকাশ রয়েছে।
এতদসত্ত্বেও সুপ্রিমকোর্টের এই বিজ্ঞপ্তি নিয়ে সাংবাদিকদের উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলার বিষয়ে রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে কোনো বাধা আছে বলে তিনি মনে করেন না। তবে বিচারাধীন মামলার বিষয়ে ব্যক্তিগত মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি আছে। সাংবাদিকতার পরিভাষায়ও ‘রিপোর্টিং’ ও ‘মতামতের’ সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আদালত যা বলেছেন হুবহু সেটি লেখা আর সেই আদেশ বা রায়কে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করে সেখানে নিজের মতামত দেয়া এক জিনিস নয়। সাংবাদিকতার প্রথম পাঠেই এটি শেখানো হয় যে, রিপোর্টে সাংবাদিক কখনো তার নিজের মতামত দেবেন না। বরং কোনো বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রয়োজন হলে তিনি সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞের বক্তব্য যুক্ত করবেন। আদালতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় কিংবা আদালতের ওপর মানুষের আস্থাকে প্রভাবিত করতে পারে, এমন কিছু যাতে না হয় সেটিই আসলে বলা হয়েছে।
তবে যেহেতু একটি বিজ্ঞপ্তি নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে উদ্বেগ এবং সংশয় তৈরি হয়েছে, তাই এ বিষয়ে আপিল বিভাগ একটি ব্যাখ্যা দিয়ে বিষয়টি পরিস্কার করলে ধোঁয়াশা কেটে যাবে। গণমাধ্যম যে আদালতের প্রতিপক্ষ নয় বরং সহায়ক, তা মাননীয় বিচারপতিরাও জানেন। আবার আদালতের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বা প্রতিপক্ষ বানিয়ে গণমাধ্যমও যে টিকে থাকতে পারবে না, তাও সাংবাদিকদের অজানা নয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সর্বত্র ভারসাম্য বজায় রাখা তথা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আদালত ও গণমাধ্যমের মধ্যে সুসম্পর্কের বিকল্প নেই। সেইসাথে আদালত সম্পর্কিত রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের আরও বেশি সাবধানী হওয়াও প্রয়োজন। অন্যের আগে সংবাদ দেয়ার নামে অসুস্থ প্রতিযোগিতা না করে পুরো বিষয়টি পরিস্কার হওয়ার পরে বুঝেশুনে সংবাদ দিলে বিভ্রান্তি এড়ানো সহজ হয় এবং তাতে ভবিষ্যতে আদালতকেও এরকম বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)