একাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনীতি ঘিরে এখনও শত সহস্র প্রশ্নের উত্তর নেই। আগামী নির্বাচন কীভাবে কী পদ্ধতিতে হবে তা যেনো এখনও অপার রহস্য। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ‘সংবিধানসম্মত’ নির্বাচন হবে, সংবিধানের বাইরে কিছুই হবে না। নির্বাচন কমিশনও সেরকম ইঙ্গিত প্রদান করছে। তবে ১৪ দলীয় জোটের বাইরে বিএনপিসহ নবগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং আরও কিছু রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে। কয়েকদিন আগেও মনে হচ্ছিল হয়তো ক্ষমতাসীন সরকার কারো সাথে কোনো আলোচনা ছাড়াই নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাবে।
কিন্তু আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে সংলাপের আহ্বান রাজনীতিতে নতুন সুবাতাসের সূচনা করেছে। কাল বর্ষীয়ান নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা গণভবনে যাবেন, প্রধানমন্ত্রী সেখানেই কথা বলার জন্য লিখিত আমন্ত্রণ জানান। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সাথে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা নির্বাচন নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করবেন। ১৪ দলের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীসহ মোট ২১ জন নেতা উপস্থিত থাকবেন। সন্দেহ নেই অনেকদিন পর জাতীয় পর্যায়ের প্রায় সব নেতা একত্রিত হবেন। মন খুলে কথা বলবেন। দৃশ্যত এই সংলাপকে সবাই তাই ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
সংবিধান মতে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহেই এই সরকারের মেয়াদ শেষ হয়েছে এবং সেই অনুসারে আগামী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই প্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদের শেষ ২৩তম অধিবেশন শুরু হয় গত ২১ অক্টোবর, শেষ হয় ৩০ অক্টোবর। সংবিধানের ৭২ (১) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতা বলে রাষ্ট্রপতি এই সরকারের শেষ মেয়াদের সংসদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ৩০ অক্টোবরের পর থেকে শুরু হয়েছে একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় গণনা। স্বভাবতই আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচনের দিকে এখন সবারই চোখ নিবদ্ধ। যদিও বিভিন্ন প্রেক্ষিত ও বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও আগামী নির্বাচন কেমন হবে তা গভীরভাবে অনুধাবনের চেষ্টা করছেন। সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন হবে কিনা, সবাই ভোট দিতে পারবেন কিনা-এ প্রশ্নগুলোও এখন সামনে চলে এসেছে। তবে জনমনে যে আশা উঁকি দিচ্ছে সেটা হলো-সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। যে নির্বাচন ভবিষ্যত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখবে। এই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রীর ‘সংলাপ’ আহ্বান রাজনীতিতে অবশ্যই একখণ্ড শান্তির পরশ। নির্বাচন নিয়ে সাধারণ জনগণের মাঝে নানান ধরনের কৌতুহল বিরাজমান। ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বাধীন জোট ছাড়া আর সব রাজনৈতিক দলই এখন পর্যন্ত জোর দাবি তুলছে নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। অতিসম্প্রতি বিএনপি এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে জোট গড়ে উঠেছে তারাও সে দাবি জোরেশোরে তুলছে। বিভিন্ন ইসলামী দলগুলোও একই দাবিতে সোচ্চার। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের মিত্ররা বরাবরই এই দাবি নাকচ করছে। বিশেষ করে পদত্যাগের প্রশ্নে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারের পদত্যাগের কোনো সুযোগ নেই। সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন অন্তবর্তীকালীন সময়ে সরকারের মন্ত্রীসভার কলেবর কেবল ছোট হয়ে আসতে পারে।
আমাদের নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার এবং তাদের মিত্রদের অংশগ্রহণে দশম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে এখনও প্রশ্ন রয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ নয়-এই যুক্তি তুলে ধরে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর বৃহৎ অংশ ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছিল। শুধু বিএনপি এবং তাদের মিত্রই নয়, বাম ঘরানার সিপিবি, বাসদসহ বেশিরভাগ দলগুলোও দলীয় সরকারের অধীনে ৫ জানুয়ারির কথিত জাতীয় নির্বাচন বর্জন করেছিল। এই নির্বাচন ঘিরে মারাত্মক সহিংস অবস্থা তৈরি হয়েছিল। নির্বাচন বর্জনকারীদের ডাকা অবরোধ আর ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা পোক্ত করার জটিল আবর্ত তৈরি হওয়ায় দেশের সম্পদ যেমন নষ্ট হয়েছিল তেমনি অজস্র সাধারণ মানুষের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছিল। সে দায় থেকে মুক্তি হতে পারেনি বিএনপি। নির্বাচন বর্জন করে তারা যে সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছিল সে কথাও এ দেশের মানুষ কোনোদিন ভুলে যাবে না। বিশেষ করে আগুনে পুড়িয়ে সাধারণ মানুষকে হত্যার দায় এখনও বিএনপি ও জামায়াত শিবিরকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ না থাকায় নির্বাচনে উৎসবের বদলে ছিল উৎকণ্ঠা, সংশয়, নিপীড়ন-নির্যাতন। রাজনীতির এখন যে সংকট তা মূলত তৈরি হয় ৫ জানুয়ারির কথিত নির্বাচন ঘিরে। এর আগে ৯০ এর গণ অভূত্থানের পর প্রতিটি নির্বাচনই হয়ে আসছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। কিন্তু ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ৩০ জুন ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। ঐদিন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। এরপর পরই বিভিন্ন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে এবং দলীয় সরকারের অধীনে কেউ অংশ নেবে না বলে ঘোষণা দেয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৪ জন সংসদ বিনা ভোটে নির্বাচিত হন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং তাদের মিত্র জাসদ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিসহ মাত্র ১৭ টি রাজনৈতিক দল দশম নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
এদিকে গত বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ কর্তৃক সাবেক সচিব কে এম নুরুল হুদা প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। বাকি সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, বেগম কবিতা খানম ও শাহাদত হোসেন চৌধুরী। সবারই মনে থাকার কথা গত বছরের জুলাই থেকে ইসি আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপ শুরু করে। প্রথমে সুশীল সমাজ এবং এরপর গণমাধ্যম কর্মী ও প্রধান প্রধান মিডিয়ার সম্পাদকদের সাথে সংলাপ করে। আগস্টে শুরু হয় নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রথম সংলাপ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার একে একে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, এলডিপিসহ চল্লিশটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সাথে আনুষ্ঠানিক সংলাপ করে। সংলাপে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলো আগামী নির্বাচন নিয়ে তাদের ভাবনা, পর্যবেক্ষণ এবং প্রস্তাবনা দেয়। ৪০টি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে মোট ৫৩১টি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ‘একাদশ নির্বাচন’ কেমন হবে ? এটি এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। বলা যায়, করো কাছেই এর সঠিক উত্তর নেই। তবে সব দলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক এটি সবারই প্রত্যাশা। উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোও এটি চায়। সন্দেহ নেই সেই প্রত্যাশাকে অনেক বেশি বাড়িয়ে তুলেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংলাপের উষ্ণ আমন্ত্রণ। অনেক সন্দেহের পরেও কাল রাতে গণভবন যে নতুনভাবে আলোকিত হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সত্যি কী পক্ষ-বিপক্ষের এত নেতা এর আগে কখনই গণভবনে একত্রিত হয়েছে বলে মনে পড়ে না। সে ক্ষেত্রে এটিও হবে এক ব্যতিক্রম চিত্র।
কয়েকদিন ধরে রাজনীতির ময়দানে চলছিল নানা জল্পনা-কল্পনা। তবে যে জল্পনা-কল্পনা অার উত্তাপ-উৎকণ্ঠা চলছিল সেখানে কিছুটা হলেও সংলাপের ডাকে স্বস্তি তৈরি হয়েছে। সামনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্যে দু’পক্ষের একসাথে বসা সত্যিই নতুন এক মেরুকরণ। এটি সত্য যে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্যে পক্ষ আর বিপক্ষের শক্তির সমঝোতার দিকে অগ্রসর হওয়ার বিকল্প নেই। কাল গণভবন থেকেই শুরু হোক রাজনৈতিক সমঝোতা ও শান্তির পথচলা। সংলাপ যেন শুধু অ্যাপায়ন আর খানাপিনার বিষয় না হয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)