ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে অল্প কিছুদিন আগেই জনগণকে জিম্মি করে ধর্মঘট ডেকে গাড়িভাড়া বাড়িয়ে নিলেন পরিবহন মালিকেরা। তাদের ইচ্ছানুযায়ীই ভাড়া নির্ধারণ হলেও অভিযোগ রয়েছে তারাই আবার বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন যাত্রীদের থেকে। অন্যদিকে সিটিং বা গেট লক সার্ভিস বন্ধের ঘোষণা দিয়ে সেটিও তাঁরা মানছেন না। বাসে উঠলেই পুরো পথের ভাড়া নিয়ে নেয়া হচ্ছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বাস ভাড়া বাড়ানোর পর থেকেই গনপরিবহনে শুরু হয়েছে নতুন আরেক নৈরাজ্য। শিক্ষার্থীরা গণপরিবহনে এমন নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামল, যদিও সেটি হাফ ভাড়ার দাবিতে। হাফ ভাড়ার ইস্যুটি পুরোনো হলেও এবার সেটি আরও গুরুতর হতে বাধ্য। কারণ, নতুন নির্ধারিত ভাড়ায় সাধারণ যাত্রীদেরই নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে, বাড়তি ভাড়া তো আছেই, সেটি শিক্ষার্থীদের জন্য কত বড় বোঝা হতে পারে একটু ভেবে দেখুন।
অতীত ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, দীর্ঘ ৫২ বছরেও শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার দাবি আদায় হয়নি। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার বৈষম্যের পটভূমিতে ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এক ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং অচিরেই এ আন্দোলন গণআন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। ১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের মেনন ও মতিয়া গ্রুপ রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলে। এ দুই সংগঠন ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে এবং আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে নিম্নোক্ত ১১-দফা দাবি ঘোষণা করে। এই বহুল আলোচিত ১৯৬৯ সালের সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার অন্যতম ছিল বাস-ট্রেন-লঞ্চে শিক্ষার্থীদের ‘হাফ ভাড়া’ নেয়ার দাবিটি।
“ট্রেনে, স্টিমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের ‘আইডেন্টিটি কার্ড’ দেখাইয়া শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ‘কন্সেসনে’ টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে।” ১৯৬৯ সালের সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১টি দফার মধ্যে ১ নং দফার “ঢ” অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ্য ছিলো বাস-লঞ্চ-ট্রেনে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া নেয়ার দাবিটি। মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো শিক্ষার্থীদের সেই দাবি বাস্তবে রূপ নেয়নি। সম্প্রতি ব্যাপকহারে গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির পর দাবিটি আবারো সামনে এসেছে।
২০১৫ সালের অক্টোবরে বিআরটিসির কার্যালয়ে বাস ডিপো ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে এক বৈঠকে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘আমি এই মুহূর্ত থেকে নির্দেশ দিচ্ছি, রাজধানীতে চলাচলরত বিআরটিসির পাশাপাশি অন্যান্য পরিবহনেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নেবে। আর না নিলে দায়ী পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
প্রায় তিন বছর পর ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের সড়ক আন্দোলনে তোলপাড় হলো গোটা দেশ। সে আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির একটি ছিল, ঢাকাসহ সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সে সময়ই মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী একটি খসড়া ট্রাফিক আইন অনুমোদন করলেও সেখানে হাফ ভাড়ার বিষয়টি ছিল না।
মোদ্দাকথা হলো, বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকেই হাফ ভাড়ার প্রচলন ছিলো। এমনকি তখন বাস মালিকরা শিক্ষার্থীদের থেকে হাফ ভাড়া নিতে পরিবহন শ্রমিকদের বলে দিত। এর জন্য অনেকাংশেই তাদের আইডি কার্ডও দেখা হতো না। পাশাপাশি বিশ্বের অনেক দেশেই সরকারি ও বেসরকারি গণপরিবহনগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। বাংলাদেশেও তাই এমন কোনো অবস্থা তৈরি করা উচিত নয়, যাতে শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবহনখাতে ব্যয় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
তাই অতিদ্রুত সরকার থেকে পদক্ষেপ নিয়ে বাস মালিকদের সঙ্গে বসে ছুটির দিন ব্যাতিত শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য একটা প্রজ্ঞাপন দিয়ে আইন করলে বিষয়টি মিমাংসীত হতে পারে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক সিট রেখে হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করা উচিত। যাতে বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া সুবিধা নয় বরং বন্ধ হোক পরিবহনখাতের লাগামহীন নৈরাজ্য।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)