পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক নীতির বিরুদ্ধেই জেগেছিল গোটা বাঙালী জাতি। আর এ জাতির পক্ষে দাঁড়িয়েছিল বিশ্ববিবেক। অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় এসেছিল খন্দকার মুশতাক আহমদ। এরপর জিয়া এরশাদ। জিয়া গণতন্ত্র কে জায়েয করার জন্য হ্যাঁ না ভোট দিয়েছিল। কিন্তু পরিণাম কী হল।গণতন্ত্র ও তিনি কেউই সুরক্ষিত হলোনা। এরপর ক্ষমতায় এলো হোসেইন মুহম্মদ এরশাদ। শুরু হলো সর্বদলীয় গণতন্ত্রের লড়াই। এ লড়াইয়ে জীবন দিতে হলো অনেককে। অতঃপর এরশাদের পতন হল।ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো এরশাদ জমানায় গণতন্ত্রের লড়াইয়ে থাকা বিএনপি।১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী বিএনপি সকল দলকে বাদ দিয়ে দিলো একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন একদলীয় নির্বাচন।একসময় যে গণতন্ত্রের জন্য রাজপথে লড়াই করলো সেই তারাই ক্ষমতার জন্য ভুলে গেল গণতান্ত্রিক নৈতিকতা।তখন এ নির্বাচনের সমালোচনায় মুখর ছিল আওয়ামী লীগ।বিএনপির আমলে ভোট কারচুপি ও জালভোটের অগণতান্ত্রিক রীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল তারা। তারা সোচ্চার ছিল তৎকালীন সরকারের অনুগত নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে।কিন্তু বর্তমানে কী ভূমিকায় তারা?
বিরোধী থাকলে একরকম আর সরকারে গেলে কেন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে দলগুলো?নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে যেনতেন ভাবে জিতে আসাটাকেই এখন মূল কাজ ভাবা হচ্ছে।ক্ষমতার কাছে জিম্মি হয়ে যায় সব।ক্ষমতায় থাকা বিএনপির হ্যাঁ না ভোটকেও মানুষকে মেনে নিতে হয়েছিল।১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারীর নির্বাচনের ফলাফল পিছু হটলো আন্দোলনের চাপে।২০০৬ সালেও রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ইয়াজ উদ্দীন ও নির্বাচন কমিশনার এম,এ আজিজকে দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেছিল বিএনপি।কিন্তু সে চেষ্টা সফল হতে পারলোনা।চলে এলো ওয়ান ইলেভেন।২০০৮ সালে নির্বাচন হলো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ন গণতান্ত্রিক নৈতিকতায়।২০১৪ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে।লাগাতার অবরোধ ডাকলো দলটি।চললো জ্বালাও পোড়াও ও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ।কিন্তু বিএনপির নির্বাচন বর্জনকে উপেক্ষা করেই আওয়ামী লীগ ১৪ দলকে নিয়ে নির্বাচন দিয়ে দিল।বিএনপি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী আওয়ামী লীগের বর্জনের মধ্য দিয়ে যে নির্বাচন দিয়েছিল তা কিন্তু টিকাতে পারলোনা। কিন্তু আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের বিএনপির বর্জনকে উপেক্ষা করেই নির্বাচনকে টিকিয়ে নিলো। তারা নির্বাচনকালীন সরকারও গঠন করলো।আর সে সরকারকেও টিকালো ও সে সরকারের দেয়া নির্বাচনকেও টিকালো। আবার এই আওয়ামী লীগই বিএনপির ১ দ্লীয় নির্বাচনের বিরোধিতা করে গণতান্ত্রিক নৈতিকতার কথা বলেছিলো।
আসলে গণতান্ত্রিক নৈতিকতার কথা সকলে বিরোধী দলে থাকলেই বলে। ক্ষমতার গন্ধ পেলে সে গন্ধকে নাক ছাড়া করতে সকলে তা ভুলে যায়। বিরোধী দলে থাকার সময় গণতান্ত্রিক নৈতিকতার জন্য জান দিয়ে দেয় আর ক্ষমতায় গিয়ে জান নিয়ে নিতেও দ্বিধান্বিত হয়না। গণতান্ত্রিক নৈতিকতা যেন কেবলই বিরোধী দলের আরাধ্য। হঠাৎ ধনী যেমন তার গরিবকালকে ভুলে যায় রাজনৈতিক দলগুলোও তাই। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে ভুলে যাবে গণতান্ত্রিক নৈতিকতা। করবে নানা অনৈতিক ফন্দিফিকির। চালাবে বিরোধী পক্ষের উপর দমনপীড়ন। তাদের সভা সমাবেশ এমন কি নির্বাচনী প্রচার প্রচারণাতেও বাধা প্রদান করা হবে। তাদেরকে পোস্টারিং পর্যন্ত করতেও দেবেনা। যারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য একসময় জান কোরবান করতে প্রস্তুত ছিল। তারাও যখন দেখে নির্বাচনে হেরে যাচ্ছে তখন গণতন্ত্রের রীতিনীতিকে কবর দিতে দ্বিধা করবেনা। এমনটাই যেন রীতি হয়ে গেল। ক্ষমতা পেয়ে গেলে আসলে আর কেউ তা ছাড়তে চায়না। আর এর মূলে ক্ষমতার প্রতি লোভ,মোহ, লিপ্সা, ভয় প্রভৃতি কাজ করে।
ক্ষমতায় এসে পরিবার,স্বজন,বন্ধু ও নিজ পক্ষীয় দলীয় নেতাকর্মীসহ জড়িয়ে যায় অনেক কিছুর সাথে।ক্ষমতার অপব্যবহার,টেন্ডারবাজী,উন্নয়ন বরাদ্দ লুন্টন প্রভৃতি। ক্ষমতার গদি উল্টে গেলে সমূহ বিপদে পড়ার ভয়। সুযোগ সুবিধা ও সামাজিক কর্তৃত্ব হারানোর ভয়। তাই কেউ রিস্ক নিতে রাজী নয়। প্রয়োজনে গণতান্ত্রিক নৈতিকতাকে কবর দিয়ে হলেও তাই ক্ষমতায় থাকা চাই। ক্ষমতায় এসে নেমে যায় তাই প্রতিপক্ষ দমনে।কিন্তু কেউ ভাবেনা তারাও একদিন ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে পারে।তারা যেমন আরেকজনের উপর দমন পীড়ন চালাচ্ছে ঠিক তেমনই তাদের উপরও একদিন আর কেউ চালাতে পারে।ক্ষমতা কোন ব্যক্তির কোন দলের চিরস্থায়ী হওয়ার নজীর পৃথিবীর কোথাও নেই।কিন্তু এই কথাটা সময়ে কেউ ভাবেনা। ১৯৮২ সাল হতে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত জাতীয় পার্টি তা ভাবেনি।১৯৯৬ সালে ও ২০০৬ সালে বিএনপি ভাবেনি।কোথায় গেল জাতীয় পার্টি ও বিএনপির এত পরাক্রম?একসময়ের মহাশক্তিধর এরশাদ আমৃত্যু কারাগার আতঙ্কে ছিলেন।
বিএনপি শাসনামলে প্রবল ক্ষমতাধর ছিলেন তারেক রহমান,হারিছ চৌধুরী ও লুৎফুজ্জামান বাবর। কিন্তু আজ তারা কোথায়?কেউ বিদেশে ফেরারি,কেউ নিখোঁজ আর কেউ কারাগারে অসুস্থ হয়ে ক্ষমতাচ্যুত মানবেতর জীবন পাড় করে চলেছে। ক্ষমতায় থাকার সময় কি তারা কেউ এমন পরিণতির কথা ভেবেছে? মোটেও ভাবেনি। আসলে সময়ে কেউ ভাবেনা।ভাবে সময় হারিয়ে যখন আর পিছু হটার কিংবা শুধরাবার কোন সুযোগ থাকেনা। সবাই যদি গণতান্ত্রিক নৈতিকতা মেনে চলতো ও ক্ষমতার অপব্যবহার না করতো তাহলে আর কাউকেই এমন বিড়ম্বিত পরিণতিতে পড়তে হতোনা।দেশ,জনগণ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে গণতন্ত্রের দোহাই দেয়া সকল রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক নৈতিকতা মেনে চলার জন্য একটি সমন্বিত সামষ্ঠিক জবাবদিহিতা থাকা উচিত নয় কি?
মানবাধিকার রক্ষায় মানবাধিকার কমিশন রয়েছে।নারী নির্যাতনের ইস্যুতে নারী সংগঠন রয়েছে।দুর্নীতি ইস্যুতে দুর্নীতি দমন কমিশন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি রয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য সকল গণতান্ত্রিক দলগুলোর সমন্বয়ে কিছুই নেই। সেটা হতে পারে গণতন্ত্র কমিশন কিংবা গণতন্ত্র রক্ষা কমিটি।গণতন্ত্রের কথা বলা সকল রাজনৈতিক দল এর অন্তর্ভূক্ত হবে।তারা গণতন্ত্র ইস্যুতে নিয়মিত বৈঠক,সভা সেমিনার করবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতন্ত্রের নৈতিকতায় রাখায় ভূমিকা রাখবে।এমন একটি প্রক্রিয়া কি চালু করা যায়না?সম্প্রতি একজন সাংসদের সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে গেল।তার কর্মকান্ডে দেশে বিদেশে দল,সরকার ও জাতীয় সংসদের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হলো।সরকার দলীয় দ্বন্দ্বে প্রাণ হারালো একজন সাংবাদিক। সরকার দলীয় নেতা সমালোচনা করলো নির্বাচনের। এসব কি গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত নয়?গণতান্ত্রিক নৈতিকতাকে ফিরিয়ে আনা কি আজকের সময়ের দাবী নয় কি?সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোকো সেই নৈতিকতায় বহাল রাখতে তাই চাই সর্বদলীয় গণতন্ত্র কমিশন। নীতি নির্ধারকরা বিষয়টা একটু ভেবে দেখবে কি?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)