চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

গণতান্ত্রিক দলে মার্শাল ল রীতির অনুপ্রবেশ

বাংলাদেশে সামরিক শাসকরা অগণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতা দখল করে গণতান্ত্রিক (!) দল গঠন করেছে। জিয়া ও এরশাদ তাদের অন্যতম। ক্ষমতার প্রভাব দিয়ে বিভিন্ন নেতা কর্মীকে তাদের দলে ভেড়াতেও সক্ষম হয়েছেন তারা। দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলায় জাগ দল (পরবর্তিতে বিএনপি) ও জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থান সৃষ্টি হয়েছিল।

ক্ষমতার স্বাদ, দাপট ও অর্থনৈতিক মজবুত অবস্থান সৃষ্টির পথে হাঁটা মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠছে। আদর্শিক সত্তা, দলনিষ্ঠা, দলীয় গঠনতন্ত্র মান্যতা প্রভৃতির মারাত্মক অনুপস্থিতি বিদ্যমান চারদিকে। একই নেতা সব ক্ষমতাসীন দল করেছে এরকম নজির ভুড়ি ভুড়ি। সামরিক শাসকরা ক্ষমতার প্রভাবে অনেক বাঘা বাঘা নেতাকে তাদের দলে ভিড়িয়েছে।

জিয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়েও রাজাকারদের মন্ত্রিসভায় জায়গা দিয়েছেন। জিয়া ক্ষমতাচ্যুত হলে অনেক বিএনপি নেতা জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছে। এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জিয়া পত্নী খালেদা ক্ষমতায় এলে অনেক জাতীয় পার্টি নেতা ফের বিএনপিতে চলে গেছে। আদর্শিক সত্তার কোন অস্তিত্ব নেই বলে এই আসা যাওয়ায় তাদের মধ্যে কোন মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বও নেই।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ সিঁড়িতে পড়ে রইল আর কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতা ও বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর খুনীর মন্ত্রিসভায় চলে গেল। বঙ্গবন্ধুর খুনীর মন্ত্রিসভার সদস্যরা আবার বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকারেও এসে গেল। ওয়ান ইলেভেনে মাইনাস টু ফর্মুলায় শেখ হাসিনাকে মাইনাস করতেও অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকে তৎপর হতে দেখা গেছে। আবার শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে তারা ভোল পাল্টে জয় হাসিনা বলা শুরু করে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা কর্মীরা অতিমাত্রায় ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও সুবিধা কেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। দেশে রাজাকার, আলবদর তথা মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই চলছে আবার রাজাকারের সন্তানরা অনেক জায়গায় লড়াইকারী সংগঠনে নেতা হয়ে বসে আছে। দলগুলো আর দলীয় গঠনতন্ত্র ও আদর্শিক চেতনা অনুযায়ী চলছে না।

নেতা নির্বাচনে নেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, চলছে মার্শাল ল রীতি। তৃণমূল কাউন্সিলর হয়ে নেতা নির্বাচনে কোন ভূমিকাই রাখতে পারছে না। তাদের মত প্রকাশের এতটুকুও সুযোগ নেই দলের ভিতর। দল, দলীয় কাউন্সিল ও সম্মেলনে চলছে অগণতান্ত্রিক মার্শাল ল রীতি। সংসদ সদস্যরা বাসায় বসে তার পছন্দ মত লোকদের দিয়ে কমিটি গঠন করে দিচ্ছে।

আমাদের রাজনীতির চরম ব্যর্থতা হচ্ছে দল সংসদ সদস্যদের চালাতে পারছেনা। সংসদ সদস্যরা দলকে চালাচ্ছে। প্রশাসনে ও দলে অনেক ক্ষেত্রেই দলীয় নেতাদের চেয়ে সংসদ সদস্যদের এপিএস’র প্রভাব বেশী। প্রশাসন দলীয় নেতাদের কথা শুনে না শুনে সংসদ সদস্যের এপিএসের কথা। অনেক জায়গায় এমপিদের সাথে বনিবনা না থাকায় অনেক আওয়ামী লীগ নেতা বিরোধী দলের মতো ক্ষমতাহীন হয়ে যাচ্ছে। তাদের কথাতো প্রশাসন শুনেই না উল্টো নানাভাবে হয়রানির স্বীকার হয়ে পরবর্তিতে সাংসদের অনুগত হতে বাধ্য হয় তারা।

পৌর মেয়র, ইউপি চেয়ারম্যানের প্রার্থীতা মনোনয়ন, দলীয় সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হওয়া, ন্যায্য নাগরিক অধিকার যেমন চাকরিজীবীদের সুবিধাজনক স্থানে বদলি, চাকরিতে নিয়োগ ও পদায়ন প্রভৃতিতেও সংসদ সদস্যদের আশির্বাদ পুষ্ট হওয়া বাধ্যতামূলক। সাংসদ বেজার থাকলে কিছুই হয়না। সাংসদের সবকিছু দেখভাল করে তার এপিএস। দলীয় নেতাদের এপিএস’র মাধ্যমে সাংসদের কাছে যেতে হয়।

বিএনপি জামাত জোট সরকারের আমলে যারা নির্যাতিত হয়েছে, রাজপথে লড়াই সংগ্রাম করে চারদলীয় সরকারের পতন ত্বরান্বিত করে ১৪ দলীয় জোটকে ক্ষমতায় এনেছে। অনেক জায়গায় এমপি বশীভূত না থাকায় তারা নেতৃত্ব হতে ছিটকে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ অনেক ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে না। ১৪ দলীয় জোট ও যুব সংগ্রাম পরিষদের রূপরেখাও মান্য করছে না কেউ। অনেক ক্ষেত্রেই এই গণতান্ত্রিক দলটি পরিচালিত হচ্ছে অগণতান্ত্রিক মার্শাল ল পদ্ধতিতে।

বিলোপবাদ বলে একটি কথা চালু আছে। যার বৈশিষ্ট্যটা এমন নিজ দলীয় পরিচিতি ও অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে বিলোপবাদীরা অন্য রাজনৈতিক দলে মিশে যায়। দলের দুর্দিন ও দুঃসময়ে বিলোপবাদীদের আসল চেহারা ফুটে ওঠে। বিএনপি-জামায়াত হতে দেশব্যাপী যেভাবে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নেতৃত্বে আসছে তা কি বিলোপবাদী আতঙ্কের ভয়াবহতা নয়?

দলটি গণতান্তিক ও গঠনতান্ত্রিক রীতিতে শাসিত হলে এমনটি হতো না। নেতৃত্ব নির্বাচনে সাংসদদের অগণতান্ত্রিক মার্শাল ল রীতি দল, ১৪ দল তথা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় রাজনীতির জন্য আগামী দিনে খারাপ সংবাদই নিয়ে আসবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)