বাঙালির ইতিহাসে একটি কালো দিন ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই, সোমবার। দেশের গণতন্ত্রে কালিমা লেপনের দিন। ওই সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় ফখরুদ্দিন আহমদের ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ নামের এক অপশক্তি। অবরুদ্ধ গণতন্ত্রের সেই সময়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তাকে থামাতে গ্রেফতার কৌশল নিলেন ওয়ান-ইলেভেনে চেপে বসা তত্বাবধায়ক নামের স্বৈরশাসকের দল।
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই মিথ্যা মামলায় অযৌক্তিকভাবে তৎকালীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যেকোনো সময় গ্রেফতার হতে পারেন- এ রকম একটি আশঙ্কা দেশবাসী আগে থেকেই করেছিল।
অবশেষে আশঙ্কাটি সত্যে পরিণত হলো। ওই দিন ভোর ৬টায় শ্রাবণের প্রবল বর্ষণের মধ্যে সুধাসদনে প্রবেশ করে যৌথবাহিনী। সকাল ৭টা ৩২ মিনিটে যৌথবাহিনীর সদস্যরা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে সুধাসদন থেকে। সুধাসদনের চতুর্দিক বিভিন্ন বাহিনীর দুই সহস্রাধিক সদস্য ঘিরে রাখে। বঙ্গবন্ধুকন্যা এর মধ্যে ফজরের নামাজ আদায় করেন। সাদা শাড়ি পরিহিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা যৌথবাহিনীর কাছে জানতে চান, কেন তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। দেশে কি সামরিক শাসন জারি হয়েছে। তেমন কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা। বরং যুদ্ধাংদেহী মনোভাবে সাজসাজ রব তুলে শেখ হাসিনাকে নিয়ে গাড়ির বহর হাজির হয় ঢাকার সিএমএম আদালতে।
তৎকালীন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোসাম্মৎ কামরুন্নাহার প্রচলিত নিয়মের তোয়াক্কা না করে আদালত বসার ঘণ্টা দুয়েক বাকি থাকতেই সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী জামিন নামঞ্জুর করে সংসদ ভবনের সাব-জেলে প্রেরণ করে দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার মতো একজন মর্যাদাসম্পন্ন জাতীয় নেতৃত্বকে গ্রেফতার থেকে জেলহাজতে প্রেরণ করা পর্যন্ত পুরো ঘটনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যৌথবাহিনী কোনো সংযমের পরিচয় দেয়নি। সিএমএম কোর্টে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে আইনি ভাষায় ৩৬ মিনিট বক্তব্য রাখেন। গ্রেফতারের পূর্ব-মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে উপরের চিঠি লিখে যান। দেশ ও জাতির সংকট মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুকন্যার ওই চিঠিটি গণতন্ত্রকামী মানুষের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করে। উজ্জীবিত হয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
চিঠিতে লেখা ছিলো :
‘‘প্রিয় দেশবাসী!
আমার সালাম নিবেন। আমাকে সরকার গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায় জানি না। আমি আপনাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যেই সারাজীবন সংগ্রাম করেছি। জীবনে কোন অন্যায় করিনি। তারপরও মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।
উপরে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ও আপনারা দেশবাসী আপনাদের ওপর আমার ভরসা। আমার প্রিয় দেশবাসী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের কাছে আবেদন কখনও মনোবল হারাবেন না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন। যে যেভাবে আছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। মাথা নত করবেন না। সত্যের জয় হবেই।
আমি আছি আপনাদের সাথে, আমৃত্যু থাকব। আমার ভাগ্যে যাহাই ঘটুক না কেন আপনারা বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান। জয় জনগণের হবেই। জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়বই। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবোই।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু
শেখ হাসিনা
১৬.০৭.২০০৭’’
সমসাময়িককালের রাজনৈতিক ইতিহাসে শেখ হাসিনার চিঠিটি একটি অমূল্য দলিল। চিঠিতে শেখ হাসিনা দেশবাসীর প্রতি তার আস্থার কথা যেমন ব্যক্ত করেছেন। তেমনি গণতন্ত্রের দুঃসময়ে নেতাকর্মীদের করণীয় কী তাও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।
২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর সমর্থনে ক্ষমতায় আসে ড: ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তাদের নানা কর্মকাণ্ড – বিশেষ করে রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এপ্রিল মাস থেকেই জননেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করে আসছিল। ১২ ফেব্রুয়ারি শপথ নেয়ার পর থেকে ফখরুদ্দীনের সরকারের প্রায় প্রতিটি কর্মকাণ্ডকেই সমর্থন দেন শেখ হাসিনা। কিন্তু এক মাসের মাথায় আওয়ামী লীগের ওপর আঘাত হানে ফখরুদ্দীন সরকার।
দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে আওয়ামী লীগের প্রথম সারির প্রভাবশালী নেতাদের গ্রেফতার শুরু করে। এরপরও সরকারের প্রতি মনোভাব পরিবর্তন করেননি জননেত্রী। প্রকৃতপক্ষে জননেত্রী শেখ হাসিনার মূল লক্ষ্য ছিল নির্বাচন। আর এ জন্যই তিনি বিভিন্নভাবে সমর্থন দিয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের খোশমেজাজে রাখতে চাইছিলেন। কিন্তু সরকারের চিন্তা-ভাবনা ছিল এর বিপরীত। ওরা চাইছিল যে-কোনভাবে তাদের শাসন দীর্ঘায়িত করতে।
সরকার ভাবলো, শেখ হাসিনা বিদেশে থাকা অবস্থায় খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে সহজভাবে মাইনাস-টু ফর্মুলা কার্যকর করা যায়। ব্যক্তিগত সফরে জননেত্রী দেশ ছাড়ার পর পর সরকারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার প্রস্তাব করা হয়। শুরুতে গ্রেফতার হওয়া জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমানকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার আবদার করেন। সরকার সাড়া না দিলে তারেককে রেখেই বিদেশে যেতে রাজি হন খালেদা জিয়া। আর খালেদা জিয়াকে বিদেশে প্রেরণের ব্যাপারে সরকারের তৎপরতা দেখে যুক্তরাষ্ট্রে সফররত শেখ হাসিনা বুঝে যান এর মধ্যে কু-মতলব রয়েছে।
দূরদর্শী নেত্রীর বুঝতে বাকি রইল না খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে ক্ষমতাসীনরা সহজভাবে মাইনাস-টু কার্যকরের পরিকল্পনা সুসম্পন্ন করতে চায়। ওই বছরের ২৮ মার্চ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ‘খালেদা জিয়া বিদেশে যেতে রাজি। দেশে ফিরতে চান শেখ হাসিনা।’
বঙ্গবন্ধুকন্যার দেশে ফেরার খবরে উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ সরকার হাসিনাবিরোধী অভিযানে নামে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৩টি চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করা হয়। মামলার খবরে ক্ষুব্দ শেখ হাসিনা যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফেরার ঘোষণা দেন। ১১ এপ্রিল হত্যা মামলার চার্জশিট দেয়া হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এরপরও তিনি দেশে ফেরার ব্যাপারে অনড় থাকলে ১৮ এপ্রিল ২০০৭ সরকার শেখ হাসিনাকে দেশের জন্য ‘বিপজ্জনক ব্যক্তি’ আখ্যায়িত করে দেশে ফেরার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
৭ মে জরুরি অবস্থা এবং সরকারের কঠোর প্রতিরোধের মুখে দেশে ফিরলে লাখ লাখ মানুষ মুজিবকন্যাকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানায়। এটা এক অভূতপূর্ব ঘটনা। সেনাসমর্থিত সরকারের তোপের মুখে জীবনবাজি রেখে লাখো মানুষ বিমানবন্দর থেকে হেসে গেয়ে মিছিল সহকারে নেত্রীকে প্রথমে বঙ্গবন্ধু ভবনে ও পরে সুধা সদনে পৌঁছে দেয়। হাসিনা দেশে ফিরে এলে স্বাগত জানান খালেদা জিয়া। এভাবে বীরের বেশে বিভিন্ন মামলার আসামি শেখ হাসিনা ঘরে ফেরায় অপমানিত সরকারের টেনশন বেড়ে যায়।
অবশেষে কোন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই ১৬ জুলাই সোমবার ভোররাতে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দেশের সর্ববৃহৎ দল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়। চরম উত্তেজনা, বাকবিতণ্ডা ও নেতাকর্মীদের অবিরাম জয় বাংলা স্লোগানসহ প্রচণ্ড হৈ চৈ-এর মধ্যে খুবই দ্রুততার সঙ্গে শেরে বাংলানগরে একটি উপ-কারাগারে ঐদিন সকালেই নেত্রীকে নিয়ে যায়।
১৩ জুন জনৈক আজম জে. চৌধুরীর গুলশান থানায় দায়ের করা একটি চাঁদাবাজির মামলার আসামি দেখিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই দিন সোমবার ভোরের অন্ধকার তখনো কাটেনি। ৫টা বাজতে ১৫ মিনিট বাকি। একের পর এক গাড়ি আসছে শাঁ শাঁ করে। নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য দ্রুত সুধা সদনে ঢুকে পড়েন। তারা বাড়ির নিরাপত্তা রক্ষীদের জানিয়ে দেন তাদের আগমনের উদ্দেশ্য। নেত্রী তখন ফজরের নামাজ আদায় করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
তিনি তাদেরকে নিচে অপেক্ষা করতে বলেন। এরই মধ্যে টেলিফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ভবনে নিয়োজিত নিরাপত্তা কর্মী এবং স্টাফদের নিচতলার একটি কক্ষে জমায়েত করা হয়। জব্দ করা হয় তাদের প্রত্যেকের মোবাইল সেট। নামাজ শেষ করে পুত্র জয়, কন্যা পুতুল, আইনজীবীসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে শেখ হাসিনা তখন মোবাইল ফোনে কথা বলেন।
ডেইলি স্টার (১৭.৭.০৭) এর তথ্য অনুযায়ী তার নিষেধ সত্ত্বেও যৌথ বাহিনীর কয়েকজন সদস্য উপরে উঠলে তিনি প্রথমে কিছুটা উত্তেজিত হন। কিছুক্ষণ পরেই শেখ হাসিনা তাদেরকে চা-বিস্কুট খেতে দেন। মোবাইলে শেখ হাসিনা সর্বশেষ ফোনটি করেন ওই সময়ের তথ্য ও আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে। তিনি ফোনে উপদেষ্টাকে বলেন, ‘এসব কী হচ্ছে? আমি খুব শীঘ্রই মুক্ত হয়ে আসব। তখন আপনারা কেউ রেহাই পাবেন না। এমনকি আপনিও। অতীতে আপনি সহযোগিতার জন্যে আমার কাছে এসেছেন। ভবিষ্যতেও আপনাকে আমার কাছে আসতে হবে।’ এরপরই শেখ হাসিনার সেল ফোনটি জব্দ করা হয়।
গ্রেফতারের পর সুধা সদন থেকে বের হওয়ার পূর্বে দেশবাসীর উদ্দেশে খোলা চিঠি লিখেন শেখ হাসিনা। চিঠিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শেখ হাসিনা দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। আমৃত্যু জনগণের পাশে থাকার অঙ্গীকার করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাব। জয় আমাদের হবেই। ’৭১-এর ২৫ মার্চ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে শেখ হাসিনার পিতা, বাঙালি জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতারের পূর্বে ঠিক এমনভাবেই স্বাধীনতা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এভাবেই হয়।
তবে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের জন্য শতাধিক গাড়িবহর নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকশ’ সদস্য সুধা সদনে যেভাবে যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন, ’৭১-এর ২৫ মার্চের কালরাতে জাতির পিতাকে গ্রেফতার করতে পাকিস্তানি বাহিনীর কিন্তু এত লোকের প্রয়োজন পড়েনি। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে শেখ হাসিনাকে নিয়ে ১২টি গাড়ির একটি বহর আদালতের উদ্দেশে রওনা হয়। এই অল্প সময়ের মধ্যেই খবর পেয়ে নেতাকর্মীরা আদালত প্রাঙ্গণে ভিড় করেন। ৮টা বাজার আগেই নেত্রীকে আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে দেয়া ৩৫ মিনিটের বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাকে নির্বাচন করতে না দেয়ার জন্যই এই সাজানো মামলা দায়ের হয়েছে।’ শেখ হাসিনার আইনজীবীরা অভিযোগ করেন, একটি তুচ্ছ মামলায় শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাকে তারা মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট বলে উল্লেখ করেন। নেতাকর্মীদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে বেলা ১০টা ৩৫ মিনিটে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে আদালতের নির্দেশে জেলহাজতে নেয়া হয়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই গ্রেফতারে তাৎক্ষণিকভাবে দেশে-বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ হয়। এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ, মিছিল, সমাবেশ ও ভাঙচুর হয়েছে। গ্রেফতারের পর থেকেই দেশ-বিদেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। গ্রেফতারের পর পর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রবীণ জননেতা জিল্লুর রহমান শেখ হাসিনার গ্রেফতারের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, ‘মাইনাস-টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের জন্যই এই গ্রেফতার।’
অবিলম্বে নেত্রীর মুক্তি দাবি করে তিনি বলেন, ‘জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্যই উদ্দেশ্যমূলকভাবে এ গ্রেফতার করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘কোন সমন না পাঠিয়ে এই ধরনের গ্রেফতার দেশের সর্বস্তরের মানুষকে বিক্ষুব্ধ করেছে। পক্ষে-বিপক্ষের কেউ এটিকে সহজে মেনে নিতে পারেনি।’ দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘যখন সংস্কারের জিগির উঠেছে তখনই আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে গ্রেফতার করা হলো। কারণ শেখ হাসিনা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করলে সংস্কারবাদীরা ঠাঁই পাবে না। তাই সংস্কারের সঙ্গে এই আটকের সম্পর্ক রয়েছে।’
দলের অন্যতম প্রধান নেত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, সরকারের এ ধরনের অতর্কিত আক্রমণে তিনি বিস্মিত ও মর্মাহত হয়েছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, আইনজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ শেখ হাসিনার গ্রেফতারের প্রতিবাদ ও নিন্দা করেন। শেখ হাসিনার গ্রেফতারের খবর বিশ্ব মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করে। বিবিসি, সিএনএন, এএফপি, এপি, আল-জাজিরা, সিনহুয়ার মতো বার্তা সংস্থায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে।
দলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান জিল্লুর রহমান ঘোষণা করেন, নেত্রী মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত কোন সংস্কার বা কাউন্সিল হবে না। সংস্কারপন্থিরা এই অবস্থায় রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হয়। আওয়ামী লীগে ৭০ বছরের ইতিহাসে দেখা গেছে, যারাই মূল স্রোতের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে দলে বিভাজন এনেছেন, তাদের কেউ সুবিধা করতে পারেননি। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানী, খোন্দকার মোশতাক, মিজান চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, ড. কামাল ও কাদের সিদ্দিকীরা দল ছেড়ে চলে গিয়ে তেমন কোন সুবিধা করতে পারেননি।
শেখ হাসিনা গ্রেফতারের পরদিন ১৭ জুলাই দৈনিক জনকন্ঠে প্রবীণ কলাম লেখক-সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেন, “হাসিনার জন্য এই গ্রেফতার শাপে বর হয়ে দেখা দিতে পারে, তিনি নেতৃত্বের অগ্নি পরীক্ষায় উতরে গেলেন। বলা হয়, ক্রাইসিসেই নেতৃত্বের চরিত্র ও শক্তির পরিচয়। বর্তমানে দল ও তার নেতৃত্বের জন্য যে চরম ক্রাইসিস চলছে, সাহসের সঙ্গে তার মোকাবিলা করে শেখ হাসিনা প্রমাণ করলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের যোগ্য উত্তরসূরি। বঙ্গবন্ধু যেভাবে পাকিস্তানের কারাগারে নয় মাস বন্দী থেকেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন, শেখ হাসিনাও তেমনি জেলেই থাকুন আর জেলের বাইরেই থাকুন, এবার বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে মুক্ত করার সংগ্রামে সাহসী নেতৃত্ব দেবেন। প্রমাণিত হলো, বাংলাদেশের এত নেতা, হাফ নেতা, পাতি নেতা থাকতে প্রকৃত নেতা আছেন একজনই তিনি শেখ হাসিনা।
পাঁচ বছর লুটপাটকারী সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার না করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করায় সেনাসমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠে। দেড় মাস পর ৩ সেপ্টেম্বর সরকার খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়। আসলে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে না দেয়ার জন্যই সেনাসমর্থনে ফখরুদ্দীনের অসাংবিধানিক সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হয়। শেখ হাসিনা বিদেশে থাকলে বা দেশে এসেও আন্দোলনের ডাক না দিলে ওরা পাঁচ-সাত বা দশ বছর ক্ষমতা দখল করে রাখত। কিন্তু লড়াই করে স্বদেশে ফিরে গ্রেফতার বরণ, রাতারাতি লৌহমানবে পরিণত হওয়া ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমানের ১১ মাসের কালজয়ী নেতৃত্ব এবং কয়েকজন ছাড়া সারা দেশের নেতাকর্মীদের বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যার প্রতি সুদৃঢ় অবস্থানের কারণে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীরা নির্বাচন দিয়ে পশ্চাদপসরণ করে।
অন্যদিকে কারা অন্তরিণ অবস্থায় শেখ হাসিনা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসকরা তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার পরামর্শ দেন। জরুরি অবস্থার মধ্যে দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার জামিনে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। প্রায় ১১ মাস কারাবন্দি থাকার পর ২০০৮ সালের ১১ জুন জামিনে মুক্তি পেয়ে শেখ হাসিনা পরদিন চিকিৎসার উদ্দেশে যুক্তরাষ্ট্র যান।
চিকিৎসা শেষে ৬ নভেম্বর দেশে ফেরেন তিনি। প্রথমে তাকে ৮ সপ্তাহের জামিন দেওয়া হয়। এরপর কয়েক দফায় জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। দেশে ফিরে শেখ হাসিনা নির্বাচনের প্রস্তুতি নেন এবং আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করেন।
শেখ হাসিনা ৩৩১ দিন কারাবাসের সময়গুলোতেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তেমনি তার নির্দেশনা অনুযায়ী গণতন্ত্র মুক্তির সংগ্রামে জনমতকে সংগঠিত করেছিল। শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করতেন, সত্যের জয় হবেই। শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। এমনকি তার জীবন বিপন্ন করারও অপচেষ্টা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যার সাহসী ভূমিকা ও জনমতের কাছে গণতন্ত্রবিরোধী সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায়। প্রায় এক বছর কারাবাসের পরে জনতার মাঝে ফিরে আসেন জনগণের নেত্রী শেখ হাসিনা।
২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে মহাজোট। পরপর তিনবার নির্বাচনে বিজয়ী শেখ হাসিনা ১২ বছর ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)