সম্প্রতি ধর্মীয় পরিচয় ও আস্তিক-নাস্তিকতার অজুহাতে দেশে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে প্রাণ হারাতে হয়েছে অনেককে। নিহতদের মধ্যে ব্লগার, শিক্ষক, লেখক, প্রকাশক থেকে শুরু করে মন্দির-গীর্জার প্রধান, এমনকি সাধারণ মানুষও রয়েছেন।
এ সম্পর্কে ব্যক্তিগত একটি ঘটনা উল্লেখ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান আর রাজী।
স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন:
‘ধর্মীয় পরিচয়? বাজে কথা।
আমাদের পরিবারের এক বন্ধু দিনকে দিন অস্বাভাবিক ম্রিয়মান হয়ে যাচ্ছেন। মাঝবয়সী এই ভদ্রলোক তার কাজ-কর্ম প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন, ঘরে বসে থাকেন আর নিজের ও একমাত্র সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে আরও গুটিয়ে যান, নিজেকে আড়ালে রাখতে সব চেষ্টা ব্যয় করছেন। ভয় আর আতঙ্ক তাকে এতই পেয়ে বসেছে যে দড়ি দেখলেও সাপ মনে করে হত-বিহ্বল হয়ে পড়ছেন।
উনার ধারণা এই সবের পেছনের কারণ তার জন্মপরিচয়! তো কী তার জন্মপরিচয়? উনি খ্রিস্টান! উনি সংখ্যালঘু!
আদতে এটিই কি কারণ?
একটু তলিয়ে দেখলে আরও কিছু কথাও উঠে আসে।
উনি গান-বাজনা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। মূলত তবলাবাদক। তবলার ওস্তাদ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যেমন তবলা শেখাতে যান, তেমনই গৃহ-শিক্ষক হিসেবেও অনেককে তালিম দেন। একে খৃস্টান, তার ওপরে আবার বাদ্য-বাজনার শিক্ষক! ইসলামে বাদ্য-বাজনার অনুমোদন নেই বলে উনাকে অনেক মুসলিম সতর্ক করেছেন। সুতরাং ভয় না পাওয়ার, আতঙ্কগ্রস্ত না হওয়ার সুযোগ উনার কম।
আর কিছু কী আছে? কেন এত ভয় পাচ্ছেন উনি?
নাস্তিক বলে, হিন্দু বলে, খ্রিস্টান বলে, গান-বাজনায় জড়িত বলে এদেশে মানুষ যে খুন হচ্ছে এ তো আমরা জানিই। কিন্তু খ্রিস্টান হিসেবে কিংবা বাদক হিসেবে এমন পরিচিত মানুষ নন যে উনাকে এই পরিচয়ে সনাক্ত করে আঘাত করার বিষয়টি উগ্রপন্থীদের মাথায় এ পর্যায়ে আসতে পারে। উনি কি টার্গেট হিসেবে নিজেকে একটু বেশিই গুরুত্ববহ মনে করছেন না?
না রে ভাই আরও ব্যাপার আছে, উনার ভয়ের উৎস-কারণগুলোর মধ্যে আরও একটা ব্যাপার আছে। সেটই সম্ভবত সব কারণের মার্তৃ-কারণ।
ঢাকার ইন্দিরা রোডের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় উনার আড়াই কাঠা জায়গার ওপর দ্বিতল বাড়ি আছে। পৈত্রিক-সূত্রে পাওয়া সেই বাড়িছাড়া করতে নানান লোভ, প্রলোভ, চাপ, ভয় সবই চলেছে, এখনও চলছে।
তাকে কোনো কোনো পর্যায়ে এমনও শুনতে হয়েছে যে, ‘খ্রিস্টানদের দেশ তো লন্ডন-আমেরিকা, তুই এই দেশে আছস কেন, তোর নিজের দেশে যা গিয়া।’
আমার বিবেচনায়, এই হচ্ছে বাংলাদেশে রিলিজিয়নকে বিভেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের অন্যতম মূল কারণ – অন্যের জায়গা, বাড়ি, সম্পদ, সম্পত্তি, নারী, গাড়ি হুমকি-ধামকি-দাঙ্গার ভঙ্গি, কখন সত্যি সত্যিই আঘাত করা, এমন কি কখনও কখনও খুন করে দখল করা।
রিলিজিয়ন বা রাজনীতির আদর্শ এখানে নগণ্য। শত শত বছর ধরে এ দেশে সকল রিলিজিয়নের দুর্বল-মানুষের সম্পত্তি-সম্পদ দখলই শক্তিমানদের লক্ষ্য। কখনও কখনও একটি গোষ্ঠী স্বপ্ন দেখতে শুরু করে প্রতিপক্ষ গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে তাদের সব দখলে নিয়ে নেয়ার। তাই নির্যাতন পরিচালনার ক্ষমতাই তাদের মোক্ষ হয়ে ওঠে। তারা খুনে মেতে ওঠে।’