বুধবার জাতীয় সংসদে বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে দুর্নীতির দায়ে সাজা খাটা সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার ক্ষমতা দখল প্রসঙ্গে মিথ্যাচার করেছেন। এরশাদ মিথ্যা বলবেন এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এই মিথ্যা হজম করা স্বাভাবিক ছিল না কিছুদিন আগেও। জাতীয় সংসদে বসে তার ভাষণটি যারা শুনেছেন তাদের কমবেশী সবাই জানেন এবং বিশ্বাস করেন যে এরশাদ মিথ্যা বলে যাচ্ছেন। তার এই মিথ্যা ভাষণের চেয়ে মারাত্মক হলো কোন প্রতিবাদ না হওয়া।
এরশাদ সংসদে বলেছেন, রাষ্ট্রক্ষমতা নেওয়ার ক্ষেত্রে তার নিজের কোন দোষ ছিল না। দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে তাকে ক্ষমতা নিতে হয়েছিল। তিনি নির্বাচন দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেউ ওই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তার আগের সময়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন: বিচারপতি সাত্তার নির্বাচন করবেন। আমি সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলাম, নির্বাচনের জন্য তাকে সাহায্য করেছিলাম। কিন্তু এক বছরের মাথায় তিনি বললেন, আমার মন্ত্রিসভার সকল সদস্য দুর্নীতিপরায়ণ। আমি দেশ পরিচালনায় অপারগ। সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাই। আমরা প্রস্তুত ছিলাম না, কারণ দেশ পরিচালনা করা সহজ ব্যাপার নয়। এটা আমি উপলব্ধি করি। আমি ক্ষমতা নিতে চাইনি। কিন্তু কোনো উপায় ছিল না, ক্ষমতা নিতে হয়েছিল। বাধ্য হয়ে এই দায়িত্ব আমাকে গ্রহণ করতে হয়েছিল।
এরশাদের এই ভাষণ যে সত্য নয় সেটা প্রমাণ করার জন্য তথ্য প্রমাণ হাজির করাটাও সমীচিন মনে করি না। কারণ এটা ১৯৮২ সালের কথা। ১২৮২ বা ১৩৮২ সালের কথা নয়। তখনকার রাজনীতিবিদ, সামরিক বাহিনীর সদস্য, লেখক, গবেষকদের প্রায় সবাই বেঁচে আছেন। তাই যা খুশী বলে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। ক্ষমতা দখলের জন্য তিনি কী রকম প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন তা আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা সবটাই জানেন। তারা জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের নিন্দা প্রকাশ্যেই করেন, কেউ কেউ জেনারেল জিয়ার মরণোত্তর বিচারও দাবি করেন। অথচ জিয়ার মতোই ক্ষমতা দখলকারি একজন এখনো বেঁচে আছেন, তার বিচার দাবি করেন না, যদিও এক সময় করতেন।
একজন সেনাপ্রধান, যখন একটি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় তখন সম্পাদকদের ডেকে সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতার অংশীদার করার জন্য সাংবিধানিক ব্যবস্থার দাবি জানালেন। ১৯৮১ সালের নভেম্বরে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেছেন, সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রক্ষমতার ভাগ দিতে হবে। আর ৮২ সালের মার্চে তিনি সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতায় বসলেন, আর এখন কিনা বলছেন রাষ্ট্রপ্রধানের অনুরোধে তিনি ক্ষমতা নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
দুঃখজনক হলো ক্ষমতায় গিয়ে কি এমন ‘হজমি’ খেল আওয়ামী লীগ, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি! তাদের কোন একজনও এরশাদের মিথ্যাচারের প্রতিবাদ করলেন না। হতে পারে তিনি এখন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত, হতে পারে তার দল সরকারের অনুগত বিরোধীদল, তাই বলে এরশাদকে স্বৈরাচার আখ্যা দিয়ে যারা বছরের পর বছর আন্দোলন করলেন, জেল জুলুম হুলিয়া নিয়ে জীবনের ৯টা বছর পার করলেন, চোখ বেঁধে যাদের ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হলো; তাদের অনেকেই এরশাদের ওই ভাষণ সংসদে বসে শুনেছেন, তাদের একজনও প্রতিবাদ করলেন না। একজনও বললেন না, মাননীয় স্পিকার ওই মিথ্যা ভাষণ এক্সপাঞ্জ করা হোক। নুর হোসেন ডা. মিলনদের আত্মত্যাগের কথা বাদই দিলাম। তাদের সহযোদ্ধাদের সামনেই সংদের কার্যবিবরণীতে ঠাঁই পেয়ে গেল ‘এরশাদের কোন দোষ ছিল না’!
এরশাদকে স্বৈরাচার বলা হয় কেন এ নিয়েও তিনি সংসদে আক্ষেপ করেছেন। বলেছেন ‘আমাকে মাঝে মাঝে বলা হয় স্বৈরাচার। আমার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছিল। দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে আমাকে ক্ষমতা নিতে হয়েছিল। কিন্তু এ জন্য আমাকে ছয়টি বছর কারাগারে থাকতে হয়েছে। অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।’
১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদে খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাই এরশাদকে কারাগারে পাঠানোর দাবি জানিয়েছিলেন। তার আগে অবশ্য সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যও দাবি তুলেছিল। সেই চাপে পড়েই বেগম জিয়া এরশাদকে জেলে পাঠান। এর আগ পর্যন্ত গুলশানের একটি বাড়িকে সাব জেল ঘোষণা করে তাকে সেখানে রাখা হয়েছিল। সেই এরশাদ এখন বলছেন, তাকে মাঝে মাঝে বলা হয় স্বৈরাচার। একজন স্বৈরাচার সব সময়ই স্বৈরাচার হিসেবেই ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ইতিহাস ভুলভাবে লেখা হচ্ছে। কারণ ২০-৩০-৫০ বছর পর যখন কোন নবীন গবেষক বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করবেন তখন তিনি সংসদের কার্যবিবরণী দেখে নিশ্চয়ই ভুল বার্তা পাবেন। তিনি তখন প্রশ্ন করবেন, এরশাদ যদি সত্যি না বলে থাকেন তখন কেউ প্রতিবাদ করলেন না কেন?
তাকে শুধু স্বৈরাচারই না দুর্নীতিবাজও বলা উচিত। কারণ বাংলাদেশে তিনিই এখন একমাত্র রাজনীতিবিদ, সাবেক সেনা প্রধান, সাবেক সামরিক আইন প্রশাসক, সাবেক রাষ্ট্রপতি, বর্তমানে যিনি সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত যিনি সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক সাজাখাটা আসামীও। তিনি সাজা খাটার পাশাপাশি সাড়ে তিন কোটি টাকা জরিমানাও দিয়েছেন। আদালতের চুড়ান্ত রায়ের পর যেমন একজন যুদ্ধাপরাধীর নামের আগে পরিচয় হিসেবে যুদ্ধাপরাধী নিজামী বা যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম লেখা হয়, ঠিক তেমনি এরশাদের নামের আগেও সাবেক রাষ্ট্রপতি না লিখে দুর্নীতিবাজ এরশাদ লেখা উচিত। নয়তো নিজামী বা মুজাহিদের নামের আগে সাবেক মন্ত্রী লিখতে হবে।
সংসদে সাবেক এই একনায়ক আরো বললেন, ‘আমি সেদিন বলেছিলাম- আমি নির্বাচন দিয়ে শৃঙ্খলা ফিরে আসার পর আবার ব্যারাকে ফিরে যাব। আমি আমার কথা রেখেছিলাম। ১৯৮৪ সালে নির্বাচন দিয়েছিলাম। ওই নির্বাচনে সকলে অংশগ্রহণ করলে আমি ব্যারাকে ফিরে যেতে পারতাম। দুঃখের বিষয়ে তখন বিএনপি, জামায়াত, আওয়ামী লীগ কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। এখানে আছেন মেনন সাহেব, ইনু সাহেবও অংশগ্রহণ করেননি। এর ফলশ্রুতিতে আমাকে ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি সৃষ্টি করতে হয়েছিল।’
আওয়ামী লীগ না হয় ক্ষমতায়, সংসদকে বৈধতা দিতে এরশাদের দলকে গৃহপালিত বিরোধী দল করে রেখেছে, ওই যে ইনু সাহেব আর মেনন সাহেব চুপ করে রইলেন? কোন কথা বলতে পারলেন না? ইনু সাহেবতো এরশাদের পতনের ৬ দিনের মাথায় মতিঝিল থানায় একটি মামলা করেছিলেন, অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের, রাষ্ট্রদ্রোহের ওই মামলা করে তিনি কী ভুল করেছিলেন? তাকে এ ব্যাখ্যাও দিতে হবে: এরশাদের ক্ষমতা দখল যেটা ৯০ সালে বলেছিলেন অবৈধ, এখন কী সেটা বৈধ হয়ে গেছে? ২০১০ সালের আগস্টে যখন উচ্চ আদালত এরশাদের ক্ষমতা দখলকে আবৈধ ঘোষণা করলো তখন তিনি বলেছিলেন, আইনবিদদের সাথে আলোচনা করে তার ওই মৃত মামলাকে জীবিত করার চেষ্টা করবেন। গত সাত বছরে তার কোন উদ্যোগ আমরা দেখিনি।
২০১০ সালের ২৬ আগস্ট হাইকোর্ট এরশাদের সামরিক শাসনকে অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করেন। রায়ে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মোশতাক ক্ষমতা নেন। খন্দকার মোশতাক আহমেদ স্পিকার বা ভাইস প্রেসিডেন্ট না হয়েও অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন। তিনি বৈধ ক্ষমতার দাবিদার ছিলেন না। মোশতাকের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেন জিয়াউর রহমান। …জিয়ার উত্তরসূরি হিসেবে বিচারপতি সাত্তারের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। মোশতাক, সায়েম ও জিয়ার মতো এরশাদও অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী। তার এই কাজকে মার্জনা করা যেতে পারে না। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে এরশাদ তার দায় এড়াতে পারেন না। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর রায়ের আলোকে এ ধরনের অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীকে যথাযথভাবে শাস্তি দিতে সংসদ আইন প্রণয়ন করতে পারে।
পরবর্তী সময়ে এই আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান সংশোধন করে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারির বিচারের পথ করে দিয়েছে। কিন্তু দেশের আইনবিদরা মনে করেন, প্রচলিত আইনেও এরশাদের ক্ষমতা দখলের বিচার করা সম্ভব। হাসানুল হক ইনু যে মামলাটি করেছিলেন সেটি পুনরুজীবিত করলে তাকে বিচারের মুখোমুখি করা যাবে। যেটা হাইকোর্টের রায়েও ঈঙ্গিত দেয়া আছে। হাইকোর্ট বলেছেন, এরশাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১২২ ও ১২৪ ধারায় মামলা করার সাক্ষ্য এবং ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগের যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে কি-না বিষয়টি সরকার খতিয়ে দেখবে। এখন জাতির সামনে বড় প্রশ্ন: সরকার কোনদিন এটা খতিয়ে দেখবে কিনা?
রাজনীতিবিদরা সবাই মিলে ওই সামরিক একনায়ককে ক্ষমা করে দিয়ে কাছে টেনে নিয়েছেন। আবার সংবিধানে যুক্ত করে দিয়েছেন ভবিষ্যতে কেউ যেন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করতে না পারে, কেউ সেটা করলে তার বিচার করা হবে। কিন্তু যিনি এখনো বেঁচে আছেন তার বিচার না করলে ভবিষ্যতে কেউ একই কাজ করলে তার বিচারের নৈতিকতা থাকে কোথায়, সেটা রাজনীতিবিদরা ভেবে দেখলেন না। রাজনীতিবিদদের মনে রাখা উচিত স্বৈরশাসকদের ক্ষমা করলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)