খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর হওয়ার জন্য ২৪টি তফসিলি ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই জন্য প্রয়োজনে সশরীরে গ্রাহকের কাছে যাওয়া এবং দুদককে খেলাপি গ্রাহকের তথ্য দেয়ার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার পরও এ খাতে একের পর কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটছে। ফলে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ নিয়ে এক ধরনের উদ্বিগ্নতার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাই ঋণ আদায়ে কঠোর নির্দেশ ও কিছু দিক নির্দেশনা দিয়ে গত ৭ মার্চ দেশের ২৪টি তফসিলি ব্যাংককে চিঠি দেয়া হয়েছে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব নির্দেশনায় কোনো কাজ হবে না। ব্যাংকগুলো গ্রাহকের তথ্য যাচাই-বাছাই না করে দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ দিয়েছে, তাই খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ উদ্ধার করা কঠিন হবে। তবে ভবিষ্যতে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে শতভাগ সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চিঠি পাওয়া ব্যাংকগুলো হলো-রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বাংলাদেশ কৃষি, বেসিক, বিডিবিএল পূবালী ব্যাংক। আর বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), এইচএসবিসি, ঢাকা ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক, ডাচ বাংলা, স্ট্যান্ডার্ড, ফার্স্ট সিকিউরিটি, এবি, দ্য সিটি, প্রাইম, আইএফআইসি, ব্র্যাক, সাউথইস্ট ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান।
এর আগে তফসিলি ব্যাংকসমূহের শ্রেণীকৃত ও অবলোপনকৃত ঋণ আদায় অগ্রগতি সংক্রান্ত সভায় এসব নির্দেশনা দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। এই ঋণের মোট পরিমাণ ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আর ৩ মাস আগের তুলনায় বেড়েছে ৬ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের মধ্যে ৮২ শতাংশ বা ৬৫ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা মন্দমানের খেলাপি। এ মানের ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা সাধারণত কম থাকে।
গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ৭ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। মোট ঋণের ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশই এখন খেলাপি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে। গত সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ২৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। এসব ঋণের মধ্যে ৩১ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা মন্দমানের খেলাপি।
সরকারি দুই বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা; যা তাদের মোট ঋণের ২৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
এছাড়া বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে তিন মাসে খেলাপি ঋণ ২ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা বেড়ে ৩৩ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা হয়েছে। এক্ষেত্রে খেলাপি ঋণের হার ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এসব ব্যাংকে মন্দমানের খেলাপি ২৭ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা।
বিভিন্ন ব্যাংককে দেয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই চিঠিতে বলা হয়, খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে সেই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে হবে।
ঋণ আদায়ে জোর তাগিদ দিয়ে বলা হয়, প্রয়োজনে খেলাপি গ্রাহকদের ঠিকানায় সশরীরে গিয়ে ঋণ আদায়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। অভিযুক্তদের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতা নিতে হবে।
ঋণ আদায়ে পরামর্শ দিয়ে চিঠিতে আরো বলা হয়, অর্থ ঋণ আদালতসহ বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে মহামান্য হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট পিটিশনসমূহ, বিশেষ করে স্টে অর্ডার খারিজ করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর প্রধান কার্যালয়ের ঋণ আদায় ইউনিটকে নিয়মিতভাবে গ্রাহক বা শাখা পরিদর্শনে পাঠানো জরুরি। এতে যারা সফল হবেন, তাদের বিশেষ প্রণোদনা ও দক্ষতা বাড়াতে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আর যারা ব্যর্থ হবেন, তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।
ব্যাংকের আইসিটি’র পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে চিঠিতে বলা হয়, নিয়মিতভাবে শাখা ব্যবস্থাপক এবং আঞ্চলিক ব্যবস্থাপকদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঋণ আদায় কার্যক্রম তদারক করা ও কোর ব্যাংকিং সলিউশন বা সিবিএস (এক ধরনের সফটওয়্যার, যার মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয়) পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে এডিআর (বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) পদ্ধতিতে বাংলাদেশ ইন্টারনেশনাল আরনিট্রেশন সেন্টার (বিআইএসি) এর সহযোগিতায় খেলাপী ঋণ আদায় কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। বাহির থেকে বুঝা না গেলেও কোনো ব্যাংকই ভাল অবস্থায় নাই। দিন দিন বাড়ছে খেলাপির পরিমাণ।
তিনি বলেন, ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছে। কারণ তারা গ্রাহকের পূর্ণাঙ্গ তথ্য যাচাই না করেই ঋণ দিচ্ছে। এসব অসৎ পথ থেকে বের হয়ে আসা জরুরি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, এসব নির্দেশনায় এখন আর কোনো কাজ হবে না। কারণ দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ঋণ দেয়া হয়েছে। তাই খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম।
বিভিন্ন মহলের চাপে গ্রাহকদের ঋণ দেয়া হয়েছে, এখনও হচ্ছে- এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক চাপে কিংবা স্বপ্রণোদিত হয়ে ঋণ দেয়া বন্ধ করতে হবে। নতুন করে যেসব ঋণ দেয়া হচ্ছে তা যেন যাচাই করে দেয়া হয়, নতুবা এভাবে খেলাপি হতেই থাকবে।