খাসিয়া সম্প্রদায়ের নারী কাঁকন বিবি। নিজের এলাকায় ‘মুক্তি বেটি’ নামে পরিচিত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে চলাকালে পাক বাহিনী আর রাজাকারদের হাতে বারবার নির্যাতিত হয়েছেন। তবু দমে যাননি এই নারী। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছেন সম্মুখ সমরে।
বুধবার রাতে ৮৮ বছর বয়সে ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বীরপ্রতিক খেতাব পেয়েছিলেন কাঁকন বিবি। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু তা আর গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়নি। গেজেটে খেতাব না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়েই চলে গেলেন কাঁকন বিবি।
অনলাইনভিত্তিক নিউজ পোর্টাল সিলেটটুডে২৪.কম এর বরাত দিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ স্বাধীন করার নিমিত্তে জীবনের শেষ আশা ত্যাগ করে কাঁকন বিবি বেছে নিয়েছিলেন গুপ্তচরবৃত্তি, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছেন কয়েকবার। তবে যুদ্ধ শেষে কোন এক অভিমানে দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন। স্বাধীনতার ২৫ বছর পর ১৯৯৬ সালে সাংবাদিক রনেন্দ্র তালুকদার পিংকু তাকে ভিক্ষারত অবস্থায় খুঁজে পান। গণমাধ্যমে আসেন তিনি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাঁকন বিবিকে এক একর খাস জমি ও বীরপ্রতিক উপাধি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ওই জমিতেই ছোট্ট কুড়ে ঘরে বসবাস করতেন তিনি। একমাত্র মেয়ে সখিনা বিবি ও মেয়ের জামাই রফিক মিয়াকে নিয়েই ছিলো তাঁর সংসার।
বেসরকারীভাবে কাঁকন বিবি প্রথম স্বীকৃতি পান ১৯৯৮ সালে দৈনিক জনকণ্ঠের দেয়া সংবর্ধনায়। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য এককালীন অর্থসহ প্রতি মাসে তাকে সম্মানী দিত জনকণ্ঠ।
কাঁকন বিবি মহান মুক্তিযুদ্ধে এক সাহসী নারীর নাম। নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে বেছে নেন গুপ্তচরবৃত্তির পথ। জীবনবাজি রেখে পাকিস্তানী মিলিটারির তথ্য সংগ্রহ করে আনতেন, সরবরাহ করতেন মুক্তিবাহিনীর মধ্যে। তার দেয়া তথ্যানুযায়ী একাধিক মিশনে জয়ী হয় মুক্তিবাহিনী। সাহসী এই নারী সরাসরি অংশ নিয়েছেন আমবাড়ি, বাংলাবাজার, টেবলাই, বলিউরা, মহব্বতপুর, বেতুরা, দূরিনটিলা, আধারটিলাসহ প্রায় ৯টি সম্মুখযুদ্ধে।
জানা যায়, ১৯৭১ সালে জুন মাসে দোয়ারাবাজার সীমান্তে পাকবহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী হেরে গেলে অনেকের সঙ্গে আটক করা হয় কাঁকন বিবিকেও। দিনের পর দিন চলতে থাকে পাশবিক নির্যাতন। থেমে যাওয়ার নারী ছিলেন না তিনি। প্রতিশোধের আগুনে ফুঁসতে থাকেন। ক্যাম্প থেকে মুক্তি পাওয়ার পর পরিচয় হয় মুক্তিযোদ্ধা রহমতের সঙ্গে। কাঁকন বিবিকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলীর সঙ্গে। মূলত তাঁর নির্দেশেই বেছে নেন গুপ্তচরবৃত্তির পথ। কাঁকন বিবির সরবরাহকৃত তথ্য মোতাবেক অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং কয়েকটি অপারেশন সফল হয়। তবে আবারও ধরা পড়েন তিনি, এবার বাংলাবাজারে। শুরু হয় তাঁর ওপর নির্যাতনের স্ট্রিমরোলার। দীর্ঘ এক সপ্তাহ চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
নির্যাতনের একপর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়লে অজ্ঞান অবস্থায় মৃত ভেবে নরপিচাশরা তাকে ফেলে রেখে যায় রাস্তার পাশে। সহ যোদ্ধাদের সেবায় ৭ দিন পর জ্ঞান ফিরে এলে বলাট সাব সেক্টরে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করানো হয়। সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে এসে আবারও দৃঢ়প্রতিজ্ঞায় প্রশিক্ষণ নেন অস্ত্র চালানোর। শুরু করেন পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম। জয়ী হয় বাংলাদেশ।
সুনামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু বলেন, ৯৬ সালে কাঁকন বিবিকে বীরপ্রতীক উপাধি দেয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। পত্র-পত্রিকায় তাকে বীরপ্রতীক হিসেবে বলা হলেও গেজেট এখনও প্রকাশিত হয়নি।