আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চরম ব্যর্থতা প্রকাশ পাচ্ছে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। এখানে খুন হয় তবে খুনের রহস্য উদ্ঘাটন ও বিচার কোনটাই হয় না। ছাত্রলীগ নেতা বাক্কি হত্যা, আওয়ামী লীগ নেতা মীর কাসেম হত্যা, কল্লোল হত্যা, চেয়ারম্যান রানা হত্যা, পল্লীচিকিৎসক রুবেল হত্যা, রিকেল হত্যা, রেলস্টেশনে বৃদ্ধ হত্যাসহ আরও অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
রানা চেয়ারম্যান হত্যার এক বছর অতিবাহিত হলো ২২মে, ২০১৬। সম্প্রতি ১১ মে রাত আটটায় এ উপজেলার বড়তলী গ্রামে ঘটলো জোড়া খুনের ঘটনা। বসতবাড়িতে শিশু সন্তানসহ মা-বাবার আগুনে পোড়া নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা ও নানা গুঞ্জনে সৃষ্টি হয়েছে রহস্যের ধূম্রজাল।
অগ্নিদগ্ধ হয়ে পল্লী বিদ্যুতের ইলেক্ট্রিশিয়ান সবুজ মিয়ার শিশু কন্যা নোভা (৬)অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায় । গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন নোভার বাবা সবুজ মিয়া ও মা রিপা আক্তার। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় সবুজ মিয়াকে মোহনগঞ্জ হাসপাতাল হতে অগ্নিদগ্ধের দিনই ময়মনসিংহ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানকার চিকিৎসকরাও তাকে চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হয়। অতঃপর সবুজ মিয়াকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ণ ইউনিটে ভর্তি করা হয়। চারদিন মৃত্যুর সাথে লড়ে সবুজ মিয়া মৃত্যুবরণ করে। তার এই মৃত্যুকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে এক গভীর রহস্য।
বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বিভিন্ন রকমের প্রতিবেদন বেরিয়েছে। দৈনিক জনকন্ঠ, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক যুগান্তরসহ অনেক পত্রিকায় এই পিতা কন্যা যুগলের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর খবর বেরিয়েছে।
১৬/৫/১৬ ইং দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকায় লিখেছে, মৃতের পরিবার দাবী করেছে চতুর্থ ধাপের ইউপি নির্বাচনে একজন প্রার্থীর হয়ে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন সবুজ মিয়া। নির্বাচনে ওই প্রার্থী জিতলে প্রতিপক্ষ প্রার্থীর আক্রোশের শিকার হন। জনকন্ঠে ও,সি মেসবাহ্ উদ্দিন বলেন, প্রাথমিক তদন্তে নির্বাচনী সহিংসতার কোন আলামত পাওয়া যায়নি। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ণ ইউনিটের আবাসিক ডাক্তার পার্থ শংকর পাল জানান, সবুজের শরীরের ৪৮ শতাংশ ঝলসে গিয়েছিল।
১২/৫/২০১৬ তারিখের দৈনিক যুগান্তর শিরোনাম করেছে, মোহনগঞ্জে বসত ঘরে আগুন লেগে স্কুল ছাত্রী নিহত। এতে লিখেছে, আগুন কিভাবে লাগল সেটি নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। আরও লিখেছে, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে জানানো, সবুজের মেয়ে নোভার শরীরের ৮৫ ভাগ, সবুজের ৪০ ভাগ ও রিপার ২০ ভাগ পুড়েছে।
১২/৫/২০১৬ তারিখের বাংলাদেশ প্রতিদিন লিখেছে, আগুনে পুড়ে শিশুর মৃত্যু বাঁচাতে গিয়ে বাবা মা খুন। এতে মোহনগঞ্জ থানার ও,সি মেসবাহ্ উদ্দিন জানান, সবুজ মিয়ার বাড়িতে রাতে ভাত খাওয়ার সময় কূপি থেকে হঠাৎ আগুন লেগে যায়। সবুজ মিয়া শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে দগ্ধ হন। এরপর মা এগিয়ে এলে তার গায়েও আগুন ধরে যায়।
দৈনিক প্রথম আলো নিহতের পরিবারের কারও বক্তব্য না নিয়ে শুধু ও,সি মেসবাহ্ উদ্দিনের কূপি বাতি হতে আগুন লাগা উল্লেখ করে সংবাদ প্রকাশ করে। পত্রিকার রিপোর্ট, অগ্নিকাণ্ড, নানা জনের নানা বক্তব্য নিয়ে জোড়া হত্যাকাণ্ড ঘিরে সবুজের গ্রামের বাড়ি বড়তলীসহ গোটা এলাকায় চলছে নানা আলোচনা, সমালোচনা। এখানে খুন হয়, পত্রিকায় রিপোর্ট হয়।
কিছু ক্ষেত্রে খুন হওয়া ব্যক্তির মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষ্যে এলাকায় পোষ্টারিং হয় কিন্তু খুনের রহস্য উদ্ঘাটন ও বিচার হয় না। ছাত্রলীগ নেতা বাক্কি ও আওয়ামী লীগ নেতা মীর কাসেম হত্যার বছরের পর বছর পেরিয়ে যাচ্ছে খুনের রহস্য উদ্ঘাটন ও বিচার কিছুই হল না।
সবুজ ও নোভার মৃত্যুুর পরদিনই মোহনগঞ্জ রেল স্টেশনে পুলিশ ফাঁড়ির কাছেই অজ্ঞাত ব্যক্তির হাতে একজন বৃদ্ধ খুন হল। একজন শিশু ও কিশোর আহত হল। বৃদ্ধ বাদল বিশ্বাস চিকিৎসার জন্য ট্রেনযোগে ময়মনসিংহ যেতে চেয়েছিল।
প্যাসেঞ্জারদের নিরাপত্তার জন্য মোহনগঞ্জ রেল স্টেশনে রেল পুলিশ ফাঁড়ি ও সিসি ক্যামেরা রয়েছে। সিসি ক্যামেরা নিয়ে কী দায়িত্ব পালন করলো স্টেশন কর্তৃপক্ষ। কী দায়িত্ব পালন করল রেল পুলিশ। জনমনে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। আইন শৃংখলা বাহিনীর দায়িত্বশীলতা হয়ে উঠছে প্রশ্নবিদ্ধ। মোহনগঞ্জ যেনো খুন আর খুনের বিচারহীনতার অভয়ারণ্য। মামুদ পুর গ্রামে একজন ১৪ বছরের কিশোরকে মেরে সেফটিক ট্যাঙ্কে ভেতরে ভরে রাখল।
আওয়ামী লীগ বারবার ক্ষমতায় আসা সত্বেও ছাত্রলীগ নেতা বাক্কি ও আওয়ামী লীগ নেতা মীর কাসেম হত্যার বিচার হল না। এজন্যই খুনের সিরিয়াল বাড়ছে। সবুজ মিয়া ও নোভার মৃত্যুর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও কারও গ্রেফতারতো দূরের কথা পুলিশী কোন তৎপরতাই নেই। বরং হত্যার বিরুদ্ধে জনতার ক্ষুব্ধতা দমনে তৎপর থাকে তারা। যেমনটি হয়েছিল ২০১৫ সনের রানা চেয়ারম্যান হত্যার বিরুদ্ধে সড়ক অবরোধকারীদের প্রতি। রানার মৃত্যুতে শোকাহত ক্ষুব্ধ জনতাকে লাঠিচার্জের ভয় দেখিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছিল। খুনের প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে তৎপরতা না দেখিয়ে যদি খুনের রহস্য উন্মোচন ও খুনীদের গ্রেফতারে তৎপর হত তখন পরিস্থিতি অন্যরকম হতো।
সবুজ মিয়া ও নোভার মৃত্যুর পর মাইকিংয়ে এলাকার সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত বলায় মোহনগঞ্জ থানার ওসি ক্ষুব্ধ হয়। নিহতের পরিবারকে এই বলে শাসায় যে, কার অনুমতিতে মাইকিং করছেন। ওসি মেসবাহ উদ্দিন বিভিন্ন সংবাদ পত্রে বলে যে কূপি বাতি হতে আগুন লেগে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। যে সংবাদপত্রে নিহতের স্ত্রী ও তার পরিবারের বক্তব্য আসেনি কিছু লোক এলাকায় সে রিপোর্টের ফটোকপি বিতরণ করতে থাকে। এনিয়ে এলাকায় শুরু হয়েছে নানা গুঞ্জন।
কিছু পত্রিকায় এসেছে ইউপি নির্বাচন পরবর্তি সহিংসতার জেরে এমনটি ঘটতে পারে। সরেজমিন এলাকা ঘুরে জানা যায় নির্বাচন পরবর্তী সময়ে দুই প্রার্থী সমর্থকদের মধ্যে রাতে বাকবিতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়েছিল। সবুজ মিয়ার শ্যালক সোলেমান প্রতিপক্ষ প্রার্থীর সমর্থক মন্তুষের সাথে হাতাহাতি ও মারামারি করেছিল।
নিহত সবুজ মিয়া তা জানতে পেরে বিরোধ মিমাংসার চেষ্টা করে। সোলেমানের বাবা নূরুল হক নীলোৎপল দাশের বাড়ি গিয়ে ছেলের অপকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। ওই দিন সবুজ একজনকে মুঠোফোনে বলেন, নীলোৎপল দাশকে আমার শশুর পায়ে ধরেছে। তবু শুনেনি। লোকজন নিয়ে বাজারে চলে গেছে। এরপর কিছু লোক সবুজের চাচা ও শশুর নূরুল হক ও শ্যালক সোলেমানকে উত্তেজিত অবস্থায় খুঁজতে থাকে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায় সেদিন নূরুল হক ও সোলেমানকে পেলে তারা মারতো। পরদিন এ বিষয়কে কেন্দ্র করে নীলোৎপল দাশের বাড়িতে সালিশ বৈঠক হয়। এতে সবুজ মিয়ার শ্যালক ক্ষমা প্রার্থনা করে। আপাতত নির্বাচনী সহিংসতার এখানে সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু সবুজের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণের পরে নীলোৎপল দাশের মামলাভীতি ও নেতাদের কাছে ছুটোছুটি নিয়ে নানা কথা উঠছে।
নিহতের পরিবার কারও নাম বলেনি, কাউকে আসামি করে মামলাও করেনি তবে কেন নীলোৎপল দাশের এত ছুটাছুটি? কেন ওসির বক্তব্য সম্বলিত পত্রিকার ফটোকপি বিলানো? সবুজের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু ক্রমশ রহস্যজনক হয়ে উঠছে।
মোহনগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোজাম্মেল হক নিহতের স্ত্রী ও পরিবারের সাথে কথা বলেছেন ও শোকাহত স্বজনদের ৫ হাজার টাকাও অনুদান দিয়েছেন। তাদের মধ্যে কি কথা হল তা মিডিয়ায় আসেনি। নিহতের পরিবার ইউএনও র কাছে কাউকে দায়ি করে কিছু বলেছে কিনা সেটাও জানা যায়নি। সবুজের ভাই জুয়েল বলেছে সে সবুজের ছোট মেয়ে নাভিলাকে নিয়ে তার ঘরে ছিল। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে ঘর হতে বের হয়।
সে জানায়, সবুজের ঘরে একটি পোড়া বোতল পাওয়া গেছে যা পুলিশে নিয়ে গেছে। এলাকাবাসীর দাবী এ রহস্যের দ্রুত উন্মোচন হোক ও বিচার হোক। তা না হলে ভবিষ্যতে আরও খুনের ঘটনা ঘটবে। সেইসাথে আরও দাবী অন্যায়ভাবে নিরাপরাধ কোন মানুষ হয়রানির শিকার না হোক।
অগ্নিদগ্ধ হয়ে এই জোড়াখুনের ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা বিবেকবান কোন মানুষেরই কাম্য নয়। প্রশাসন কি তা খুঁজে বের করবে? এই প্রশ্ন সকলের। মানুষ মোহনগঞ্জে আর কোন খুনের ঘটনা দেখতে চায় না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)