তুরস্কে সৌদি কনস্যুলেটে ঢোকার পর থেকে নিখোঁজ সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে ‘দুর্ঘটনাবশত’ মৃত্যুর কথা স্বীকার করার পর শনিবার এ ঘটনার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছে সৌদি সরকার।
তবে নিখোঁজ হওয়ার ১৭ দিন পর দেয়া এই ব্যাখ্যায়ও কিছু ফাঁক রয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছে তুর্কি সরকার।
এমন ৯টি প্রধান ফাঁক চিহ্নিত করেছে তুরস্ক:
১. খাশোগি কি সত্যিই সৌদি আরবে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন?
সৌদির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, খাশোগি হত্যাকাণ্ডে ‘সন্দেহভাজনরা’ সৌদি আরব থেকে ইস্তাম্বুলে এসেছিলেন খাশোগির সঙ্গে দেখা করতে কারণ খাশোগি নিজেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি দেশে ফিরতে চান।
তবে খাশোগির বাগদত্তা হাতিস চেনগিজকে নিয়ে ওইদিন সৌদি কনস্যুলেটে গিয়েছিলেন তিনি। কারণ তুরস্কের নাগরিককে বিয়ে করতে হলে কিছু সরকারি কাগজপত্র তুলতে হতো তার। এমনকি বন্ধুরাও জানান, খাশোগি নিজেই তাদের বলেছিলেন, সৌদি তাকে ছলে-বলে-কৌশলে দেশে ফিরিয়ে নিতে চাইছে বলে তার সন্দেহ।
২. শুধুই আলোচনার জন্য কেন ১৫ জনের বেশি মানুষ সৌদি থেকে ইস্তাম্বুলে উড়ে আসবে?
সৌদি সরকারের ব্যাখ্যা মতে, কনস্যুলেটের ভেতর খাশোগির সঙ্গে কথা শুরু হয়েছিল শুধুই আলোচনা হিসেবে। কিন্তু দ্রুতই তা খাশোগি ও সন্দেহভাজনদের কয়েকজনের মধ্যে প্রথমে ঝগড়া এবং পরে মারামারিতে রূপ নেয়।
জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে মোট ১৮ জনকে আটকের কথা জানিয়েছে সৌদি আরব। অন্যদিকে তুর্কি সরকার ১৫ জনের নাম প্রকাশ করেছে, যারা এই সাংবাদিকের নিখোঁজ হওয়ার কিছু সময় আগে ইস্তাম্বুলে এসেছিল এবং এর কয়েক ঘণ্টা পর দেশে ফেরতও চলে গিয়েছিল।
এখন প্রশ্ন হলো, জামাল খাশোগি যদি দেশে ফিরে যাওয়ার কথা বলতেও গিয়ে থাকেন, সেই আলোচনার জন্য এত বেশি মানুষকে কেন সৌদি থেকে তুরস্কে যেতে হলো?
৩. দলটিতে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ছিল কেন?
সৌদি সরকারের বিবৃতি বলছে, আলোচনাটি ছিল একেবারেই সাধারণ। অথচ সেই বিশাল প্রতিনিধি দলে অন্তত ১২ জন ছিল সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য।
শুধু তাই নয়, সন্দেহভাজনদের একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ সালাহ মুহাম্মদ আল-তুবাইগি, যিনি নিজ দেশে দ্রুতগতির ভ্রাম্যমাণ ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়ার অগ্রদূত হিসেবে খ্যাত। এমন কাউকে হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ মুছে ফেলা ছাড়া অন্য কোনো কারণে আনা হতে পারে – এমনটা ভাবতে পারছেন না বিশ্লেষকরা।
৪. কনস্যুলেটের ভেতর আসলে কী হয়েছিল?
ব্যাখ্যায় কনস্যুলেটের ভেতর ‘কথা কাটাকাটি বা ধস্তাধস্তি’র কথা বলা হয়েছে। যদিও খাশোগি স্বেচ্ছায় একা গিয়ে কনস্যুলেটে ঢুকেছিলেন এবং ১৫ জনের একটা দলের সঙ্গে সেখানে তার দেখা হয়েছিল। এতে অন্তত এটুকু প্রমাণ হয় যে, এমন পরিস্থিতিতে দু’পক্ষ সমান শক্তির ছিল না।
তুরস্ক ওই সময়ের একটি অডিও রেকর্ডিং সিআইএ’কে হস্তান্তর করেছে বলে জানানো হয়েছে। আশা করা হচ্ছে এটি বিশ্লেষণ করে ওই সময় কনস্যুলেটের ভেতরে আসলে কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে।
৫. খাশোগির মরদেহ কোথায়?
অবশেষে খাশোগিতে হত্যার কথা স্বীকার করলেও তার মরদেহ আসলে কোথায়, সে ব্যাপারে এখনো কিছু জানায়নি সৌদি আরব। শনিবারের ব্যাখ্যায়ও এ ব্যাপারে কিছুই প্রকাশ করা হয়নি।
প্রথম প্রথম মনে করা হয়েছিল তার মৃতদেহ দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে এরপর বেলগ্রেড জঙ্গলসহ ইস্তাম্বুলের আশপাশে বেশকিছু মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে অনুসন্ধান চালিয়েছে তুর্কি কর্তৃপক্ষ।
শুক্রবার অবশ্য সৌদির একটি সূত্র রয়টার্সকে জানায়, খাশোগিকে হত্যার পর দেহ একজন ‘স্থানীয় সহযোগিতাকারী’কে দিয়ে দেয়া হয়েছিল। তারপর থেকে তারা আর কিছু জানে না।
৬. খাশোগি কনস্যুলেট থেকে বের না হলেও কেন সৌদি মিথ্যা বলেছিল?
খাশোগি অনেকক্ষণ পার হওয়ার পরও কনস্যুলেট থেকে বের না হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন হাতিস। তারপরই তিনি সবাইকে বিষয়টি জানান। কিন্তু সৌদি সরকার সেই প্রথম থেকেই বলে আসছিল জামাল কাশোগি কনস্যুলেটে ঢোকার কিছুক্ষণ পরই পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানও একই কথা বলেছিলেন।
৭. যুবরাজ কেন জানলেন না এ ব্যাপারে?
খাশোগির কপালে কী জুটেছে, এ ব্যাপারে যুবরাজ মোহাম্মদ কিছু জানতেন না- এমনই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে সৌদির বিবৃতিতে। কিন্তু এটা একটা অসম্ভব ব্যাপার। কেননা খাশোগি গুম হওয়ার খবরের পরেই বাদশাহ সালমান তাকে সৌদি সাম্রাজ্যের গোয়েন্দা কর্মকাণ্ড রিভিউ ও আধুনিকীকরণে গঠিত একটি কমিশনের দায়িত্ব দেন।
শুধু তাই নয়, খাশোগি হত্যার কথা স্বীকারের পর এ ঘটনায় যুবরাজের অন্যতম উপদেষ্টা সৌদ আল-কাহতানিকে শনিবার বরখাস্ত করা হয়। মার্কিন কর্মকর্তাদের মতে, আল-কাহতানি এর আগে বেশ কয়েকবার খাশোগিকে সৌদি আরবে ভুলিয়ে ভালিয়ে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন।
শনিবারের চাকরিচ্যুতির পর থেকে আল-কাহতানির গত বছরের একটি টুইটবার্তা ভাইরাল হয়েছে। সেখানে তিনি স্পষ্টভাবেই বলেছেন: ‘আপনাদের কি মনে হয় আমি কারও নির্দেশ ছাড়া নিজের সিদ্ধান্তে কোনো কাজ করার ক্ষমতা রাখি? আমি একজন কর্মচারী এবং বাদশাহ ও যুবরাজের একজন বিশ্বস্ত কার্যনির্বাহী।’
৮. সৌদি সরকারের আটক আর তুর্কি সরকারের সনাক্ত করা ব্যক্তিরা কি একই?
সৌদি সরকারের আটক করা ১৮ জনের পরিচয় এখনো জানা যায়নি। তাছাড়া তুর্কি সরকার যে ১৫ জনকে খাশোগি হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে চিহ্নিত করেছে তারা এই ১৮ জনের মধ্যে আছে কিনা সেটাও স্পষ্ট নয়।
অবশ্য এর আগে সৌদির রাষ্ট্র পরিচালিত চ্যানেল আল-আরাবিয়া দাবি করেছিল, তুরস্ক ১৫ জন সৌদি পর্যটককে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে।
৯. স্বীকারোক্তিতে ১৭ দিন দেরি কেন?
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক জামাল খাশোগি নিখোঁজ হওয়ার ১৭ দিন পর অবশেষে রিয়াদ স্বীকার করল তার মৃত্যুর কথা। উপরিউক্ত বাকি ৮টি প্রশ্নের জবাব যা-ই হোক না কেন, এই প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি সন্দেহের উর্দ্রেক করে: নিখোঁজ হওয়ার পর কেন এতদিন অস্বীকার অস্বীকার খেলা খেলে অবশেষে হত্যার কথা স্বীকার করল সৌদি আরব? তাও আবার এমন একটা গল্প ফেঁদে, যা ক’জনে বিশ্বাস করবে সেটাও আরেক প্রশ্ন!
ইউনিভার্সিটি অব ওটাওয়ার সৌদি আরব বিশেষজ্ঞ টমাস জুনিউ এ ব্যাপারে বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে মূলত সৌদি সরকারের প্রশাসনিক দুর্বলতাই প্রকাশিত হয়েছে। পরিস্থিতিটা যে, গোঁজামিল দেয়া, মানুষ এমন একটা ধারণাও পাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।