চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

খাদ্যে ভেজাল অভিযান: গোঁড়ায় কি গলদ আছে?

জনপ্রিয় একটি অভিযানের নাম হলো খাদ্যে ভেজাল বিরোধী অভিযান। আসছে কোরবানীর ঈদ। কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হবে এই ভেজাল বিরোধী অভিযান।

কখনো ভিন্ন ভিন্ন আবার কখনো একত্রে খাদ্যে ভেজাল রোধে অভিযান চালান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) ও বাংলাদেশ পুলিশ।

দীর্ঘদিন অভিযান চালিয়ে তারা চকলেট থেকে প্রপার্টি প্রায় সবক্ষেত্রেই ভেজালের প্রমাণ তাদের হাতে। এতে দেখা যায়, দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে ভেজালের গণ্ডি।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ভেজাল বিরোধী অভিযানে যারা যান তাদের মধ্যে বা তাদের নিয়োগে ভেজাল নেই তো? কারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে তাদের মাঠে নামাচ্ছি আমরা। তাদের হাতেই নির্ভর কাছে অভিযানের সফলতা, আমাদের নিরাপদ খাদ্য এবং খাদ্য উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ততা।

এসব পরিদর্শক খাবারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ট্রেড লাইসেন্স দেয়া ও নবায়ন, ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ ও তাদের তালিকা তৈরি করছেন। এই পরিদর্শকরাই নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্য তৈরি, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি, পণ্যের মোড়কে মূল্য লেখা না লেখা এসব কাজও করছেন। করছেন জেল জরিমানাও।

ভেজালের ধরনেও এসেছে ভিন্নতা। যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। চকচকে চালের নামে চালেও মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, ইউরিয়া সার, মোম। তাছাড়া সাধারণ মোটা চাল অতিরিক্ত ছাঁটাই করে চিকন করে দেয়া হচ্ছে ধোঁকা। ডালে মেশানো হচ্ছে কাঠের গুঁড়া, ইটের গুঁড়া, বালি ও রং। ভেজাল হচ্ছে লবণও। এতে মেশানো হচ্ছে সিসা, বালি, গুঁড়া পাথর, কাকর ও রং।

হলুদের গুঁড়ার সঙ্গে মিশছে সিসা, ডালের গুঁড়া, কাঠের গুঁড়া, ইটের গুঁড়া, মটরের গুঁড়া, কাপড়ের রং, ক্ষার জাতীয় পদার্থ চুন ও সোডা, চালের কুঁড়া, কাউন ধান ও পচা মরিচের গুঁড়া। আর মরিচের গুঁড়ার সঙ্গে মেশানো হচ্ছে ইটের গুঁড়া, ডালের গুঁড়া, চুন ও সোডা, চালের কুঁড়া, কাউন ধান, পচা মরিচের গুঁড়া, টেক্সটাইলের রং, লোহার মরিচা, আটা, ময়দা ও পচা হলুদ।

আসল ডিমের সঙ্গে বাজারে রয়েছে নকল ডিমও। আবার আসল ডিমও ভেজাল হচ্ছে ক্রোমিয়াম, সিসা ও রংয়ের মিশ্রণে। ধনিয়ার গুঁড়া ভেজাল হচ্ছে কাঠের গুঁড়া, রং, নষ্ট সেমাই, সমিলের কাঠের ভুসি, আটা ও তেজপাতায়।

পোস্তাদানায় মেশানো হচ্ছে সুজি। তাছাড়া বিভিন্ন মশলায় ভুসি, কাঠের গুড়া, বালি ও ইটের গুড়া তো থাকছেই। ভেজাল হচ্ছে তেল জাতীয় তরল খাদ্যপণ্যও। সয়াবিন তেল ভেজাল হচ্ছে রং মেশানো ডাল, ডালডা, অপরিশোধিত পামঅয়েল, ইঞ্জিনের তেল, তিল, গর্জন ও ব্যারনের তেলে। ভেজাল ঘিয়ে পাওয়া গেছে বিভিন্ন রং, সয়াবিন ও পামঅয়েল। তরল দুধ ভেজালে বা

নকল দুধ তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে শ্যাম্পু, সাবান, বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য, ফরমালিন, সাদা পাউডার, বেকিং পাউডার, ছানা, স্টার্চ, মাস্টার্ড অয়েল, ক্যালসিয়াম বাই কার্বনেট, দুধের মতো দেখতে সুগন্ধি।

মধু তৈরি বা ভেজাল হচ্ছে চিনি, স্যাকারিন, পানি, রং ও বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যে। কনডেন্স মিল্ক ভেজাল হচ্ছে চালকুমড়া, পামঅয়েল, ভেজিটেবল অয়েল ও ক্যামিকেলে।

ভেজাল হচ্ছে শিশুখাদ্যও। চকলেটসহ বিভিন্ন শিশু খাদ্য তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে স্যাকারিন, মোম, ট্যালকম পাউডার, পোড়া মবিল, সোডা, নিম্নমানের আটা ও ময়দা এবং বিভিন্ন ধরনের রং ও রাসায়নিক দ্রব্য।

মাছ টাটকা রাখার জন্য ব্যবহার হচ্ছে ফরমালিন। শুঁটকিতে মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর ডিডিটি। বাদ যাচ্ছে না মৌসুমি ফলমূলও। পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ফলমূল হয়ে উঠছে বিষাক্ত। ক্ষতিকর। তরকারি দূষিত করছে জর্দা, রং, কাপড়ের রং ও নানা রকম রাসায়নিক দ্রব্য।

মুখরোচক মিষ্টি জাতীয় পণ্যগুলোও ভেজাল হচ্ছে। পাটালি গুড়ে মেশানো হয় রাসায়নিক দ্রব্য, মিষ্টিতে মিশছে স্টার্চ ও পাউডার। চিনিতে ইউরিয়া। আর দইয়ে মেশানো হচ্ছে টিস্যু পেপার।

কেক, জেলি ও সস তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে কৃত্রিম গন্ধ, রাসায়নিক দ্রব্য ও কাপড়ের রং। এনার্জি ড্রিঙ্কস তৈরি হচ্ছে ক্যাফেইন ও উত্তেজক পদার্থসহ সিলডেনাফিল সাইট্রেট। প্যাকেটজাত জুসে মেশানো হচ্ছে বেঞ্জয়িক এসিড। পাউরুটি, বিস্কুট ইত্যাদিতে ব্যবহার হচ্ছে ছত্রাক, পঁচা ডিম ও উপকরণ এবং বিষাক্ত রং। শরবত, ঠাণ্ডা পানি ও লাচ্ছিতে ব্যবহার হচ্ছে দূষিত পানি, বিষাক্ত রং, দূষিত পানির বরফ।

মিনারেল ওয়াটারের নামে পান করানো হচ্ছে দূষিত পানি ও ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান। লাচ্ছি, জুস ও মিল্ক সেক তৈরি হচ্ছে মাছ হিমায়িত করার বরফ ও দূষিত পানি এবং মিষ্টি কুমড়ায়। কোমল পানীয় তৈরি হচ্ছে চিনি, সাবান ও সেভলন দিয়ে। স্ন্যাক ফুড, জ্যাম, জেলি, আচার ও চাটনি তৈরি হচ্ছে ক্ষতিকর রং ও রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে। আইসক্রিমে মেশানো হচ্ছে কাপড় ও চামড়ার রং এবং দূষিত পানি, পচা ডিম, পচা নারকেল ও ক্যামিকেল।

এ ছাড়া কাঁচা মাংস টাটকা দেখানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে বাসী রক্ত ও রং। জীবন্ত পশুর মাংসও বিষাক্ত হয়ে উঠছে মোটাতাজাকরণের অপকৌশলে।

কোরবানির আগে বা সারা বছর অসাধু ব্যবসায়ীরা গরু মোটা করার জন্য ব্যবহার করছে হরমোন ইনজেকশন, স্টেরয়েড, ডেক্সামেথাসন, ডেকাসন, ডাইক্লোফেন ইনজেকশন, বেটামেথাসন ও পেরিঅ্যাকটিন। লোভী ও অসাধু উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের ভেজাল কারবার থেকে বাদ যায়নি জীবন বাঁচানোর ওষুধও। বিভিন্ন মানের ওষুধের পাশাপাশি ভেজাল তো রয়েছেই। এমনকি পুরো ওষুধই নকল হচ্ছে। এন্টিবায়োটিক তৈরি হচ্ছে স্রেফ আটা ও লবণ দিয়ে।

এটা সত্য বেশী লাভের লোভে পড়ে অনেকেই খাদ্যপণ্যে ভেজাল মেশান। যা আমাদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই এই ভেজাল বিরোধী অভিযানটি এতো জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পাবারই কথা। যেখানে জনস্বার্থ জড়িত সেখানে আপোষের প্রশ্নই আসে না।

কিন্তু কিছুদিন ধরেই প্রশ্ন উঠছে যারা অভিযানে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে কোন কোন কর্মকর্তার ভেজাল পরীক্ষার যোগ্যতা নাই। অর্থাৎ তারা জানেনই না আইসক্রিম কেন ওজনে কম থাকে কিংবা কোন খাবারে কি মাত্রায় কি উপাদান মেশানো থাকলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতির কারণ? পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে অনেকটা আবেগী এবং সাধারণ জ্ঞান দিয়ে কর্মকর্তারা এসব ভেজাল বিরোধী অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

অথচ খাদ্যশিল্প একটি খাত। এ খাতে জড়িয়ে আছেন অসংখ্য উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী এবং শ্রমিক। এ খাতের আয় দিয়ে চলছে লাখ লাখ মানুষের জীবিকা, জীবন। তাই এই খাতকেও টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের, ব্যক্তি স্বার্থেই এ খাতকে বাঁচিয়ে রাখা খুব জরুরি।

তাই মোটেও অবহেলা কিংবা এড়িয়ে যাওয়ার বিষয় নয় এটি। ভেজাল বিরোধী অভিযান অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তারচেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া কর্মকর্তাদের ভেজালমুক্ত করা।

নিরাপদ খাদ্য আইনের ৯ ধারায় বলা আছে:

১) খাদ্য বিষয়ে ন্যুনতম ২৫ (পঁচিশ) বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতা এবং বিশেষায়িত জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন কোন ব্যক্তি চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন।
২) জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি, খাদ্য শিল্প ও খাদ্য উৎপাদন, খাদ্যভোগ ও ভোক্তা অধিকার এবং খাদ্য বিষয়ক আইন ও নীতি বিষয়ে ২০ (বিশ) বৎসরের পেশাগত অভিজ্ঞতা এবং বিস্তৃত বিশেষায়িত জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিগত নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন।

এতো গেলো আইনের কথা। আমরা কি এসব আইন মেনে নিয়োগ চূড়ান্ত করছি?

যদি করে থাকি তাহলে কোন কথা নেই, কিন্তু যদি না করে থাকি তাহলে প্রশ্ন অনেক। কেন না ভেজাল বিরোধী অভিযানের গোঁড়ায় যদি গলদ থাকে তাহলে অভিযান একদিকে তার গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। অন্যদিকে ভেজাল পণ্য খেয়ে বা ব্যবহার করে মানবদেহ হবে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার।

একই সাথে ঝামেলা এড়াতে ক্ষুদ্র বা বৃহৎ ব্যবসায়ীরা তাদের বিনিয়োগ অন্যত্র সরিয়ে নিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের এদিকটাও খেয়াল রাখা উচিত।

তাই এটি নিশ্চিত করতে না পারলে সার্বিকভাবে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। বর্তমানে শাকসবজি, মাছ-মাংস থেকে ফলমূল এমনকি শিশুখাদ্য ও ঔষধে ভেজাল ও রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার বৃদ্ধি জনস্বাস্থ্যের হুমকিতে পরিণত করেছে। যদিও স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে প্রায়ই এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জনসচেতনতা বাড়াচ্ছে কিন্তু এর প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর টনক খুব কমই নড়ছে বলে প্রতীয়মান হয়।

মাঝে মাঝে বাজারগুলোতে ভেজাল বিরোধী পরিদর্শন নাগরিকদের মনকে হাল্কা স্বস্তি দিলেও সেটির কার্যকারিতা নিয়ে জনমনে প্রশ্নও রয়েছে। ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে নানাবিধ দুরারোগ্য ব্যাধি ও জীবনহানির ঘটনা ঘটে।

যদিও সম্প্রতি ভেজাল প্রতিরোধে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন:
১) নিরাপদ খাদ্য আইন- ২০১৩ প্রণয়ন
২) ফরমালিনের অপব্যবহার রোধে ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন
৩) ২০১৩ এর খসড়া প্রণয়ন
৪) বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণে বাজার পরিদর্শন কার্যক্রম জোরদারকরণ
৫) এফবিসিসিআই-এর ব্যবস্থাপনায় ঢাকা মহানগরীসহ বিভিন্ন জেলার মোট ১৮টি কাঁচাবাজারকে ফরমালিনমুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ
৬) জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ সহযোগিতায় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে প্রকল্প গ্রহণ ও জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে একটি স্বতন্ত্র খাদ্য পরীক্ষাগার স্থাপন এবং
৭) মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে খাদ্যে ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনা উল্লেখযোগ্য।

নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ তথা খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে এ সকল উদ্যোগসমূহ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই সন্তোষজনক নয়, কারণ গোড়ায় যদি গলদ থাকে তাহলে অভিযানের সফলতা অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। রোগীরে রোগ সঠিকভাবে চিহ্নিত না হলে যেমন সময়, অর্থ আর শ্রম ব্যর্থ হয়, একইভাবে খাদ্যে ভেজাল বিরোধী অভিযানে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের সকলেরই অভিজ্ঞ হতেই হবে, এর বিকল্প নেই। তা না হলে, লাভ তো নয়ই বরং ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি।

বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ, ১৯৫৯ এ প্রতিটি জেলা ও মহানগরে খাদ্য আদালত স্থাপনের বিধান থাকলেও আজ পর্যন্ত তা করা হয়নি।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)