শক্তিশালী সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে অদম্য সাহসে ঝাঁপিয়ে পড়া তরুণ মুক্তিযোদ্ধা এবং নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের পতন ঘটানো তরুণদের পরবর্তী প্রজন্মের বর্তমান জীবনে যেন ভর করেছে হতাশার কালো মেঘ।
শিক্ষাব্যবস্থায় ত্রুটি আর ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বের হওয়া তরুণদের বেকারত্ব হতাশার মেঘকে আরও ঘন করছে। প্রাণশক্তিতে ভরা তরুণদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে মাদকে, জঙ্গিবাদে।
অথচ জাতি সংঘের উন্নয়ন সংস্থার তথ্য মতে বাংলাদেশ সেইসব ভাগ্যবান দেশের তালিকায় আছে যেসব দেশে বিপুল সংখ্যক কর্মক্ষম তরুণ রয়েছে। কাগুজে ভাষায় এই বাড়তি সুবিধাকে বলা হচ্ছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হচ্ছে সেই অবস্থা যখন একটি দেশের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ বা তার কাছাকাছি সংখ্যক মানুষের বয়স থাকে ১৫ থেকে ৫৯ বছর। কিন্তু আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাবে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ তরুণই নিষ্ক্রিয়।
এই যখন দেশের তরুণদের হাল তখন বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে যুব দিবস। নানা সমস্যায় জর্জরিত সম্ভাবনার দেশের তরুণরাই চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে তুলে ধরেছেন তারুণ্যের সংকট আর উত্তরণের কথা।
এই তরুণদেরই একজন আবরার আদিব। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন শেষ করতে চলা এই তরুণ একজন শখের চলচ্চিত্র নির্মাতা।
প্রায় সবক্ষেত্রে তারুণ্যের সংকট প্রকাশ পেলো তার কথায়। তিনি বলেন,‘ যুবকরা আজ দিবসে আটকে নেই, আটকে আছে হতাশায়। শিক্ষা থেকে রাজনীতি, প্রেম থেকে চাকরি, সবক্ষেত্রেই আসলে হতাশার বিচরণ। নিজের ভেতরে প্রেরণা সৃষ্টির পরিবেশ কিংবা আবেশের অভাব চারপাশে।’
শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সমাজ সবজায়গায় পরিবর্তন চান এই তরুণ। তবে সবার আগে নিজেকে পরিবর্তন এবং নিজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।
নিজে তরুণ তাই মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এসআইএসটি) থেকে সদ্য পাস করা মার্জিয়া প্রভা বিশ্বাস রাখেন তারুণ্যের শক্তিতে। তবে তার কথাতেও স্পষ্ট যে তারুণ্যের প্রগতির শক্তিকে শেকল পড়াচ্ছে অশুভ শক্তি।
প্রভা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন,‘আমার দেশের তরুণরা উদ্যোমী, ভীষণ পজিটিভ। চাইলে যেকোন অচলায়তন তারা ভাঙতে পারে। মানে তারা চাইলে যে কিছু পারে না এটা আমি মনেই করি না। কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে তারা চাইছে না অনেকেই। আমার দেশের ধর্মীয় উগ্রবাদ গড়ে উঠার ক্ষেত্রে টার্গেট এই তরুণরাই। আজ যে জঙ্গি বাহিনীতে তরুণদের দেখছি এরা কিন্তু সম্ভাবনাময় ছিলো। কিন্তু এদের আমরা ইতিবাচক পথে কাজে লাগাতে পারিনি। এ ব্যর্থতা আমাদের।’
আবার প্রচলিত পদ্ধতির চাকুরিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো উঠে এসেছে তার কথায়।
তিনি বলেন,‘আমাদের এক ঘেয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা মাথায় নিয়ে লক্ষ লক্ষ তরুণ প্রতিবছর গ্র্যাজুয়েট হচ্ছে। অথচ তাদের বিপরীতে চাকরি এক লক্ষ ও না। ব্যবসায় তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে আছে বিদেশী কোম্পানিরা।আমরা এখনো উদ্যোক্তা বান্ধব পলিসি করতে পারি না। আমরা কর্পোরেটদের ছাড় দিয়ে দিয়েছি অনেক বেশি। উচিত ছিল বাইরের কোম্পানিদের দেশের যুবকদের পার্টনারশিপে কাজ করতে বাধ্য করা। এই এতো কিছুর পরেও প্রচুর উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছে। ইন্টারনেটকে কাজে লাগিয়ে ই কমার্সে আসছে অনেক অনেক তরুণ।
ভলান্টিয়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল নিয়ে নিজ জায়গা থেকে কাজ করছে। আইটিতে উন্নত হচ্ছে। ফ্রিল্যান্সিং এ কাজ করে বিদেশী টাকা আনছে বাংলাদেশে। এখন বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশী এই তরুণরা। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টে এ আছি আমরা। এই সময়ে যদি এই তারুণ্য শক্তিকে আমরা কাজে লাগাতে পারি আমার দেশ পৌঁছে যাবে উন্নতির শিখরে। রাষ্ট্রই পারে তরুণদের কাজ করার জন্য দেশীয় নানা সিস্টেমকে সহজ করতে। রাষ্ট্রই পারবে জঙ্গিবাদ দমন করতে। তৃণমূল থেকে কাজ শুরুর করার জন্য এই উদ্যমী তরুণদের কাজে লাগাতে পারে রাষ্ট্র।’
তবে শুধু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ যথেষ্ট নয় তরুণদের নিজেদেরই নিজের জন্য ভাবনা বদলাতে হবে বলে মনে করেন তরুণ লেখক ফরহাদ। ফরহাদ নাইয়া নামে লিটল ম্যাগাজিনে লেখালেখি করেন তিনি।
তিনি বলেন,‘সমস্যা তারুণ্যে নয় সমস্যাটা হলো সময়ের বিচারিক মানদণ্ডে। আমাদের প্রজন্ম অতিমাত্রায় হতাশা প্রবণ আর কর্মবিমুখ। তারা চিন্তাভাবনা করা ছেড়ে দিয়েছে । তারা নিজেদের একজন উদ্যোক্তা হিসেব ভাবতে পারেনা, নতুন কিছু করার পরিবর্তে আমরা কেবল প্রভুভক্ত দাসের জীবন খুঁজছি।শিক্ষিত তরুণদের মধ্য এই প্রবণতা বেশি । কর্মক্ষেত্র হিসেব তারা কেবল সরকারি আমলা, ব্যাংকার হতে চায়। এই ক্ষয়িষ্ণু তারুণ্যকে বাঁচানোর রাস্তা দেশিয় শিল্প প্রতিষ্ঠান গুলোকে শক্তিশালি করা । নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরিতে তাদের প্রমোট করা ।’
ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোর ইতিবাচক সম্ভাবনার খোলা দরজার বদলে দেশের তরুণদের মধ্যে হতাশা প্রবেশ করতে দেখছেন বলে জানান অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী তরুণ সামিউর রহমান।
দেশে উচ্চ শিক্ষার পর অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির এই শিক্ষার্থী বলেন,‘আমরা অনলাইনে অন্যের অগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে মাথা ঘামাই। নিজে কিছু করার চিন্তা করি না। দেশে বাইরে এসে দেখলাম এখানকার তরুণরা নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে অন্যের বিষয়ে অযথা নাক গলিয়ে সময় নষ্ট করে না। প্রথম যখন বিদেশের মাটিতে এলাম মনে হলো যেনো মিস্টার বিনের শুরুর দৃশ্যের মতো একটা গোল আলোর নিচে এসে পড়েছি। আমার মনে হয় দেশে এখন যে অনলাইন আসক্ত প্রজন্ম আছে তাদেরকে বাবা-মায়ের টাকায় না চলতে দিলেই ওরা বুঝে যাবে বাস্তব কত কঠিন।’
দেশে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা সৃজনশীল কোনো পেশাকেই সম্মানের জায়গা দিতে পারেনি বলে অভিযোগের সুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী রায়হান রনির কণ্ঠে।
তিনি বলেন,‘সারা পৃথিবীতে এখন ভালো ড্রইং জানা, ভালো অ্যানিমেটর, ক্রিয়েটিভ রাইটার, ভালো পেইন্টারের ব্যাপক চাহিদা ।বাংলাদেশের যে সব উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সেখানে আজও সনাতন পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা হয় । আমেরিকার মানুষের হেয়ার স্টাইল, ফ্যাশন, খাবার দাবার ইত্যাদি কপি করতে পারলেও, তাদের শিক্ষা পদ্ধতি কপি করতে পারি না আমরা ।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী শাহনাজ পারভীন মনে করেন ইতিহাস গড়া বাংলাদেশের তরুণদের বর্তমান প্রজন্মের নৈতিকতার ভিত্তিও বেশ দুর্বল।
তিনি বলেন,‘ ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা তরুণদের কে গবেষণা ও সৃজনশীল কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। শিক্ষাব্যবস্থায় মূল্যবোধের চর্চা হারিয়ে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি অস্থিতিশীল এবং পরজীবী রাজনীতিও তরুণদের নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। যে বয়সে তরুণদের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবার কথা সে বয়েসে তা বেঁকে যাচ্ছে। তরুণদের মধ্যে ঐক্যের অভাবও আজ লক্ষ্যণীয়। সামাজিক মাধ্যম গুলোতে প্রায়-ই গঠনমূলক কোন প্রতিবাদে তারা অংশ নিতে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হানাহানি পর্যন্ত গড়ায়।’
এতো এতো হতাশা নেতিবাচক পরিস্থিতিতেও প্রযুক্তি মহাসড়কে পাল্লা দেয়া তরুণরা সমৃদ্ধির গতি আনছে বলে জানান প্রযুক্তি সংবাদকর্মী তুসিন আহমেদ।
তিনি বলেন,‘ প্রযুক্তি ব্যবহারের তরুণরা এগিয়ে আছে। এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে অনেক তরুণ ঘরে বসেই বিদেশী মূদ্রা আয় করছে। তবে অনেক তরুণ প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে জানে না। অথচ এই সময়টা যে দেশ যত বেশি প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকবে সে দেশ ততো দ্রুত উন্নয়ন করবে। আর আমাদের দেশে তরুণদের সংখ্যা বেশি। তাদের সঠিক প্রযুক্তি শিক্ষার মাধ্যমে সম্ভবনায় একটি দ্বার খুলে যাবে।’