চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

‘ক্রেডিট কার্ডে গলা কাটা সুদ নিতেই নীতিমালায় পরিবর্তন’

ক্রেডিট কার্ডে অতিরিক্ত ঝুঁকি রয়েছে দাবি করে ব্যাংকগুলো বলছে, এই ঋণের পরিমাণ কম হলেও অনেক গ্রাহক সময়মত পরিশোধ করে না। কেউ কেউ খেলাপী হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি, তাই সুদও বেশি। সেই কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকে আপত্তি জানানো হয়। তবে ব্যাংকগুলোর এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে গ্রাহকরা বলছেন, ক্রেডিট কার্ডের সেবাদানকারী গুটি কয়েক ব্যাংকের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেদের অবস্থান থেকে সরে গেছে। এর ফলে গ্রাহকদের গলাকাটার সুযোগ দেয় হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানকে।

দীর্ঘদিন ধরে ক্রেডিট কার্ডে অতিরিক্ত সুদ হার নেয়া হচ্ছে-গ্রাহকদের এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গত ১১ মে প্রথম বারের মতো ক্রেডিট কার্ড নীতিমালা জারি করে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুদের হার বেঁধে দিয়ে তাতে বলা হয়, ভোক্তা ঋণের সুদের হারের চেয়ে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ বেশি সুদ ক্রেডিট কার্ডে নিতে পারবে। বর্তমানে অনেক ব্যাংক ৩০ শতাংশেরও বেশি সুদ নিচ্ছে।

কিন্তু নীতিমালাটি কার্যকরের আগেই তাতে পরিবর্তন এনে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে বলে বৃহস্পতিবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়, নীতিমালা বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলো কিছু কিছু প্রায়োগিক ও কারিগরি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে নীতিমালার কিছু ধারা সংশোধন করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর চাপেই ক্রেডিট কার্ড নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর ফলে গলাকাটা সুদে ব্যাংকগুলোর পকেট ভারি হবে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ গ্রাহকরা।

দি সিটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী সোহেল হাসান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, এই চারটি ব্যাংকের আপত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পিছু হাঁটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। গ্রাহকের কথা চিন্তা না করে ব্যাংকগুলোকে গলাকাটা সুদ নিতে আরো সুযোগ দেয়া হয়েছে।

এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশও (ক্যাব)। সংস্থাটি বলছে, ক্রেডিট কার্ডে নামে বেনামে বিভিন্ন হিডেন চার্জ যুক্ত করে সাধারণ ঋণের দ্বিগুণ সুদ আদায় করা হচ্ছে। ভোক্তাদের হয়রানির বিষয়ে প্রতিনিয়ত অভিযোগ করা হলেও সেগুলো আমলে না নিয়ে জনগণের পকেট কাটছে তারা। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক ভোক্তাদের স্বার্থ না দেখে গুটিকয়েক ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে নীতিমালায় পরিবর্তন এনেছে। শনিবার এক বিবৃতিতে সংস্থাটি অবিলম্বে নতুন নীতিমালা বাতিল করার পাশাপাশি সুদের হার কমানোর দাবি জানায়।

নতুন সুদ হার নিয়ে ১১ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা জারির পর বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানায় বেসরকারি সিটি, ব্র্যাক ও ইস্টার্ন ব্যাংক এবং বিদেশি স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। ক্রেডিট কার্ডে বিনা জামানতে ঋণের ঝুঁকির বিষয়টি তুলে ধরে সবচেয়ে বেশি গ্রাহক ধরে রাখা এই চার ব্যাংক বলছে, ক্রেডিট কার্ডে ঝুঁকি অনেক বেশি। গ্রাহক ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করে না। এদের বিরুদ্ধে মামলাও করা যায় না। তাছাড়া বিনিয়োগও বেশি করতে হয়। ফলে সুদ হার কমালে ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বর্তমানে ক্রেডিট আছে এমন ব্যাংকগুলোতে ভোক্তা ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। এর সাথে আরো ৫ শতাংশ যোগ করলে সর্বোচ্চ সুদহার হত ১৭ থেকে ২০ শতাংশ হওয়ার কথা।

কিন্তু এসএমইসহ কিছু ঋণে ২০ শতাংশ পর্যন্তও সুদ নেয় ব্যাংকগুলো; সেক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ডে সুদের হার তার সঙ্গে ৫ যোগ হয়ে ২৫ শতাংশ নেওয়ার সুযোগ তৈরি হল তাদের জন্য।

এ বিষয়ে ইস্টার্ণ ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তা জিয়াউল করিম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ক্রেডিট কার্ডের সুদ হার যে শুধু বাংলাদেশে বেশি তা নয়, উন্নত বিশ্বে যেমন ভারত, কানাডাসহ অন্যান্য দেশেও সুদ হার ২২ থেকে ২৩ শতাংশ। তবে ওই সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ক্রেডিট কার্ডে বিনিয়োগ করতে হয় বেশি। অন্যদিকে ঝুঁকিও বেশি। তাই সুদ বেশি নিতে হয়। সেই জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিবেচনার অনুরোধ করা হয়।

ক্রেডিট কার্ডের সেবা দিতে গিয়ে কিছুটা কারিগরি সমস্যা রয়েছে বলে ব্যাংকগুলো বলছে, এটা মূলত কি ধরনের সমস্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তাই বলা যাচ্ছে না।

ক্রেডিট কার্ডের ঋণে নিরাপত্তা কম জানিয়ে দি সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চীপ রিস্ক অফিসার ফারুক এম. আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, যদিও ক্রেডিট কার্ডে ঋণের পরিমাণ কম তবুও অনেকেই ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করে না। খেলাপী হয়ে যায়। এই ঋণের বিরুদ্ধে মামলাও করা যায় না। ব্যাংক অনেক ঝুঁকি নিয়েই ব্যবসা করে। এছাড়া ক্রেডিট আদায় করতে অতিরিক্ত লোকবল নিয়োগ দিতে হয়। এতে ব্যয় বেড়ে যায়।

গ্রাহকদের অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, তিনি বলে আসলে ব্যাংকগুলোকে কারিগরি সমস্যা কেটে উঠা ও তাদের সক্ষমতা আরো বাড়ানোর সুযোগ দিতেই সময় বাড়ানো হয়েছে।

এছাড়া কার্ড সম্পর্কে ব্যবহারকারিদের আরো সচেতন হতে ও কার্ডের ব্যবহার ভালভাবে জানার জন্য সময় দেয়া হলো। এর বাইরে অন্য কোনো কারণ নাই বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের এই শীর্ষ কর্মকর্তা।

ভোক্তা ঋণ বা কনজিউমার লোন বলতে বুঝায়, সাধারনত গৃহঋণ, মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারসহ ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি কেনা বাবদ, চিকিৎসা এবং বিয়েসহ ব্যক্তিগত প্রয়োজনের পাশাপাশি গৃহস্থালি পণ্য কেনার জন্য প্রদত্ত ঋণ। এর পরিমাণ হতে পারে ১০ হাজার থেকে ১ কোটি টাকার বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তফসিলভুক্ত ৫৭ টি ব্যাংকের মধ্যে ৩০টি বর্তমানে ক্রেডিট কার্ডে ঋণ সুবিধা দিয়ে আসছে।