বাবার পরিচয় জানেন না ক্রিস গার্ডনার। চরম দারিদ্র্যের পীড়ন, মদকাসক্ত সৎ বাবার অত্যাচার ছিলো শৈশবের নিত্যসঙ্গী। মা বিটি জিন সঙ্গীকে হত্যার চেষ্টা করায় ফস্টার হোমেও কাটে কিছু সময়। কিন্তু এমন করুণ-অসহায়ত্বে বেড়ে উঠা গার্ডনারের জীবন কিন্তু সেই অন্ধকার ঘুপচিতে আটকে থাকেনি। কারণ তিনি আলোকে আলিঙ্গণ করেছিলেন। অসাধারণ অনুপ্রেরণার উৎস এই ব্যক্তির জীবন দর্শন: “আমি আলোকে বাছাই করেছি, আমার মায়ের থেকে এবং তাদের থেকে যাদের সাথে আমার বিন্দুমাত্র রক্তের সম্পর্ক নেই, এবং আমি তা আলিঙ্গণ করেছি।” তাই বিপুল বৈভবের জীবনও অর্জন করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের উন্সকনসিন স্টেটের মিলাওকিতে জন্ম নেওয়া গার্ডনার হাইস্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট করার পর ইউএস নেভিতে চার বছর কাটান। সেখান থেকে ১৯৭৪ সালে বেরিয়ে তিনি সানফ্রান্সিকো চলে এসে মেডিকেল ইকুইপমেন্ট বিক্রির কাজ শুরু করেন। সান ফ্রান্সিসকোতে একটি বছর গৃহহীন থাকা গার্ডনার তার শিশু সন্তানকে নিয়ে পাবলিক টয়লেটের রুক্ষ ফ্লোরেও ঘুমিয়েছেন।
স্টক ব্রোকারেজে স্বল্প বেতনভোগী প্রশিক্ষণ প্রকল্পে কাজ করে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করার সামর্থ্য ছিলো না। সঙ্গীর সাথে আলাদা হয়ে একমাত্র সন্তানকে নিয়ে তাই রাত কাটাতেন কখনও রেলওয়ে স্টেশনে, পার্কে, চার্চের আশ্রয়ে, কর্মস্থল ফাঁকা হলে তার ডেস্কের নিচে। শিশু সন্তানকে ডে নার্সারিতে রেখে কাজে যেতে হতো তাকে। স্বল্প উপার্জনের অনেকটাই চলে যেতো এর পেছনে। ক্রিসের সংগ্রামমুখর এই সময়টা ১৯৮০ দশকের, বয়স ২৭।
ক্রিসের জীবনটা আমুল পাল্টে যায় যখন তিনি স্টকব্রোকার বব ব্রিজের দেখা পান। লাল ফেরারি গাড়ি পার্ক করতে দেখা ববের পেশা সম্পর্কে জানতে চেয়ে এতেই আগ্রহী হয়ে উঠেন তিনি। আর ক্রিসকে ইন্টার্নশিপের জন্য ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থাও করে দেন বব।
তবে ইন্টারভিউ দেওয়ার আগ মুহুর্তে অপ্রত্যাশাতিক দুর্ঘটনার শিকার হন ক্রিস। আগের দিন পার্কিং টিকেটের টাকা পরিশোধ না করায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জেলেও থাকতে হয়। তবে কোনমতে ইন্টারভিউ বোর্ডে উপস্থিত হতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। গ্রেপ্তারের সময়কার নোংরা পোশাকে থাকলেও তার দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা এবং উদ্দিপনার জোরে কাজটিও পেয়ে যান। অসংখ্য প্রতিকূলতার মাঝেও চাকরীতে সফল হন তিনি। স্টক এবং শেয়ার বিক্রিতে সহজাত প্রতিভায় প্রশিক্ষণ শেষে ডিন উইটার রেইনল্ডস (ডিডাব্লিউআর) তাকে নিয়োগ দেয়।
খুব দ্রুতই ক্যারিয়ারের চমকপ্রদ সাফল্য পেতে থাকেন তিনি। ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বিনিয়োগ ফার্ম ‘গার্ডনার রিচ’।
তবে ২০১২ সালে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে স্ত্রীর মৃত্য তার জীবন পরিবর্তন করে। তাই তিন দশক আর্থিকখাতে সফল সময় কাটিয়ে তিনি তার ক্যারিয়ারে পরিবর্তন আনেন। গার্ডনারের বর্তমান বয়স ৬২, তার সম্পদের পরিমাণ ৬০ মিলিয়ন ইউএস ডলার। লেখক এবং মটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ান। গৃহহীনদের জন্য দাতব্য সংস্থা এবং নারী প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে কাজ করা বেশকয়েকটি সংস্থার পৃষ্ঠপোষক তিনি।
বিবিসি-কে এক সাক্ষাৎকারে ক্রিস বলেন, তিনি কিছুই পরিবর্তন করেননি। বলেন, “শৈশবে আমি কষ্টের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি বলে আমার সন্তানরা সেই পরিস্থিতিতে পড়েনি। ৫ বছর বয়সেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমার সন্তানরা জানবে তাদের বাবার পরিচয়। ভাগ্য আমার সহায় হয় কারণ আমি সঠিক ছিলাম।”
দারিদ্র্য পীড়িত মা-কে দেখেন অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে। তিনি বলেন, আমার মা ছিলেন সেইসব সেকেলে মায়েদের একজন যিনি প্রতিদিনিই আমাকে বলতো তুমি যা চাও তাই করতে পারবে। এবং আমি তা শতভাগ বিশ্বাস করতাম।
জীবন সংগ্রামে নিরন্তর লড়াই আর সফলতার এই গল্প নিয়ে ২০০৬ সালে নির্মিত হয় চলচ্চিত্র ‘পার্সুইট অব হ্যাপিনেস’। যা ক্রিস গার্ডনারের আত্মজীবনী একই নামের বইয়ের কাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত। উইল স্মিথের অনবদ্য অভিনয়ে যা নিঃসন্দেহে হলিউডের এক সেরা সৃষ্টি। সেলুলয়েডের ফিতায় গার্ডনারকে অসাধারণভাবে উপস্থাপনের জন্য অস্কার মনোনয়নও পেয়েছিলেন স্মিথ। সিনেমাটিতে সন্তানের ভূমিকায় অভিনয় করেন উইল স্মিথের ছেলে জ্যাডেন স্মিথ।