প্রবাসী দুই বাংলাদেশি নারীর টুইটকে কেন্দ্র করে নাকি বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের সফর পিছিয়েছে! বিলাতবাসিনী ওই দুই নারীর টুইটে প্রবাসী ব্লগারদের একটি টার্গেট তালিকা স্থান পায়! সেটি দেখেই নাকি গার্ডিয়ান বিষয়টি নিয়ে রিপোর্ট করে! এরপর ভয়ে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ সফর পিছিয়ে দেয়! এখন বাংলাদেশের গোয়েন্দারা দেশে ওই দুই প্রবাসীর পরিবারের খোঁজ নেবেন! তাদের খোঁজ নিতে লন্ডন যাবেন! তাদের সঙ্গে বিদেশি গোয়েন্দাদের সম্পর্ক আছে কীনা তা খুঁজে বের করবেন! এমন একটি গোয়েন্দা গল্প ছাপা হয়েছে দেশের মিডিয়ায়!
ফেসবুকে এর লিংকটি পড়ে হাসি সামাল দিতে হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া ট্যুর পিছিয়েছে নিরাপত্তার শংকায় । এখন দক্ষিণ আফ্রিকার নারী দল আসবেনা। বাংলাদেশের ক্রিকেট পড়েছে চরম অনিশ্চয়তার মুখে। এরমাঝে নতুন উপসর্গ যোগ হয়েছে টার্গেট করে বিদেশি নাগরিক খুন! এতে করে বিদেশে যে বার্তাটি গেছে তাহলো বাংলাদেশ বিদেশিদের জন্য নিরাপদ দেশ না!
ডিম আগে না মুরগি আগে’ বিতর্কের মুখে বাংলাদেশ আইএস আছে কী নেই এ বিতর্কে কর্তা ব্যক্তিরা ব্যস্ত! আইএস খোঁজার দরকার নেই, কারা বিদেশি মারছে তাদের খুঁজে বের করুন। গোয়েন্দা গল্প না ছড়িয়ে দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি করে অস্ট্রেলিয়া টিমকে ফিরিয়ে আনুন দ্রুত। নইলে কিন্তু বাংলাদেশে নতুন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ হবার সম্ভাবনা ঝুলে যাবে।
বিশ্বাস করতে চাই বাংলাদেশের গোয়েন্দারা যথেষ্ট মেধাবী। শুধু সমস্যা হলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো তারা আগেভাগে টের পান না! বিডিআর বিদ্রোহ টের পাননি! একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস টের পাননি! সবশেষ টের পাননি টার্গেট করে বিদেশি হত্যার পরিকল্পনার বিষয়টি!
ঢাকার উদ্দেশে ফ্লাই করা পিছালেও দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি সরেজমিন দেখতে অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা টিম গেলো! কিন্তু স্পর্শকাতর ওই সময়টাতেও গুলশানের নিরাপত্তা জোরদার তারা করলেন ইতালিয় নাগরিক খুন হবার পর! বিব্রতকর ওই ঘটনার পর আমেরিকা-ব্রিটেন তাদের নাগরিকদের সতর্ক করতে রেড এলার্ট জারি করে! এরপর কী আর অস্ট্রেলিয়ার ট্যুর হয়?
অস্ট্রেলিয়া ট্যুর বাঁচাতে বাংলাদেশের আন্তরিক নানা উদ্যোগ দেশটির সফররত নিরাপত্তা দলকে সন্তুষ্ট করেছিল। কিন্তু ওই সময়ে ইতালির নাগরিক হত্যার ঘটনা, এরপর আবার মার্কিন-ব্রিটিশ রেড এলার্ট পন্ড করে দেয় সব আয়োজন! অস্ট্রেলিয়া দেশটাকেতো ভেতর থেকে চিনিজানি। অন্তত ওই অবস্থায় যদি ক্রিকেট দল সফরে যেতো, অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া তাদের সার্ফ এক্সেল দিয়ে ধুয়ে দিতোনা! আমাদের দলকে কি আমরা পাকিস্তানে যেতে দেই?
বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার খুনের ঘটনা ঘটছে। নিরাপত্তার সমস্যায় ব্লগার পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ তাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলছে! অস্ট্রেলিয়া সহ বিশ্ব মিডিয়ায় এসব কি ছাপা হয়নি? এখানে মাল্টিমিডিয়ার ক্লাসে ছাত্রদের শেখানো হয় কিভাবে ব্লগ তৈরি করতে, লিখতে, পোষ্ট করতে হয়। সারা পৃথিবীতে ব্লগ মানে হচ্ছে মুক্তচিন্তার মানুষের মত প্রকাশের শক্তিশালী মাধ্যম। আস্তিক-নাস্তিক, সামরিক-বেসামরিক কোন ধারার ব্লগ নেই? কিন্তু বাংলাদেশের পন্ডিত রাজনীতক, সরকারি-বেসরকারি নীতিনির্ধারক, পুলিশ-মোল্লাদের সিংহভাগের কাছে ব্লগ-ব্লগার মানেই যেন কিম্ভূতকিমাকার খারা কিছু! দেশের সব নষ্টের মূল দূর্নীতিবাজ-ঘুষখোর-চাঁদাবাজ না, ব্লগার!
এক টকশোতে একবার শুনছিলাম, বিশিষ্ট এক আঁতেল (!) বরিশাইল্যা উচ্চারনে বলছিলেন, ‘আমিতো আমার ছেলেকে বলগ লিখতে দেবোনা’! কোন একটি ব্লগের কোন লেখা পছন্দ না হলে পাল্টা লিখে জবাব দেয়া হচ্ছে সভ্য জগতের নিয়ম। কিন্তু আপনি লিখতে পারেন না বলে আরেকজনের গলা কাটেন! এটা অসভ্য আচরন ছাড়া কি?
ব্লগে লিখে স্বাধীন মতপ্রকাশের কারনে বাংলাদেশে ব্লগারদের গলা কাটা হচ্ছে এ খবর যখন বিদেশি মিডিয়াতেও যাচ্ছে তখন দেশটির, দেশটির আইনের শাসন, মানুষজন, নেতাদের সম্পর্কে কি ধারনা হচ্ছে সভ্য বিশ্বের? জন্মভূমিকে অনিরাপদ মনে করায় একেরপর এক ব্লগার দেশ ছাড়ছেন! তারা দেশটি সম্পর্কে নানা কথা বলছেন বিদেশি মিডিয়ায়!
যারা এখনো দেশত্যাগের লাইনে আছেন তারা দেশটি সম্পর্কে তাদের আবেদনে কী লিখেছেন বা এসব আবেদনে কী লেখা হয়, এ নিয়ে দেশীয় কর্তাব্যক্তি, গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষের কোন ধারনা আছে কী? কাজেই দেশটাকে সব মানুষের কাছে নিরাপদ করুন। আসল কাজ বাদ নিয়ে নফল নিয়ে ব্যস্ততা তথা টুইটারে কে কি লিখেছে না লিখেছে এসব নিয়ে পেরেশানির গোয়েন্দা গল্প ছড়িয়ে লোক হাসানোর দরকার নেই।
আর অস্ট্রেলিয়া ট্যুর কেন পিছালো তা অস্ট্রেলিয়ার কাছে জানতে না চেয়ে টুইটারের পোষ্ট খুঁজতে হবে কেন? অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেতো বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে। ঢাকায় অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশন আছে, হাইকমিশনার আছেন। অস্ট্রেলিয়া দলের সফর নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলো দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু সবাই মিলে ধুয়েমুছে দিলো ক্রিকেট টিমকে! বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি একবারও এখন অবধি ঢাকার অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনারকে ডেকে জানতে চেয়েছে কিসের ভিত্তিতে তারা সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল?
কিছুদিন আগে বাংলাদেশ পুলিশের আইজি অস্ট্রেলিয়া এসে এদেশের পুলিশের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এরমানে দু’দেশের পুলিশ বাহিনীর মধ্যেও এখন ওই রকমের একটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশের পুলিশের পক্ষ থেকেও কী এখন অবধি অস্ট্রেলিয়ার পুলিশের কাছে এ নিয়ে কোন তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে? এরাতো ই-মেইল করলেও ভদ্রতা করে জবাব দেয়। কাজেই আসল কাজ বাদ দিয়ে নকল নিয়ে ছুটাছুটি আর কতো? আমার ধারনা পরপর দু’জন বিদেশি নাগরিক খুনের ঘটনায় সরকার-পুলিশ নিজেরাই একটি শেকি অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে! তারা এসব ঘটনার কুলকিনারা করতে পারছেন না। এবং জানেন এসব ঘটনার কুলকিনারা ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি করা কঠিন।
এরমাঝে বিজেএমইএ’র সঙ্গে বায়ারদের একটা বৈঠকও পিছিয়েছে! অস্ট্রেলিয়ার পর পিছিয়েছে প্রোটিয়াস নারী দলের সফর! এ অবস্থায় অস্ট্রেলিয়ার ফুটবল টিমও ফিরতি খেলতে বাংলাদেশ আসবে না। বিদেশি নাগরিক খুন ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াতকে ইঙ্গিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমান থাকলে কালপ্রিটদের ধরুন। নতুবা খামোখা এ নিয়ে রাজনীতি করবেন না প্রিয় প্রধানমন্ত্রী।
এর আগে একাধিক লেখায় আমরা নিরাপত্তা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ভিতরের-বাইরের নানা সমস্যা নিয়ে লিখেছি। আইএস যুদ্ধে জড়ানোর পর কাঁচা কথায় দেশেবিদেশে এরা মুসলমানদের ভয় পায়! পনের বছর বয়সী একটা মুসলমান ছেলে অবিশ্বাস্য কায়দায় এদেশের পুলিশ সদর দফতরের সামনে গুলি চালিয়ে একজনকে হত্যা করেছে! দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে আইএস এর পক্ষে যুদ্ধ করছে দুই শতাধিক অস্ট্রেলিয়ান মুসলিম! অস্ট্রেলিয়ার বিমান হামলায় সিরিয়া-ইরাকে যারা মারা যাচ্ছে তারাও মুসলিম।
এরজন্যে পালটা প্রতিশোধের আশংকায় তারা এখন দেশেবিদেশে মুসলমানদের ভয় পায়! তার দেশে মানুষ কম থাকায় নিরাপত্তার চেষ্টাটি তারা যেভাবে করতে পারে বাংলাদেশের মতো জনবহুল মুসলিম প্রধান দেশে সেটি পারবেনা হয়তো এমন আশংকা তাদের কোন কারনে হয়েছিল। আর আমাদের নিজেদেরতো সমস্যার শেষ নেই! নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গে জুড়ি নেই আমাদের! দুনিয়ার আর কোন দেশে এমন বিদেশিদের কাছে দল বেঁধে বিচার দিতে যাওয়া হয়?
অনেকে বলার চেষ্টা করেন ভারতেওতো জঙ্গী আছে, সেখানে পার্লামেন্ট ভবনেও জঙ্গী হামলা হয়েছে। কিন্তু ভারতের কোন নাগরিক বা রাজনীতিক কি দেশের বিরুদ্ধে বিদেশিদের কাছে বিচার দিতে যাবেন? সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর যত সমস্যা থাকুক জাতীয় ইস্যুতে মোদী তাকে বৈঠকে ডাকবেন আর সোনিয়া গান্ধীও সেখানে যাবেন। আর বিদেশিদের চোখে ভারত কোন মুসলিম রাষ্ট্রও নয়। কাজেই বিদেশিদের চিন্তায় ভারতের সমান নয় বাংলাদেশ।
এখানে এতকিছু লেখার কারন আমরা চাই অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের একটি ডায়লগ শুরু হোক এবং তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে। এখন উদ্যোগ নিলেই যে অস্ট্রেলিয়া দলের শিডিউল পাওয়া যাবে তা নয়। কিন্তু অচলায়তনটি দ্রুত ভাঙ্গার উদ্যোগ জরুরি। কারন আমাদের ধারনা অস্ট্রেলিয়া টিমকে আস্থায় এনে তাদের বাংলাদেশে না আনা অবধি বাংলাদেশে নতুন কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ হবার সম্ভাবনা কম। প্রোটিয়াস নারী দলের না আসার খবর এর ইঙ্গিত মাত্র। কাজেই আর দেরি নয়। বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাতারে চলে যাক এটি কাম্য নয় কারো। দেশের বিকাশমান ক্রিকেটের আকাশে যে কালো মেঘ জমেছে তা সরাতে দ্রুত উদ্যোগ চাই।