খেলাধুলার জগতে তখন চ্যাম্পিয়নশীপ আয়োজনের রমরমা অবস্থা। ফুটবল, আইস হকি, টেবিল-টেনিসের বিশ্বকাপ আগেই শুরু হয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই ভলিবল, মোটরসাইকেল, ব্যাডমিন্টন, বাস্কেটবল, রাগবির মতো খেলাগুলো নিজ নিজ উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী টুর্নামেন্ট আয়োজনের বন্দোবস্ত সেরে ফেলেছে।
কিন্তু বিশ্বের প্রথম সুগঠিত খেলা ক্রিকেট তখনও দৃশ্যপটে নেই। ১৯৭৩ সালে আইসিসি আয়োজিত প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়নশীপ হল বটে, তবে সেটা ছেলেদের নয়। মেয়েদের!
১৯৭৩ সালে ব্রিটিশ রাজকুমারী অ্যানের হাত ধরে ওমেন্স ট্রফির উদ্বোধন। তারও তিনদিন আগে এক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেয়া হল, পুরুষদের জন্যও আয়োজন করা হবে একটি বিশ্বকাপ। হবে দুই গ্রীষ্মের পর। বিশ্বকাপ হবে ৬০ ওভারের। খেলবে টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলো।
কিন্তু আয়োজন করতে চাইলেই তো হবে না। লাগবে উদ্ভাবনী প্রচারণা, চাই পৃষ্ঠপোষকতাও। এসব ভাবনায় যখন ঘাম ছুটে যাওয়ার অবস্থা আয়োজকদের, ঠিক তখনই এগিয়ে এল প্রডেন্সিয়াল অ্যাসুরেন্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি।
১৯৭২ সাল থেকেই ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের পৃষ্ঠপোষকতার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য ১ লাখ পাউন্ডের একটি চেক পেয়ে গেলেন আয়োজকরা। শর্ত শুধু একটাই, পৃষ্ঠপোষকের নামেই হতে হবে আয়োজন।
আয়োজনের আগে সিদ্ধান্ত হয় বিশ্বকাপ থেকে ১০ শতাংশ হারে লাভের ভাগ পাবে আয়োজক দেশ ও অংশগ্রহণকারী সাত দল। ৭.৫ শতাংশ ব্যয় করা হবে সহযোগী দেশগুলোর জন্য। আর ক্রিকেটকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে কোচিংবাবদ খরচ হবে লভ্যাংশের ৩৭.৫ ভাগ।
সিদ্ধান্ত এল ইংল্যান্ডেই বসবে প্রথম বিশ্বকাপের আসর। কারণ ইংল্যান্ডই একমাত্র দেশ যেখানকার নাগরিকরা স্বপ্ন দেখে পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার। সেখানকার ১৭টি কাউন্টি দলই তখন পেশাদার ক্রিকেটারদের একমাত্র গন্তব্যস্থল।
কিন্তু সেই স্বপ্নে ধাক্কা লাগল যখন কাউন্টি দলগুলোর ভর্তুকি কমে গেল। বার্ষিক ৫ লাখ ৯৫ হাজার পাউন্ড ভর্তুকি পেত একেকটি কাউন্টি দল। ১৯৭৪ সালে সেটা এক লাখ কমে সংখ্যাটা হয় ৪ লাখ ৬০ হাজার। সেটিও আবার এমন সময়ে যখন ইংল্যান্ড জুড়ে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ২৫ শতাংশ।
দল বাঁচিয়ে রাখতে, বিনা সুদে অর্থ ধারের জন্য বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর শরণাপন্ন হওয়া শুরু করে হ্যাম্পশায়ার, মিডলসেক্স, নটিংহ্যাম্পশায়ারের মতো দলগুলো!
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রতিযোগিতা হিসেবে ১৯১২ সালে ত্রিদেশীয় প্রতিযোগিতা আয়োজনের প্রথম প্রচেষ্টা চালানো হয়। ঐ সময়ে টেস্টভূক্ত ৩টি দেশ– ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও সাউথ আফ্রিকাকে নিয়ে টেস্ট ক্রিকেট প্রতিযোগিতাটি প্রতিকূল আবহাওয়া ও দর্শকদের অনাগ্রহের কারণে ভণ্ডুল হয়ে যায়। পরীক্ষামূলকভাবে পরবর্তীতে আর চেষ্টা চালানো হয়নি।
তারপর থেকেই আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেট অঙ্গনে সংশ্লিষ্ট দলগুলোর খেলা দ্বিপক্ষীয় সিরিজে পরিণত হয় ও প্রতিযোগিতার বিপক্ষে অথবা দুই দেশের বাইরে লিগের বিরোধিতা করে।
১৯৬০’র দশকের শুরুতে কাউন্টি ক্রিকেটে ইংলিশ দলগুলো ক্রিকেটের স্বল্প-সংস্করণে জড়িয়ে পড়ে, যা কেবলমাত্র একদিন সময়ের ছিল। ১৯৬২ সালে ৪টি দল নিয়ে গড়া মিডল্যান্ডস নকআউট কাপ ও ১৯৬৩ সালে জিলেট কাপের প্রচলন শুরু হয়। ক্রমে একদিনের ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ১৯৬৯ সালে সানডে লিগ নামে একটি জাতীয় লিগের আয়োজন করা হয়।
১৯৭১ সালে মেলবোর্নে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচটি বৃষ্টির কারণে চারদিনই খেলার অনুপযুক্ত ছিল। নির্ধারিত চূড়ান্ত ও পঞ্চমদিনে প্রথমবারের মতো একদিনের আন্তর্জাতিক খেলা আয়োজন করা হয়। উত্তেজিত দর্শকদের সামলাতে কর্তৃপক্ষ সেদিন চল্লিশ ওভারের খেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে ৪৬ হাজার দর্শকের ভিড় থাকা সত্ত্বেও ক্রিকেটের এই ক্রমবিকাশ ছিল অনিয়মিত, এমনকি বিরক্তিকরও।
পরের বছর একই জাতি অর্থাৎ, অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মধ্য তিন ম্যাচের প্রথম ওয়ানডে সিরিজ হয়, তবে এমসিজির এই প্রতিযোগিতার পরের চার বছরে মাত্র ১৭টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছিল দুদল।
১৯৭৪-৭৫ অ্যাশেজ সফরের সময় এমসিজি আরেকটি সিরিজের আয়োজন করেছিল। কিন্তু সেই সিরিজের ম্যাচগুলোতে গ্যালারির মাত্র এক-পঞ্চমাংশের বেশি পূর্ণ হয়নি। তার উপর টেস্ট ক্রিকেটকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিল প্রথম ক্রিকেট খেলা দুটি দল। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া। এমনকি বিশ্বকাপের পর ১৯৭৫-৭৯ পর্যন্ত একটি ওয়ানডে ম্যাচের অনুমোদন দিতেও অনীহা দেখায় অস্ট্রেলিয়া।
শুধু তাই নয়, ১৯৭২ সালে প্রডেন্সিয়াল ট্রফি সিরিজের সময় দলের নির্বাচকদের দিয়ে ইয়ান চ্যাপেল বলিয়েছিলেন, ‘এই ম্যাচগুলো খেলতে আমি আমার অধিনায়ককে বাধা দেইনি। তবে আমি তাদের সম্পর্কে নিন্দাও করব না।’ এই চ্যাপেল কখনোই ওয়ানডে ক্রিকেটের সমর্থক ছিলেন না।
ওয়ানডে ক্রিকেটের বিপক্ষে কম যাননি পেস বোলিংয়ের কিংবদন্তি ডেনিস লিলিও। টেস্ট এবং ওয়ানডের দোষারোপের দ্বন্দ্বকে তিনি সংক্ষেপে তুলে ধরেন এভাবে, ‘আমি জানি এটি অ-অস্ট্রেলিয়ান বলে মনে হয় এবং আমি প্রায় ধারণাটি আপত্তিকর মনে করি। কিন্তু সীমিত ওভারের ক্রিকেটকে আমাদের নেতিবাচকভাবেই চিন্তা করতে হবে।’
অস্ট্রেলিয়া সীমিত ওভারের ক্রিকেটের বিরোধী ছিল। কারণ, তারা মনে করত তাদের আসল ক্ষুধা ‘অ্যাশেজ’র রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক কৌশলে আঘাত হানতে পারে এটা। একইসঙ্গে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও বিশেষ করে উপমহাদেশের দিক থেকে প্রতিভা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজেদের আধিপত্য ক্ষুণ্ণ হওয়ার ভয়ও ছিল তাদের।
মিডিয়াও সেসময় খুব একটা সহায়ক ছিল না। উইজডেনের মতো সাময়িকী সেই সময়ে তাদের এক সম্পাদকীয় নোটের ১৬টি আইটেমের মধ্যে আসন্ন ইংল্যান্ড-ভারতের মধ্যকার একটি টুর্নামেন্টকে তেমন গুরুত্বই দেয়নি। ক্রিকেটের নতুন জগতের উপলব্ধি হিসেবে ইংল্যান্ড ও ভারতের মধ্যেকার সিরিজের পর্দা ওঠার ব্যাপারটি ডেইলি টেলিগ্রাফ তো আরও বিষণ্নভাবে তুলে ধরে।
সাংবাদিক মাইকেল মেলফোর্ডের প্রিভিউতে গলফ চ্যাম্পিয়নশীপের ধারে কাছেও জায়গা পায়নি ক্রিকেটের শর্টার ভার্সনের গল্প। বরং তিনি এক লেখায়, এই ক্রিকেট (ওয়ানডে) হারিয়ে যায় কিনা তা নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করেন।
আজকের দিনে যেমন, তেমনি আগের দিনেও প্রতিটি খেলার সঙ্গে অর্থের সম্পর্কটা জড়িয়ে ছিল এবং এই সম্পর্ক বেশ জটিলও। অধিকাংশ সময়ই অর্থের সম্পর্কের সঙ্গে খেলার ভবিষ্যৎ সাফল্য জড়িয়ে থাকে। যেখানে বড় ভূমিকা থাকে স্পন্সর ও দর্শকদের।
অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের একটি ম্যাচে মাঠ ভরতে দর্শকদের আহ্বান জানানো হয় এবং লন্ডন ক্রিকেট কর্তৃপক্ষের ডাকে সাড়া দিয়ে সেদিন ২৬ হাজার দর্শক মাঠে উপস্থিত হন। এই উদ্যোগের মাধ্যমে দর্শক ও স্পন্সর মিলিয়ে অল্পদিনে ২ লাখ পাউন্ড আয় হলে অর্থনৈতিক সাফল্য নিশ্চিত হয়। এই উদ্যোগের সফলতাই আস্তে আস্তে ওয়ানডে ক্রিকেট বা বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বপ্নের গাড়িকে সামনে ঠেলে নিয়েছে।
তবুও, ক্রিকেটের দুঃখ-কষ্টের জন্য, এমনকি যারা এই গবেষণাকে স্বাগত জানায় তাদের কিছুটা দোষারোপ করা হয়। তবে এর ভবিষ্যত ছিল নিশ্চিত। সেই ভবিষ্যতের পথ ধরেই শুরু হয় বিশ্বকাপের পথ সুগম হওয়া।
সফলতা ও জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে ঘরোয়াভিত্তিতে একদিনের প্রতিযোগিতা আয়োজনের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ ক্রিকেট বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকে।
এরপর ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো পুরুষদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয়। এর প্রধান কারণ ছিল একমাত্র টেস্ট ক্রিকেটভুক্ত দেশ হিসেবে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা থাকা।
প্রডেন্সিয়াল প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির আর্থিক সহযোগিতায় প্রথম তিনটি প্রতিযোগিতা প্রডেন্সিয়াল কাপ নামেই পরিচিতি পায়। ম্যাচগুলো হয় ৬০ ওভারের।
প্রথম প্রতিযোগিতায় অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, ভারত ও নিউজিল্যান্ড- ঐ সময়ের টেস্টভুক্ত এ ছয়টি দেশ এবং শ্রীলঙ্কাসহ পূর্ব আফ্রিকা দল অংশগ্রহণ করে। বর্ণবৈষম্যের জেরে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে সাউথ আফ্রিকার অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা অংশ নিতে পারেনি। টুর্নামেন্টে সনাতনী ধাঁচে সাদাপোষাক ও লাল বল দিয়ে খেলা হয়। তারপরের ইতিহাস প্রায় সবারই জানা…