গ্রামের পুকুরে মাছ চাষ করার সময়ে রাক্ষুসে মাছ নিধনের জন্য পুকুরে জাল ফেলা হয় এবং জাল দিয়ে রাক্ষুসে মাছ পুকুর থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয়, ছোট মাছগুলো জালে আটকালেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বড় মাছ জালের বাধা অতিক্রম করে কিংবা লাফ দিয়ে পুকুরে থেকে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বড় মাছ পুকুরে থাকলে বাচ্চা উৎপাদন ও বংশবিস্তার করে থাকে এবং যার কারণে মালিকের ইচ্ছে পূরণ হয় না। কেননা বড় রাক্ষুসে মাছ থাকলে তা থেকে পুনরায় রাক্ষুসে মাছ তৈরি হবে।
পরিস্থিতি মোকাবেলায়, প্রয়োজনের তাগিদে এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাছ উৎপাদনের জন্য পুকুরের মালিক পুকুরের পানি শুকিয়ে বড় ছোট সকল আইটেমের রাক্ষুসে মাছ নিধন করে নতুন করে মাছ চাষ শুরু করে যাতে পুকুরে চাষকৃত অন্যান্য মাছ স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে এবং সেক্ষেত্রে মাছ চাষী ব্যবসায় লাভবান হয়। সুতরাং আপনি যখন রাক্ষুসে মাছ নিধন করতে ব্রতী হবেন অর্থাৎ উদ্যোগ গ্রহণ করবেন, আপনাকে অবশ্যই বড়-ছোট সকল আকারের মাছ সম্পূর্ণরূপে নিধন করতে হবে, অন্যথায় রাক্ষুসে মাছ নিধনের যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তা কখনোই সফল হবে না।
ঘটনার পরম্পরায় দুর্নীতি প্রতিরোধে তথা ঢাকা শহরে পরিচালিত অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনার বিরুদ্ধে সরকারের বর্তমান পদক্ষেপকে তুলনা করা যায় এবং জনমনে বিষয়টি ইতিবাচকতার অর্থে বেশ আশার সঞ্চার করেছে। ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গণমাধ্যমে সংবাদগুলো ব্যাপক কাভারেজ পেয়েছে, বিশেষ করে উৎসাহী পাঠকসমাজ ক্যাসিনোর উৎস, বিস্তার ও বাংলাদেশে ক্যাসিনোর আবির্ভাব ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট তথ্য সম্বন্ধে জানতে ব্যাপক আগ্রহ দেখিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে নানাবিধ তথ্য সংগ্রহ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং তাদের অফিস ও বাসা থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ ও স্বর্ণমুদ্রা উদ্ধার করেছে।
যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা অবশ্যই এ ব্যবসায় চুনোপুঁটি এবং তাদের আর্থিক সম্পত্তির ফুলে ফেঁপে উঠার চিত্র পিলে চমকে উঠার মতোই। কেননা, আর্থিক মূল্য বিবেচনায় দুর্নীতির ভয়াবহতায় সাধারণ মানুষ মাত্রই শঙ্কিত ও দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। ক্যাসিনো পরিচালনায় যে ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় সেগুলোর আর্থিক মূল্য ৫০ লক্ষ টাকা থেকে ২.৫ কোটি টাকা পর্যন্ত। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, ক্যাসিনোতে যারা আসা যাওয়া করে তারা অবশ্যই বিপুল পরিমাণে অর্থ লাভ/লোকসান তথা বিনিয়োগ করে থাকে এবং সেখানে লক্ষ কোটি টাকার কারবার হয়ে থাকে। সংবাদমাধ্যম মারফত জানা যায়, ক্যাসিনোতে আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই তাদের স্বর্বস্ব হারিয়ে পরিবার পরিজন ছেড়ে নিঃস্ব জীবনযাপন করছে।
রাঘববোয়াল তারাই যারা গ্রেপ্তারকৃতদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়েছে এবং বিনিময়ে অর্থসহ নানাবিধ সুবিধা গ্রহণ করেছে। আশ্রয় প্রশ্রয়দের নাম বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এসেছে যদিও তদন্তের স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কারও নাম প্রকাশ করেনি। তবে এ বিষয়টি বুঝতে বাকি নেই ক্যাসিনো ব্যবসার সাথে জড়িত রাঘববোয়ালরা খুবই প্রভাবশালী ও তাদের দাপট দেশে বিদেশে সমানভাবেই রয়েছে; না হলে এখনো তাদেরকে কিসের জন্য গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না? সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে সাধারণ মানুষ যেভাবে স্বাগত জানিয়েছে ঠিক তেমনিভাবে ক্যাসিনো পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাঘববোয়ালদের এখনো গ্রেপ্তার না করায় সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও দ্বিধাগ্রস্ত, শঙ্কিত। বিষয়টা কিন্তু রাক্ষুসে মাছ নিধনের মতোই, আপনি চুনোপুঁটিদের নিধন করলেই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সফল হবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত ক্যাসিনো ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট রাঘববোয়ালদের নিধনে উদ্যোগী হবেন। রাঘববোয়ালদের নিধন না করা গেলে সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের শৌর্য অচিরেই তলানিতে নেমে যাবে। কাজেই, চুনোপুঁটিদের সাথে সাথে রাঘববোয়ালদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে সফল হওয়া যাবে না। বিশেষ করে ক্যাসিনাগুলো পরিচালনার সরঞ্জাম আমদানি করা থেকে শুরু করে ব্যবসা পরিচালনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে সনাক্ত করে সমূলে উৎপাটন করতে হবে, তবেই বাংলাদেশ থেকে চিরতরে ক্যাসিনো ব্যাধি বন্ধ হবে।
দেশের নামকরা ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনো পরিচালিত হচ্ছে বিষয়টি খুবই হতাশার, লজ্জার এবং একই সঙ্গে বেদনার। অথচ ক্লাবগুলোর ছিল ঐশ্বর্য, ছিল ইতিহাস এবং সুখকর কিছু স্মৃতি। লীগের খেলাগুলো কেন জমে উঠছে না তার কারণ খুঁজতে খুব বেশি ক্রীড়া বিশারদ হবার প্রয়োজন নেই। ক্রিকেট বাদে অন্যান্য খেলার মান খুব একটা সুখকর পর্যায়ে নেই। ভাল মানের খেলোয়াড় বের হচ্ছে না, বের হবে কিভাবে? যেখানে ক্লাবের পরিচালকরা ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেখানে ক্লাব পরিচালনা, খেলোয়াড় তৈরি, লীগ প্রাণবন্ত করা ইত্যাদিতে তাদের মনোযোগ না থাকাটাই স্বাভাবিক। উল্লেখ্য, লোকমান হোসেন ভূইয়া (১৯৯৬ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা কর্মকর্তা ছিলেন) ঢাকা মোহামেডান ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ ও বিসিবি পরিচালক, র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে ৪১-৪২ কোটি টাকার সম্পদের বিবরণ দিয়েছে এবং প্রতি ৪ মাস পর পর অস্ট্রেলিয়াতে ১২ হাজার ডলার পাঠানোর কথা স্বীকার করেছে। ২ বছর পূর্বে উক্ত ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসা শুরু হয় এবং অর্থ আয়ের উৎস কিভাবে আসে সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সুতরাং সময় এসেছে সবকিছুকে ঢেলে সাজানোর এবং এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ভিন্ন আঙ্গিকে অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়; একটি ক্লাবের সভাপতি বলেছেন, তিনি শুধুমাত্র ক্লাবের উদ্বোধনের দিন উপস্থিত ছিলেন এবং ক্লাবে কী হচ্ছে সে বিষয়ে তিনি ওয়াকিবহাল নন। এটা কেমন অবিবেচকের ন্যায় উক্তি, যে কেউই ক্লাবের সভাপতি হলে উক্ত ক্লাবে কী হয় না হয় তা সভাপতির অনুমতি ছাড়া হবার কথা নয়। অথচ ক্লাবের অফিস কক্ষে সভাপতির ছবি শোভা পাচ্ছে, যাই হোক স্বাভাবিক বিষয় হচ্ছে যে ক্লাবগুলিতে ক্যাসিনো পরিচালিত হয়/হচ্ছে সে ক্লাবগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে বিচারের আওতায় আনতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে যার প্রেক্ষিতে ক্লাবে ভবিষ্যতে কেউই এরকম অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করার দুঃসাহস না দেখাতে পারে।
বেশ কয়েকদিন আগে জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একজন রাজনীতিবিদের লেখা পড়েছি এবং তিনি সমসাময়িক ইস্যুতে নিয়মিত লিখেন এবং প্রায়শই তার কলামগুলো পড়ার চেষ্টা করি। লেখার সারাংশ করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে; আপনি যে কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক হতে পারেন এটা দোষের কিছু নয়। কারণ, মানুষের চিন্তা, চেতনা, আদর্শিক জায়গা বিভিন্ন কারণেই একজনের থেকে অন্যজনের আলাদা এবং এটা স্বাভাবিক। দোষের তখনি হবে যখন আপনি সামান্য সুযোগ সুবিধা প্রদান এবং গ্রহণের নিমিত্তে এক দল হতে অন্য দলে গমন করবেন এবং নিজের অতীত ইতিহাসকে সহসাই ভুলে যাবেন।
বর্তমানে রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় এবং ক্যাসিনোর সাথে সম্পৃক্তদের যাদের ইতোমধ্যে ধরা হয়েছে সকলেই দলছুট অর্থাৎ বিভিন্ন দল থেকে আওয়ামী লীগে এসে ভিড়েছে। শুধু ভিড়েছে তাই নয়, তারা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অবৈধ উপায়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছে রাঘববোয়ালদের যোগসাজশে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগও শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করতে পারে; কারা, কোন নেতাদের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন দল থেকে আওয়ামী লীগে এসে রাজনীতির প্রভাব ও বলয়ে থেকে দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে দল এবং সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলের জন্য। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় যাদের শ্রম, ঘাম ও রক্তে আজকের পর্যায়ে এসেছে তারা অনেকেই দলে কোণঠাসা, দলে হাইব্রিড ও অতিথি পাখিদের ভিড়। হাইব্রিড ও অতিথি পাখিদের চিহ্নিতকরণের সাথে সাথে তাদেরকে যে সকল নেতারা দলে ঠাঁই দিয়েছে তাদেরকেও জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসা জরুরী। কয়েকদিন পূর্বে আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা আক্ষেপ করে বলেছেন, রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও অনুকূল রাখার স্বার্থেই সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযান জোরালো ও সর্বময় করতে হবে।
পরিশেষে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদানে বিরত থাকাই শ্রেয় হবে। কেননা, দুর্নীতিবাজের কোন চরিত্র নেই, সে সকল দলের জন্যই ক্ষতিকর। তাই মত, পেশা, শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সকলকে একাট্টা হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আইন সবার জন্য সমান; এই নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েই প্রভাবশালী, ক্ষমতাধর, রাঘববোয়াল, চুনোপুঁটি, রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক সকলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ সাপেক্ষে প্রচলিত আইনানুযায়ী তড়িৎগতিতে ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ইতিবাচক সংস্কৃতির চর্চা ধারণ ও লালন করতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের যে পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে সেটা চলমান থাকলে প্রকৃত দোষীরা কোনক্রমেই রক্ষা পাবে না এবং উদাহরণ সৃষ্টি হয়ে থাকলে পরবর্তীতে দুর্নীতি করার পূর্বে যে কেউই কয়েকবার ভেবেচিন্তে দুর্নীতি না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন, দুর্নীতি বন্ধ হয়ে গেলে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্য, নিপীড়ন কমে যাবে এবং সকলেই স্বাভাবিক, নিরাপদ ও আনন্দ চিত্তে জীবনযাপন করতে পারবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)